
📖 Class 10 History Chapter 4 Questions and Answers: এই পৃষ্ঠায় তোমরা পাবে মাধ্যমিক ইতিহাসের চতুর্থ অধ্যায় — “সঙ্ঘবদ্ধতার গোড়ার কথা” সম্পর্কিত সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর। এই অধ্যায়ে দুটি প্রধান অংশ রয়েছে:
🔹 Topic A: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ — প্রকৃতি, চরিত্র ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন
🔹 Topic B: সভা সমিতির যুগ — ভারতীয় রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষকাল
🔹 Topic C: লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ: বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ
প্রতিটি টপিকের অধীনে তিন ধরনের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে—
✅ সংক্ষিপ্ত উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন
✅ বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
✅ ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন
এই প্রশ্নোত্তরগুলি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে এবং পাঠ্যপুস্তকের বাইরের অতিরিক্ত তথ্যের মাধ্যমে তোমার উত্তরকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে।
Topic A:🏛️ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ: প্রকৃতি, চরিত্র ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন
📖 ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন
প্রশ্ন ১: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র বিশ্লেষণ করো।
উত্তর:
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ও চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। এই ঘটনাটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়, যার ফলে এর চরিত্র সম্পর্কে একাধিক ধারণা প্রচলিত আছে।
- সিপাহি বিদ্রোহ: বহু ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং প্রশাসক, যেমন চার্লস রেক্স, ম্যালেসন, জন কে, জন লরেন্স, সিসিলি প্রমুখ মনে করেন যে এটি ছিল নিছকই এক ‘সিপাহি বিদ্রোহ’। তাদের মতে, মূলত সৈন্যদের মধ্যেই অসন্তোষ সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষত, এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানোর গুজব সৈন্যদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত হানে। এছাড়াও সৈন্যদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, কম বেতন, পদোন্নতিতে বঞ্চনা ইত্যাদি কারণগুলি এই বিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়। তারা মনে করেন, সাধারণ মানুষ বা অন্য কোনো গোষ্ঠী এতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল না।
- মহাবিদ্রোহ বা জাতীয় বিদ্রোহ: অন্যদিকে, বহু ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক, যেমন বিনায়ক দামোদর সাভারকর, অশোক মেহতা প্রমুখ এই ঘটনাকে নিছক ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলতে নারাজ। সাভারকর তার ‘দ্য ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ গ্রন্থে এটিকে ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, যদিও বিদ্রোহের সূচনা সিপাহিদের হাত ধরে হয়েছিল, দ্রুত তা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং এক গণবিদ্রোহের রূপ নেয়। নানা সাহেব, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, কুনওয়ার সিং, অযোধ্যার বেগম হজরত মহলের মতো ক্ষমতাচ্যুত দেশীয় রাজন্যবর্গ, তালুকদার, সাধারণ কৃষক, কারিগর এবং সাধারণ মানুষ এই সংগ্রামে অংশ নেন। তাদের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসন উৎখাত করা। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন মনে করেন, যা ধর্মের নামে শুরু হয়েছিল, তা শেষে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত হয়, যদিও এর জাতীয় চরিত্র সীমিত ছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও এর ব্যাপকতা স্বীকার করলেও একে পুরোপুরি ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বলতে দ্বিধা প্রকাশ করেছেন, কারণ তার মতে তখনও ভারতে জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি এবং বিদ্রোহে সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না।
- সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া: কিছু মার্কসবাদী ঐতিহাসিক, যেমন রজনীপাম দত্ত, মনে করেন যে এটি ছিল মূলত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তশ্রেণির প্রতিক্রিয়া। যদিও এতে কৃষক ও কারিগরদের অংশগ্রহণ ছিল, নেতৃত্ব ছিল মূলত ক্ষমতাচ্যুত সামন্তপ্রভুদের হাতে।
- সীমাবদ্ধতা: মহাবিদ্রোহের ব্যাপকতা অনস্বীকার্য হলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েনি। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল এবং পাঞ্জাব ও বাংলা এই বিদ্রোহে তেমনভাবে যোগ দেয়নি। শিখ, গুর্খা সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষেই ছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর থেকে দূরে ছিল। এছাড়াও, বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা আধুনিক অস্ত্রের অভাব ছিল।
উপসংহার: সুতরাং, ১৮৫৭ সালের ঘটনা শুধুমাত্র সিপাহি বিদ্রোহ ছিল না, আবার একে পুরোপুরি ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ বা ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলাও কঠিন। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হওয়া সবচেয়ে বড় এবং ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান, যেখানে সিপাহিদের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল। এর চরিত্র ছিল অত্যন্ত জটিল এবং স্থানভেদে ভিন্ন। যদিও এটি সরাসরি স্বাধীনতা এনে দিতে পারেনি, তবে এই বিদ্রোহই পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
প্রশ্ন ২: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহকে ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যায় কি? যুক্তিসহ আলোচনা করো।
উত্তর:
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা যায় কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিতর্ক বিদ্যমান।
- ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলার স্বপক্ষে যুক্তি:
- বিনায়ক দামোদর সাভারকর তার “The Indian War of Independence” (ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ) বইতে প্রথম এই বিদ্রোহকে ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করেন। তিনি মনে করেন, এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল বিদেশি (ব্রিটিশ) শাসন উৎখাত করে স্বাধীনতা অর্জন করা।
- বিদ্রোহের ব্যাপকতা শুধুমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষ, কৃষক, কারিগর এবং ক্ষমতাচ্যুত রাজা ও জমিদাররা এতে অংশ নিয়েছিলেন।
- বিদ্রোহ চলাকালীন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য দেখা গিয়েছিল, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। বাহাদুর শাহ জাফরকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করা এই ঐক্যের প্রতীক।
- বিদ্রোহীদের মূল লক্ষ্য ছিল ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা, যা একে একটি স্বাধীনতার যুদ্ধের চেহারা দেয়।
- ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলার বিপক্ষে যুক্তি:
- বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, ১৮৫৭ সালের ঘটনা ‘প্রথম’ নয়, ‘জাতীয়’ নয়, এবং ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’ও নয় (“neither first, nor national, nor a war of independence”)। তার মতে, এর আগেও ভারতে বহু বিদ্রোহ হয়েছে। এই বিদ্রোহে সমগ্র ভারত বা সকল শ্রেণির মানুষ যোগ দেয়নি, তাই এটি ‘জাতীয়’ নয়। অনেক নেতার লক্ষ্য ছিল নিজেদের হারানো রাজ্য বা ক্ষমতা ফিরে পাওয়া, সামগ্রিক জাতীয় মুক্তি নয়।
- ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেনের মতে, বিদ্রোহের শুরুতে জাতীয়তাবাদী চেতনা বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রধান ছিল না। এটি প্রথমে ধর্ম রক্ষার লড়াই হিসেবে শুরু হলেও পরে কিছু অঞ্চলে স্বাধীনতার যুদ্ধের চরিত্র লাভ করে। তবে এর সামগ্রিক চরিত্র ‘জাতীয়’ ছিল না।
- বিদ্রোহটি মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত প্রায় শান্ত ছিল। পাঞ্জাব ও বাংলার অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। শিখ, গুর্খা এবং অনেক দেশীয় রাজ্যের শাসকেরা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল।
- বিদ্রোহীদের কোনো সুস্পষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা আধুনিক জাতীয়তাবাদী আদর্শ ছিল না। তাদের মধ্যে সমন্বয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব ছিল প্রকট।
উপসংহার: যদিও ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহকে সর্বসম্মতভাবে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বলা যায় না, কারণ এতে আধুনিক জাতীয়তাবাদের অভাব এবং সর্বভারতীয় রূপের অনুপস্থিতি ছিল, তবুও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে হওয়া সবচেয়ে বড় সশস্ত্র প্রতিরোধ, যা প্রমাণ করে যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন চিরস্থায়ী নয়। এই বিদ্রোহ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল এবং পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তাই একে আধুনিক অর্থে ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ না বলা গেলেও, ব্রিটিশ বিরোধী গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে এর স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক ছিল।
প্রশ্ন ৩: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কোন্ যুক্তিতে ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ এবং কোন্ যুক্তিতে ‘সামন্ত শ্রেণির আন্দোলন’ বলা হয়?
উত্তর:
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। এই বিদ্রোহকে কেউ কেউ ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ হিসেবে দেখেন, আবার কেউ কেউ এটিকে প্রধানত ‘সামন্ত শ্রেণির আন্দোলন’ বলে মনে করেন। উভয় মতের পক্ষেই কিছু যুক্তি রয়েছে, যা নিচে আলোচনা করা হলো:
ক) ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ বলার যুক্তি:
যাঁরা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা জাতীয় বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করেন, তাঁরা নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি তুলে ধরেন:
- ব্যাপক গণ-অংশগ্রহণ: এই বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বহু সাধারণ মানুষ – কৃষক, কারিগর, মজুর – স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। এই ব্যাপকতা একে নিছক সিপাহি বিদ্রোহের ঊর্ধ্বে স্থাপন করে।
- বিদেশি শাসন অবসানের লক্ষ্য: বিদ্রোহীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো। যদিও তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা বা পরিকল্পনা ছিল না, বিদেশি শত্রুকে বিতাড়িত করার এই সাধারণ আকাঙ্ক্ষা একটি জাতীয় অনুভূতির পরিচায়ক।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: বিদ্রোহ চলাকালীন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। উভয় সম্প্রদায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং বাহাদুর শাহ জাফরকে ‘হিন্দুস্তানের সম্রাট’ হিসেবে মেনে নেয়। এই ধর্মীয় সম্প্রীতি একে একটি জাতীয় চরিত্র দান করে।
- ঐতিহাসিকদের মত: বিনায়ক দামোদর সাভারকর, অশোক মেহতা প্রমুখ ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে ভারতের ‘প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ বা জাতীয় বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেনও মনে করেন, যা ধর্মের নামে শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীতে কিছু অঞ্চলে স্বাধীনতার যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। এমনকি ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, যিনি একে কঠোর অর্থে ‘জাতীয়’ বলতে দ্বিধাগ্রস্ত, তিনিও এর ব্যাপকতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করেছেন।
খ) ‘সামন্ত শ্রেণির আন্দোলন’ বলার যুক্তি:
অন্যদিকে, বেশ কিছু ঐতিহাসিক ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে মূলত সামন্ত শ্রেণির আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর সপক্ষে যুক্তিগুলি নিম্নরূপ:
- সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব: বিদ্রোহের প্রধান নেতারা ছিলেন মূলত ক্ষমতাচ্যুত বা বিক্ষুব্ধ সামন্ত প্রভু, রাজা, নওয়াব এবং তালুকদার। যেমন – নানা সাহেব, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, অযোধ্যার বেগম হজরত মহল, বিহারের কুনওয়ার সিং প্রমুখ। এঁদের অনেকেই নিজেদের হারানো ক্ষমতা, রাজ্য বা মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্যই মূলত লড়াইয়ে নেমেছিলেন।
- ব্যক্তিগত ও আঞ্চলিক স্বার্থ: অনেক নেতার লক্ষ্য ছিল জাতীয় মুক্তির পরিবর্তে নিজেদের ব্যক্তিগত বা আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করা। উদাহরণস্বরূপ, নানা সাহেব তাঁর পেশোয়া পদ ও ভাতা ফিরে পেতে চেয়েছিলেন, রানি লক্ষ্মীবাই তাঁর দত্তক পুত্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। একটি অখণ্ড জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের ধারণা তাঁদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল।
- মার্কসবাদী ব্যাখ্যা: রজনীপাম দত্তের মতো মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এটি ছিল ব্রিটিশ পুঁজিবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভারতের ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের শেষ প্রচেষ্টা। যদিও কৃষক ও কারিগররা এতে যোগ দিয়েছিল, কিন্তু নেতৃত্ব ছিল সামন্ত শ্রেণির হাতে এবং তাঁদের লক্ষ্য ছিল পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা।
- জাতীয় চেতনার অভাব: ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও অন্যান্য ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যে, সেই সময়ে ভারতে আধুনিক জাতীয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। বিদ্রোহীরা একটি অভিন্ন জাতীয় পতাকার তলায় সমবেত হয়নি বা কোনো সুসংহত জাতীয় পরিকল্পনাও গ্রহণ করেনি। অনেক অঞ্চলের মানুষ বা গোষ্ঠী (যেমন – শিখ, গুর্খা, বহু দেশীয় রাজ্য, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি) এই বিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল বা ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল, যা এর ‘জাতীয়’ চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
উপসংহার:
পরিশেষে বলা যায়, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের চরিত্র ছিল অত্যন্ত জটিল ও বহুমাত্রিক। একে শুধুমাত্র ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ বা শুধু ‘সামন্ত শ্রেণির আন্দোলন’ হিসেবে চিহ্নিত করা কঠিন। এতে সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বের স্বার্থ যেমন ক্রিয়াশীল ছিল, তেমনই বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও প্রতিফলিত হয়েছিল। এটি ছিল প্রাক-জাতীয়তাবাদী যুগের একটি বৃহত্তম ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী সংগ্রাম, যা একইসঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া এবং জাতীয় জাগরণের প্রাথমিক লক্ষণের মিশ্রণ বহন করে।
📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
১. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রধান রাজনৈতিক কারণগুলি কী ছিল?
উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পিছনে একাধিক রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান ছিল:
- স্বত্ববিলোপ নীতি: লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করে সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর, সম্বলপুর প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্তি রাজন্যবর্গের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার করে।
- কুশাসনের অজুহাতে রাজ্য গ্রাস: অযোধ্যার মতো রাজ্যকে কুশাসনের অজুহাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা স্থানীয় শাসক ও জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি করে।
- মোগল সম্রাটের প্রতি অমর্যাদা: দিল্লির মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস করা এবং তাঁর উত্তরসূরিদের বাদশাহ উপাধি ও লালকেল্লা ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত অভিজাত ও সাধারণ মুসলিমদের আহত করে।
- উপাধি ও ভাতা বিলোপ: নানা সাহেবের মতো দেশীয় শাসকদের পেশোয়া পদ ও বার্ষিক ভাতা বাতিল করার মতো পদক্ষেপগুলি তাঁদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য করে।
২. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের অর্থনৈতিক কারণগুলি বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: মহাবিদ্রোহের নেপথ্যে গভীর অর্থনৈতিক শোষণ ও অসন্তোষ ক্রিয়াশীল ছিল:
- শিল্প ও বাণিজ্যের ধ্বংস: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীতির ফলে ভারতের ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প, বস্ত্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় এবং কারিগর ও শ্রমিক শ্রেণি কর্মহীন হয়ে পড়ে।
- কৃষকদের ওপর শোষণ: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সহ বিভিন্ন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের ওপর অত্যাধিক করের বোঝা চাপানো হয়। মহাজনদের শোষণ এবং ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
- সম্পদের বহির্গমন: ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্রিটেনে চলে যেতে থাকে (“Drain of Wealth”), যা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।
- বৈষম্য ও বেকারত্ব: সরকারি চাকরিতে ভারতীয়দের উচ্চপদে নিয়োগ করা হতো না এবং ইংরেজদের তুলনায় বেতনও অনেক কম দেওয়া হতো, যা শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
৩. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সামাজিক কারণগুলি উল্লেখ করো।
উত্তর: ব্রিটিশ শাসনামলে গৃহীত কিছু সামাজিক পদক্ষেপ ও আচরণ ভারতীয় সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যা মহাবিদ্রোহের অন্যতম কারণ:
- জাতিগত বৈষম্য: ব্রিটিশরা ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা ও অবজ্ঞার মনোভাব পোষণ করত। ভারতীয়দের ‘কালা আদমি’ বলে অপমান করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সাধারণ মানুষের আত্মসম্মানে আঘাত করে।
- ধর্ম ও সংস্কারে হস্তক্ষেপ: সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন প্রভৃতি সমাজ সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলিকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাদের ধর্ম ও ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হিসেবে দেখে। খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণের কার্যকলাপ নিয়েও আতঙ্ক ছড়ায়।
- ** পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার:** ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসারের ফলে ভারতীয়দের একাংশ মনে করে যে ব্রিটিশরা তাদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চাইছে।
- ধর্মান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা: মিশনারিদের কার্যকলাপ এবং কিছু ব্রিটিশ কর্মকর্তার আচরণের ফলে গুজব রটে যে সরকার জোর করে ভারতীয়দের খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করছে।
৪. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাবideosর মহাবিদ্রোহের সামরিক কারণগুলি কী ছিল?
উত্তর: ভারতীয় সিপাহিদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ মহাবিদ্রোহের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল:
- বেতন ও পদোন্নতিতে বৈষম্য: ভারতীয় সিপাহিদের তুলনায় ব্রিটিশ সৈন্যদের অনেক বেশি বেতন দেওয়া হতো এবং ভারতীয়দের জন্য পদোন্নতির সুযোগ ছিল অত্যন্ত সীমিত।
- ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত: ১৮৫৬ সালের ‘সাধারণ সেনা তালিকাভুক্তি আইন’ (General Service Enlistment Act) অনুসারে ভারতীয় সিপাহিদের প্রয়োজনে সমুদ্র পেরিয়ে বিদেশের যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে বাধ্য করা হয়, যা অনেকের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী ছিল। এছাড়া দাড়ি রাখা, তিলক পরা ইত্যাদিতেও বাধা দেওয়া হতো।
- বদলি ভাতা বাতিল: সিপাহিদের নির্দিষ্ট অঞ্চলের বাইরে কাজ করার জন্য যে অতিরিক্ত ভাতা (batta) দেওয়া হতো, তা বন্ধ করে দেওয়ায় তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়।
- অফিসারদের দুর্ব্যবহার: ব্রিটিশ সামরিক অফিসাররা প্রায়শই ভারতীয় সিপাহিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অপমানজনক আচরণ করত।
- সৈন্য অনুপাতে গরমিল: সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সিপাহির সংখ্যা ব্রিটিশ সৈন্যের তুলনায় অনেক বেশি ছিল, যা সিপাহিদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে এবং বিদ্রোহে সাহস জোগায়।
৫. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কী ছিল?
উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ বা আশু কারণ ছিল ‘এনফিল্ড রাইফেল’ (Enfield Rifle) নামক নতুন বন্দুকের প্রবর্তন। এই রাইফেলের টোটা (Cartridge) দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ভরতে হতো। গুজব রটে যায় যে, এই টোটার আবরণে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে। গরু হিন্দুদের কাছে পবিত্র এবং শুয়োর মুসলিমদের কাছে অপবিত্র হওয়ায় উভয় সম্প্রদায়ের সিপাহিরাই মনে করে যে ব্রিটিশ সরকার bewustভাবে তাদের ধর্ম নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এই ধর্মনাশের আশঙ্কাই সিপাহিদের উত্তেজিত করে তোলে এবং ব্যারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডে ও মিরাটের সিপাহিদের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে মহাবিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।
৬. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল কেন?
উত্তর: বিভিন্ন কারণে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়:
- নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের অভাব: বিদ্রোহীদের মধ্যে কোনো একক, যোগ্য ও সর্বজনগ্রাহ্য নেতা ছিলেন না। বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা নিজেদের মতো করে লড়াই চালালেও তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় বা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না।
- সর্বভারতীয় রূপের অভাব: বিদ্রোহ মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল। পাঞ্জাব, বাংলা, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল হয় শান্ত ছিল, না হয় ব্রিটিশদের সমর্থন করে।
- সামরিক দুর্বলতা: ব্রিটিশ বাহিনী ছিল উন্নত অস্ত্রশস্ত্র, সুদক্ষ সেনাপতি এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় সজ্জিত। অন্যদিকে, বিদ্রোহীরা মূলত পুরনো অস্ত্রশস্ত্র এবং সনাতন যুদ্ধ কৌশলের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
- সব শ্রেণির সমর্থনের অভাব: ভারতের সকল গোষ্ঠী বা শ্রেণি এই বিদ্রোহে যোগ দেয়নি। বিশেষত, শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বহু দেশীয় রাজা ও জমিদার এবং শিখ ও গুর্খা সৈন্যরা বিদ্রোহের বিরোধিতা করে বা ব্রিটিশদের সাহায্য করে।
- নির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব: বিদেশি শাসন উচ্ছেদ করার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, বিদ্রোহ সফল হলে ভারতে কী ধরনের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হবে, সে বিষয়ে বিদ্রোহীদের কোনো সুস্পষ্ট ও ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না।
৭. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব কীরূপ ছিল?
উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রতি তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব ছিল মূলত বিরূপ বা উদাসীন। এর প্রধান কারণগুলি হল:
- ব্রিটিশ শাসনের সুফলে বিশ্বাস: এই শ্রেণি মনে করত যে ব্রিটিশ শাসনের ফলে ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ (যেমন সতীদাহ রদ) এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারা বিদ্রোহ সফল হলে পুরনো অরাজকতা ও সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ফিরে আসার আশঙ্কা করত।
- বিদ্রোহীদের প্রতি সন্দেহ: শিক্ষিত বাঙালিরা বিদ্রোহীদের পশ্চাৎমুখী ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তির প্রতিনিধি হিসেবে দেখত এবং তাদের লক্ষ্য ও কার্যকলাপের প্রতি আস্থাশীল ছিল না।
- স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা: তারা মনে করত যে ব্রিটিশ শাসনই ভারতে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম।
- ফলস্বরূপ: এই মনোভাবের কারণে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ শুধু বিদ্রোহ থেকে দূরেই থাকেনি, অনেকে এর বিরোধিতাও করেছিল। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছাড়া সামগ্রিকভাবে তাদের সমর্থন বিদ্রোহীরা পায়নি।
৮. প্রশ্ন: মহারানির ঘোষণাপত্র (১৮৫৮) সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এর ফলস্বরূপ, ১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর এলাহাবাদে আয়োজিত এক দরবারে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। এর প্রধান বিষয়গুলি ছিল:
- কোম্পানি শাসনের অবসান: ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটানো হয় এবং শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ মহারানির (British Crown) হাতে তুলে দেওয়া হয়।
- স্বত্ববিলোপ নীতি বাতিল: ভবিষ্যতে আর কোনো দেশীয় রাজ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
- ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ঐতিহ্য রক্ষা: ভারতীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার এবং সেগুলিতে হস্তক্ষেপ না করার আশ্বাস দেওয়া হয়।
- সম আচরণের প্রতিশ্রুতি: জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুযায়ী সকল ভারতীয়কে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় (যদিও বাস্তবে এটি খুব কমই পালিত হয়েছিল)।
- উদ্দেশ্য: এই ঘোষণাপত্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল মহাবিদ্রোহের পর ভারতীয় জনগণ, বিশেষত দেশীয় রাজা ও জমিদারদের আশ্বস্ত করে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করা।
অবশ্যই! আপনার চূড়ান্ত বিন্যাস অনুযায়ী আমি প্রশ্নগুলিকে বোল্ড করে এবং প্রতিটির পরে একটি করে লাইন ব্রেক দিয়ে উত্তরগুলি আবার সাজিয়ে দিচ্ছি। আপনার ধৈর্য এবং সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
📖 সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন
১. প্রশ্ন: উনিশ শতকে উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের ভারতবাসীর ক্ষোভের কারণ কি ছিল?
উত্তর:
- রাজনৈতিক: ব্রিটিশদের রাজ্যবিস্তার নীতি (যেমন – স্বত্ববিলোপ নীতি, কুশাসনের অজুহাতে অযোধ্যা দখল) দেশীয় রাজন্যবর্গ ও অভিজাতদের বিক্ষুব্ধ করে।
- অর্থনৈতিক: উচ্চ হারে ভূমিরাজস্ব আদায়, ভারতীয় চিরাচরিত কুটির শিল্পের ধ্বংস, ব্রিটিশ পণ্যের অবাধ প্রবেশ, কারিগর ও কৃষকদের ওপর শোষণ এবং ভারত থেকে সম্পদের বহির্গমন জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ হয়।
- সামাজিক ও ধর্মীয়: ব্রিটিশদের জাতিগত ঔদ্ধত্য ও ভারতীয়দের প্রতি অবজ্ঞা, সতীদাহ প্রথা রদ বা বিধবা বিবাহের মতো সমাজ সংস্কার আইনগুলিকে ভারতীয়দের একাংশের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিতে হস্তক্ষেপ বলে মনে করা, এবং জোর করে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার গুজব সমাজে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দেয়।
- সামরিক: ভারতীয় সিপাহিদের বেতন, ভাতা, পদোন্নতিতে চরম বৈষম্য, জাতিগত ও ধর্মীয় চিহ্ন ব্যবহারে বাধা এবং চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তন তাদের ক্ষোভের চূড়ান্ত কারণ হয়।
২. প্রশ্ন: এনফিল্ড রাইফেলের টোটাল ঘটনাটি কি অথবা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ কি ছিল?
উত্তর: ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেল নামে নতুন বন্দুক চালু হয়। এই বন্দুকের টোটা (কার্তুজ) দাঁত দিয়ে কেটে বন্দুকে ভরতে হতো। ১৮৫৭ সালের শুরুতে সেনাবাহিনীতে ব্যাপকভাবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, এই টোটার খোলসে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে, যা যথাক্রমে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহিদের ধর্মীয় বিশ্বাসে চরম আঘাত হানে, কারণ গরুর চর্বি হিন্দুদের ও শুয়োরের চর্বি মুসলিমদের কাছে ধর্মীয়ভাবে অপবিত্র। এই চর্বি মাখানো টোটাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ বা আশু কারণ হিসেবে কাজ করে।
৩. প্রশ্ন: ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর লোকেরা কেন এনফিল্ড রাইফেলের টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন?
উত্তর: ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সিপাহিরা (হিন্দু ও মুসলিম উভয়ই) এনফিল্ড রাইফেলের টোটা ব্যবহারে ধর্মনাশের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিল। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে:
- টোটার আবরণে ব্যবহৃত চর্বি গরু (হিন্দুদের কাছে পবিত্র) এবং শুয়োর (মুসলিমদের কাছে অপবিত্র) থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
- এই টোটা দাঁত দিয়ে কাটার অর্থ হলো সরাসরি ধর্মচ্যুত হওয়া।
- এটি ছিল ব্রিটিশ সরকারের ভারতীয়দের ধর্ম নষ্ট করার একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত। এই ধর্মীয় সংবেদনশীলতার কারণেই তারা এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে।
৪. প্রশ্ন: মঙ্গল পান্ডে কে ছিলেন?
উত্তর:
- মঙ্গল পাণ্ডে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে অবস্থিত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ৩৪তম বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যানট্রি (B.N.I.) রেজিমেন্টের একজন তরুণ, ধর্মপ্রাণ সিপাহি।
- তিনিই প্রথম ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ চর্বিযুক্ত টোটার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দুজন ব্রিটিশ অফিসারকে আক্রমণ করেন।
- এই ঘটনার পরই তাঁকে গ্রেফতার করে বিচার করা হয় এবং ১৮৫৭ সালের ৮ই এপ্রিল ফাঁসি দেওয়া হয়। তিনি মহাবিদ্রোহের প্রথম শহিদ হিসেবে বিবেচিত হন।
৫. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা কেন সিপাহী বিদ্রোহ বা সামরিক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর:
- কারা: সমকালীন ব্রিটিশ লেখক, প্রশাসক ও ঐতিহাসিক, যেমন – চার্লস রেক্স, জন কে, ম্যালেসন, জন লরেন্স, জন সিলি প্রমুখ। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারও প্রাথমিকভাবে একে সিপাহি বিদ্রোহ হিসেবেই দেখেছেন।
- কারণ: তাঁরা মনে করতেন:
- বিদ্রোহের সূচনা ও নেতৃত্ব মূলত সিপাহিদের দ্বারাই হয়েছিল।
- এর প্রধান কারণ ছিল সিপাহিদের ক্ষোভ (টোটা, বেতন, ধর্ম)।
- এতে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল না বা এটি কোনো জাতীয় আন্দোলন ছিল না। তাই এটি ছিল মূলত একটি সামরিক বা সিপাহি বিদ্রোহ।
৬. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা কেন গণবিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর:
- কারা: ঐতিহাসিক জন উইলিয়াম কে, জন নর্টন, ডঃ শশীভূষণ চৌধুরী, ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন (পরবর্তী পর্যায়ে), পিসি যোশি প্রমুখ।
- কারণ: তাঁরা দেখিয়েছেন যে:
- বিদ্রোহ দ্রুত সিপাহিদের গণ্ডি ছাড়িয়ে অযোধ্যা, বিহার, কানপুর ইত্যাদি অঞ্চলের সাধারণ মানুষ – কৃষক, কারিগর, মজুর, বেকার সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
- বহু স্থানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্রিটিশ শাসন, শোষণ এবং তাদের সহযোগী জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
- শুধুমাত্র সৈন্যদের ক্ষোভ নয়, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত গণ-অসন্তোষ এই বিদ্রোহের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তাই এটি একটি গণবিদ্রোহ।
৭. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা কেন জাতীয় বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর:
- কারা: কার্ল মার্কস, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ডিজরেলি, ফরাসি লেখক পিয়ের জোসেফ প্রুধোঁ, ভারতীয় ঐতিহাসিক অশোক মেহতা, বিনায়ক দামোদর সাভারকর প্রমুখ।
- কারণ: তাঁদের যুক্তি ছিল:
- বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল বিদেশি (ব্রিটিশ) শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা।
- উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই সংগ্রামে অংশ নেয়।
- বাহাদুর শাহ জাফরকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করে একটি সর্বভারতীয় বিকল্প প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
- এই ব্যাপকতা, গণ-অংশগ্রহণ এবং বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ একে জাতীয় বিদ্রোহের চরিত্র দান করে।
৮. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা কেন সামন্ততন্ত্র বিরোধী কৃষক অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর:
- কারা: অধ্যাপক সুপ্রকাশ রায়, কিছু মার্কসবাদী ঐতিহাসিক (যেমন রজনীপাম দত্ত কিছুটা এই আঙ্গিকে দেখেছেন)।
- কারণ: তাঁদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী:
- ব্রিটিশ শাসন ও তাদের সৃষ্ট নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা এবং দেশীয় জমিদার-মহাজনদের শোষণ কৃষকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
- বিদ্রোহের সময় কৃষকরা বহু স্থানে শুধুমাত্র ব্রিটিশ নয়, দেশীয় শোষকদের বিরুদ্ধেও আক্রমণ চালায়।
- যদিও নেতৃত্ব সামন্তশ্রেণির হাতে ছিল, কিন্তু বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি ও চরিত্র ছিল সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কৃষক অভ্যুত্থান।
৯. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে কারা কেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর:
- কারা: বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর বিখ্যাত ‘দি ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স, ১৮৫৭’ গ্রন্থে প্রথম এই আখ্যা দেন। পরবর্তীকালে জওহরলাল নেহরু সহ বহু জাতীয়তাবাদী নেতা ও ঐতিহাসিক এই ধারণাকে সমর্থন বা স্বীকার করেন।
- কারণ: তাঁদের মতে:
- এটি ছিল পরাধীন ভারতে বিদেশি শাসন উৎখাতের প্রথম ব্যাপক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
- ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু ভারতীয় এই মুক্তি সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে।
- স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা এই সংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি ছিল।
- পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের এটি ছিল প্রধান অনুপ্রেরণা।
১০. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনোভাব কি ছিল? অথবা শিক্ষিত বাঙালি সমাজের একটি অংশ কেন মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল? অথবা ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের শিক্ষিত সমাজ দূরে ছিল কেন?
উত্তর: তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশই ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ থেকে দূরে ছিল অথবা এর বিরোধিতা করেছিল। এর কারণ:
- ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা: তারা মনে করত ব্রিটিশ শাসন ভারতের আধুনিকীকরণ, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং সমাজ সংস্কারের (সতীদাহ রদ, বিধবা বিবাহ) ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।
- প্রগতিশীলতা: তারা ব্রিটিশ শাসনকে প্রগতির প্রতীক এবং বিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক, পশ্চাৎপদ শক্তির উত্থান বলে মনে করত।
- স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা: তারা আশঙ্কা করত যে, বিদ্রোহ সফল হলে দেশে আবার পুরনো দিনের অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
- স্বার্থ: ব্রিটিশ শাসনে এই শ্রেণি চাকরি, ব্যবসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা লাভ করছিল, যা তারা হারাতে চায়নি।
১১. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের ফলাফল বা গুরুত্ব গুলি উল্লেখ কর
উত্তর:
- কোম্পানি শাসনের অবসান: ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে।
- ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসন: ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা ভারতের শাসনভার সরাসরি ব্রিটিশ মহারানি ও পার্লামেন্টের হাতে চলে যায়।
- মহারানির ঘোষণাপত্র: এর মাধ্যমে নতুন শাসনতান্ত্রিক নীতি ঘোষিত হয়, দেশীয় রাজাদের আশ্বস্ত করা হয়।
- সামরিক পুনর্গঠন: ভারতীয়দের তুলনায় ব্রিটিশ সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি, জাতি ও ধর্মের ভিত্তিতে রেজিমেন্ট গঠন (ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি) এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
- শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন: ভাইসরয় ও ভারত সচিব পদের সৃষ্টি হয়।
- জাতীয়তাবোধের উন্মেষ: বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা ও ঐক্যের ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তী জাতীয় আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।
- শাসক ও শাসিতের দূরত্ব বৃদ্ধি: বিদ্রোহের পর ব্রিটিশদের মনে ভারতীয়দের সম্পর্কে অবিশ্বাস ও ঘৃণা বৃদ্ধি পায়।
১২. প্রশ্ন: কিভাবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের অবসান ঘটে?
উত্তর:
- ব্রিটিশদের উন্নত সামরিক শক্তি: ব্রিটিশদের উন্নত অস্ত্রশস্ত্র, দক্ষ সেনাবাহিনী, সুশৃঙ্খল নেতৃত্ব এবং আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা (টেলিগ্রাফ, রেলপথ) বিদ্রোহ দমনে সহায়ক হয়।
- নির্মম দমননীতি: ব্রিটিশরা অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে বিদ্রোহ দমন করে। দিল্লি, কানপুর, লখনউ, ঝাঁসি ইত্যাদি প্রধান কেন্দ্রগুলি একে একে পুনরুদ্ধার করে এবং বিদ্রোহীদের নির্বিচারে হত্যা বা বন্দী করা হয়।
- বিদ্রোহীদের দুর্বলতা: বিদ্রোহীদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব, উপযুক্ত পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব, আধুনিক অস্ত্রের ঘাটতি এবং সীমিত ভৌগোলিক বিস্তার তাদের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করে।
- ভারতীয়দের একাংশের অসহযোগিতা: শিখ, গুর্খা সৈন্য এবং বহু দেশীয় রাজা ও জমিদার ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে বা নিরপেক্ষ থাকে, যা বিদ্রোহীদের শক্তি হ্রাস করে।
১৩. প্রশ্ন: মহারানীর ঘোষণাপত্র কি?
উত্তর: মহারানির ঘোষণাপত্র হল ১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর এলাহাবাদ দরবারে ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং কর্তৃক ঘোষিত ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়ার একটি ফরমান বা ঘোষণা। এই ঘোষণার মাধ্যমে:
- ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘোষণা করা হয়।
- ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের হাতে তুলে নেওয়া হয়।
- ভারতীয় প্রজা ও দেশীয় রাজাদের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারের ভবিষ্যৎ নীতি ও প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।
১৪. প্রশ্ন: মহারানী ভিক্টোরিয়া কর্তৃক নিজ হাতে ভারতের শাসনভার গ্রহণ সম্পর্কে কি জানো?
উত্তর: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত শাসন আইন’ (Government of India Act 1858, যা ‘Act for the Better Government of India’ নামেও পরিচিত) পাস করে। এই আইন অনুযায়ী:
- কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়।
- শাসনভার ইংল্যান্ডের মহারানি ভিক্টোরিয়ার উপর অর্পণ করা হয়।
- মহারানির প্রতিনিধি হিসেবে ‘ভাইসরয়’ পদ সৃষ্টি করা হয়।
- লন্ডনে ‘ভারত সচিব’ ও ‘ইন্ডিয়া কাউন্সিল’ গঠন করা হয়।
১৫. প্রশ্ন: কে ভাইসরয় উপাধি লাভ করেন?
উত্তর: ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে, ভারতের শেষ গভর্নর-জেনারেল লর্ড ক্যানিং-ই ভারতের প্রথম ‘ভাইসরয়’ (রাজপ্রতিনিধি) উপাধি লাভ করেন।
১৬. প্রশ্ন: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহারানীর ঘোষণাপত্রে দেশীয় রাজাদের প্রতি কি কি ঘোষণা করা হয়েছিল?
উত্তর: ১৮৫৮ সালে ঘোষিত মহারানির ঘোষণাপত্রে (প্রশ্নে ১৮৫৭ লেখা থাকলেও, প্রসঙ্গ ১৮৫৮) দেশীয় রাজাদের প্রতি নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতিগুলি দেওয়া হয়েছিল:
- ব্রিটিশ সরকার ভারতে আর রাজ্যবিস্তার করবে না, অর্থাৎ স্বত্ববিলোপ নীতি পরিত্যক্ত হল।
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে দেশীয় রাজাদের যে সকল চুক্তি বা সন্ধি হয়েছিল, সেগুলি ব্রিটিশ সরকারও সম্পূর্ণরূপে মেনে চলবে।
- দেশীয় রাজাদের অধিকার, মর্যাদা এবং সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখা হবে।
- হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
১৭. প্রশ্ন: মহারানীর ঘোষণাপত্র ঘোষণাপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করা হয় কেন?
উত্তর: এই ঘোষণাপত্রকে সীমাবদ্ধ মনে করার কারণ:
- প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবের ফারাক: যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরি বা আইনের চোখে সমানাধিকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে তেমনভাবে পালিত হয়নি; জাতিগত বৈষম্য প্রকট ছিল।
- শোষণ অব্যাহত: রাজ্যবিস্তার নীতি বন্ধ হলেও, অর্থনৈতিক শোষণ এবং ভারতের সম্পদ নির্গমন বন্ধ হয়নি, বরং নানা উপায়ে তা অব্যাহত থাকে।
- প্রকৃত ক্ষমতা হ্রাস: দেশীয় রাজাদের অধিকার রক্ষার কথা বলা হলেও, ব্রিটিশ রেসিডেন্টদের মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতা খর্ব করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
- সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গি: ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার একে ‘রাজনৈতিক ধাপ্পা’ (Political Bluff) বা ‘ভণ্ডামি’ বলেও অভিহিত করেছেন, কারণ এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষা।
১৮. প্রশ্ন: মহারানীর ঘোষণাপত্রের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল? অথবা মহারানীর ঘোষণাপত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল?
উত্তর: মহারানির ঘোষণাপত্রের মূল বা প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একাধিক:
- ব্রিটিশ শাসন সুদৃঢ়করণ: মহাবিদ্রোহের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত ও নিরাপদ করা।
- আনুগত্য অর্জন: দেশীয় রাজা, জমিদার, ভূস্বামী ও শিক্ষিত শ্রেণির মতো প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলিকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্বস্ত করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি তাদের আনুগত্য অর্জন করা।
- জনসাধারণকে শান্ত করা: ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে সহনশীলতার নীতি ঘোষণা করে এবং সমানাধিকারের আশ্বাস দিয়ে সাধারণ প্রজাদের শান্ত রাখা ও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করা।
- ‘উদার’ ভাবমূর্তি গঠন: ব্রিটিশ শাসনের একটি ‘উদারনৈতিক’ ও ‘কল্যাণকামী’ ভাবমূর্তি তুলে ধরা।