লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ | প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস ১০ ইতিহাস | Madhyamik

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ প্রশ্ন উত্তর

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (৮ নম্বর) 📜 (১৫-১৬টি বাক্যে উত্তর দাও)

১. প্রশ্ন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কীভাবে জাতীয়তাবাদের রূপ প্রস্ফুটিত হয়েছে?

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর রচিত ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসটি সমকালীন যুবসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটিকে ‘স্বদেশপ্রেমের গীতা’ও বলা হয়।

  • রচনার প্রেক্ষাপট: বঙ্কিমচন্দ্র ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০) এবং সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের (১৭৬৩-১৮০০) পটভূমিকায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচনা করেন। এটি প্রথমে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, পরে ১৮৮২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
  • ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা: উপন্যাসে পরাধীন ভারতমাতার দুর্দশা এবং ব্রিটিশ শাসনের শোষণের চিত্র তুলে ধরে বঙ্কিমচন্দ্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর বিরোধিতা করেছেন এবং ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
  • স্বদেশকে ‘মা’ রূপে কল্পনা: বঙ্কিমচন্দ্র এই উপন্যাসে প্রথম স্বদেশভূমিকে ‘মা’ (জননী জন্মভূমি) রূপে কল্পনা করেন এবং দেশপ্রেমকে ধর্মের আসনে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর কাছে দেশপ্রেমই ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।
  • ‘সন্তান দল’-এর আদর্শ: উপন্যাসের ‘সন্তান দল’ (সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের ছায়ায় গঠিত) দেশমাতার মুক্তির জন্য আত্মত্যাগী সংগ্রাম চালায়। তাদের শৃঙ্খলা, দেশভক্তি ও আত্মবলিদানের আদর্শ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে।
  • ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র: উপন্যাসের অন্তর্গত ‘বন্দেমাতরম্’ (১৮৭৫ সালে রচিত) গানটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক জাতীয় স্তোত্র (National Song) হিসেবে গৃহীত হয় এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়। বিপ্লবীরা এই ধ্বনি উচ্চারণ করেই নির্ভয়ে মৃত্যুবরণ করতেন। মাদাম কামা নির্মিত ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকায়ও ‘বন্দেমাতরম’ লেখা ছিল।
  • নারী শক্তির জাগরণ: কল্যাণী, শান্তি, নিমি প্রমুখ নারী চরিত্রের দেশপ্রেম ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র নারীজাতির জাগরণের কথাও বলেছেন।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষার সমালোচনা: উপন্যাসে পাশ্চাত্য শিক্ষার সীমাবদ্ধতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, এই শিক্ষা ব্রিটিশদের কেরানি তৈরি করতে পারলেও দেশপ্রেমিক বিপ্লবী তৈরি করতে পারবে না।

উপসংহার: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি শুধুমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম ছিল না, এটি পরাধীন জাতির মুক্তিসংগ্রামের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল। এটি ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রেরণা জুগিয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষ তাই বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঋষি’ বলে অভিহিত করেছেন।

লেখায় ও রেখায় জাতীয়তাবোধের বিকাশ প্রশ্ন উত্তর

২. প্রশ্ন: জাতীয়তাবোধের বিকাশে বিবেকানন্দের অবদান আলোচনা করো। অথবা, স্বামী বিবেকানন্দ কীভাবে স্বদেশবাসীকে স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন?

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের ভারতে জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান প্রচারক ও পথপ্রদর্শক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ (নরেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৮৬৩-১৯০২)। তিনি পরাধীন, হতাশ ও আত্মবিশ্বাসহীন ভারতবাসীকে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে এক নতুন চেতনায় জাগিয়ে তোলেন।

  • আত্মবিশ্বাস জাগরণ: বিবেকানন্দ পরাধীনতার গ্লানি ও হীনম্মন্যতা দূর করে ভারতবাসীকে নিজের শক্তি ও ঐতিহ্যের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “বল ভাই-ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ” – ভারতবাসীকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে।
  • স্বদেশের সংস্কৃতির প্রতি আস্থা: তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ভারতবাসীকে নিজেদের গৌরবময় অতীত, ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান হতে উদ্বুদ্ধ করেন।
  • দেশমাতৃকার পূজা: বিবেকানন্দ দেশকে ‘মা’ বা ভারতমাতা রূপে আরাধনা করার কথা বলেন। তিনি বলেন, দেশবাসী জন্ম থেকেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত। তিনি আহ্বান জানান, আগামী ৫০ বছর ভারতমাতাই যেন দেশবাসীর একমাত্র আরাধ্যা দেবী হন। অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, দেশপ্রেম যা বঙ্কিমচন্দ্রে ছিল কবিকল্পনা, বিবেকানন্দের রচনায় তা স্পষ্ট অবয়ব লাভ করে।
  • শিকাগো বক্তৃতা (১৮৯৩): আমেরিকার শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে তিনি হিন্দুধর্ম তথা ভারতের আধ্যাত্মিকতা ও উদার ধর্মীয় ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেন, যা বিশ্বে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং ভারতীয়দের আত্মবিশ্বাস জোগায়।
  • ‘মানুষ তৈরির ধর্ম’: বিবেকানন্দ সংকীর্ণ ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে ‘মানুষ তৈরির ধর্ম’ অর্থাৎ সেবার আদর্শ প্রচার করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা আর্তের সেবা ও শিক্ষাবিস্তারে আজও ব্রতী।
  • নবভারতের স্বপ্ন (শূদ্র জাগরণ): তিনি ভারতের ভবিষ্যৎ নির্মাণে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় বা শূদ্র সমাজের জাগরণের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, নতুন ভারত জেগে উঠবে চাষির কুটির, জেলের ঝুপড়ি, মুচি-মেথরের ঘর থেকে।
  • ঐক্যবদ্ধ ভারতের ডাক: তিনি ধর্ম-বর্ণ-জাতির ঊর্ধ্বে উঠে সকল ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের সেবায় আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান।

উপসংহার: বিবেকানন্দের স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক ছিল না, তা ছিল অত্যন্ত বাস্তবমুখী ও শক্তিশালী। ঐতিহাসিক আর. জি. প্রধান তাঁকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক’ বলেছেন, এবং অরবিন্দ ঘোষ তাঁকে ‘জাতীয় জীবন গঠনকর্তা’ রূপে অভিহিত করেছেন।


📝 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (৪ নম্বর) 📝 (৭-৮টি বাক্যে উত্তর দাও)

১. প্রশ্ন: ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে স্বামী বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটির কী ভূমিকা ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘বর্তমান ভারত’ (গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯০৫) গ্রন্থটি উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের মতে, বিবেকানন্দ ছিলেন ভারতের ‘জাতীয় জীবনের গঠনকর্তা’।

  • গৌরবময় অতীত স্মরণ: এই গ্রন্থে বিবেকানন্দ বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে ভারতের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে পরাধীন ভারতবাসীর মনে আত্মশ্রদ্ধা ও জাতীয় গৌরববোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
  • ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান: তিনি ভারতীয় সমাজের বর্ণবৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেন এবং সকল ভারতবাসীকে (‘হে ভারত, ভুলিও না … মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই’) ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
  • শূদ্র জাগরণের ভবিষ্যদ্বাণী: তিনি ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখান যে, ভারতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের শাসনের পর এবার শূদ্র বা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জাগরণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যুগ আসছে, যা দেশবাসীর মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।
  • স্বদেশপ্রেমের মন্ত্র: ‘বর্তমান ভারত’-এর শেষ অংশে তিনি ভারতবাসীকে ‘স্বদেশমন্ত্রে’ দীক্ষিত করেন – “ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ… ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ”। এই মন্ত্র পরাধীন জাতির শিরায় নতুন রক্তসঞ্চার করে।
  • দেশমাতৃকার সেবা: তিনি পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করে ভারতমাতার মুক্তির জন্য দেশবাসীকে সেবার আদর্শে আত্মনিয়োগ করার ডাক দেন।

উপসংহার: ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থের মাধ্যমে বিবেকানন্দ ভারতবাসীকে যে গভীর স্বদেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস এবং ঐক্যের বাণী শুনিয়েছিলেন, তা পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবীদের পাথেয় হয়ে উঠেছিল।

২. প্রশ্ন: ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসের কী ভূমিকা ছিল? অথবা, ‘গোরা’ উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথের যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার পরিচয় পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘গোরা’ (১৯১০) উপন্যাসটি শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ নয়, এটি ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশেও এক গুরুত্বপূর্ণ ও ভিন্নধর্মী দৃষ্টিকোণ তুলে ধরে।

  • প্রকৃত ভারতের সন্ধান: উপন্যাসের নায়ক গোরা, যিনি নিজেকে কট্টর হিন্দু ও ভারতীয় বলে মনে করতেন, বিভিন্ন গ্রামের সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসে ভারতবর্ষের প্রকৃত রূপ, তাদের সরলতা, কুসংস্কার এবং বিভেদ সম্পর্কে অবগত হন।
  • ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে: আইরিশ বংশোদ্ভূত জেনেও হিন্দু হিসেবে পালিত গোরা তার জন্মপরিচয় জানার পর উপলব্ধি করে যে, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ই মানুষের একমাত্র বা সবচেয়ে বড়ো পরিচয় নয়। সে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও আচারসর্বস্বতার ঊর্ধ্বে উঠে এক বৃহত্তর সত্যের সন্ধান পায়।
  • ভারতবর্ষীয় সত্তার উপলব্ধি: গোরা ঘোষণা করে, “আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কোনো সমাজের কোনো বিরোধ নেই। আজ ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত…”। এটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে এক অসাম্প্রদায়িক, মহামানবীয় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রকাশ করে।
  • ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সমালোচনা: গোরা একদিকে যেমন ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তেমনই অন্যদিকে সমাজের কুসংস্কার ও বিভেদের তীব্র সমালোচনা করে। রবীন্দ্রনাথ এর মাধ্যমে গঠনমূলক স্বদেশপ্রেমের ইঙ্গিত দেন।
  • দেশাত্মবোধের প্রকাশ: গোরার বিভিন্ন উক্তি, যেমন – “মা, তুমিই আমার মা”, “আমি ভারতীয়”, তৎকালীন পাঠকদের মনে গভীর দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে।

উপসংহার: ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উগ্র, হিন্দুত্ববাদী বা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে এক উদার, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক এবং গঠনমূলক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শ তুলে ধরেছেন, যা ভারতের বৈচিত্র্যময় সমাজ ও চিরন্তন ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।

৩. প্রশ্ন: ভারতীয় জাতীয়তাবোধের বিকাশে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির কী অবদান ছিল? অথবা, জাতীয়তাবাদের প্রসারে ‘ভারতমাতা’ চিত্রের গুরুত্ব আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে ‘লেখা’র পাশাপাশি ‘রেখা’ বা চিত্রকলাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এক্ষেত্রে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭১-১৯৫১) আঁকা ‘ভারতমাতা’ (১৯০৫) চিত্রটি এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি।

  • অঙ্কনের প্রেক্ষাপট: ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাল আবহে দেশবাসীকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে অবনীন্দ্রনাথ এই ছবিটি আঁকেন। ছবিটির পূর্বনাম ছিল ‘বঙ্গমাতা’, ভগিনী নিবেদিতা এর নামকরণ করেন ‘ভারতমাতা’।
  • স্বদেশিয়ানার প্রতীক: অবনীন্দ্রনাথ হিন্দুদের ধনদেবী লক্ষ্মীর অনুকরণে ভারতমাতাকে চতুর্ভুজা এবং গৈরিক বসন পরিহিতা এক শান্ত, স্নিগ্ধ তাপসীর রূপে অঙ্কন করেন। তাঁর চার হাতে ধরা বই (শিক্ষা), ধানের শিষ (অন্ন), সাদা কাপড় (বস্ত্র) এবং জপের মালা (দীক্ষা) তৎকালীন ভারতের মূল চাহিদা এবং ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এর মাধ্যমে শিল্পী স্বদেশি আদর্শকে তুলে ধরেন।
  • শান্তির বার্তা: ভারতমাতার হাতে কোনো অস্ত্র না দেখিয়ে অবনীন্দ্রনাথ সশস্ত্র বিপ্লবের পরিবর্তে স্বদেশি ভাবনার অহিংস দিকটিকেই তুলে ধরেছেন।
  • জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার: স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে এই ছবিটি পোস্টারে, পতাকায় ব্যবহার করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া হতো। এটি জাতীয়তাবাদের মতো একটি বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত করে তুলে দেশবাসীর মনে দেশকে ‘মা’ রূপে উপলব্ধি করতে এবং তাঁর সেবায় আত্মনিয়োগ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
  • ঐতিহাসিক গুরুত্ব: ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতির এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. প্রশ্ন: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা বিভিন্ন ব্যঙ্গচিত্রে কীভাবে ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা ফুটে উঠেছে? অথবা, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যঙ্গচিত্রকে কীভাবে ঔপনিবেশিক সমালোচনার হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন?

উত্তর: ভূমিকা: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮) ছিলেন বাংলা তথা ভারতের ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন শিল্পের পথিকৃৎ। তিনি তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিকে সমকালীন ঔপনিবেশিক সমাজ, তার অসংগতি ও ভণ্ডামির তীব্র সমালোচনার এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

  • ব্যঙ্গচিত্র সংকলন: তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলি ‘প্রবাসী’, ‘মডার্ন রিভিউ’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো এবং পরে ‘অদ্ভুত লোক’ (১৯১৫), ‘বিরূপ বজ্র’ (১৯১৭), ‘নয়া হুল্লোড়’ (১৯২১) নামে গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়।
  • সমালোচনার বিষয়বস্তু:
    • বাবু সংস্কৃতির ব্যঙ্গ: ব্রিটিশ শাসনকালে গজিয়ে ওঠা পাশ্চাত্য অনুরাগী, বিলাসী অথচ মেরুদণ্ডহীন ‘বাবু’ বা শিক্ষিত বাঙালি সমাজ তাঁর ব্যঙ্গচিত্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
    • পাশ্চাত্যানুরাগের সমালোচনা: পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ (যেমন পোশাক ও নৃত্যে) তাঁর চিত্রে বিদ্রুপের শিকার হয়েছে।
    • সামাজিক ও ধর্মীয় ভণ্ডামি: তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, জাতপাত (‘জাতাসুর’) এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভণ্ডামি (যেমন ‘খল ব্রাহ্মণ’) তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে остроумноভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
    • শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি ‘বিদ্যার কারখানা’ রূপে চিত্রিত করেছেন, যা ভারতীয়দের কেরানিতে পরিণত করে।
    • ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা: প্রত্যক্ষভাবে ব্রিটিশ শাসনের বর্বরতা ও নিপীড়নও তাঁর ব্যঙ্গচিত্রে স্থান পেয়েছে (যেমন ‘প্রচণ্ড মমতা’)।

উপসংহার: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অতুলনীয় দক্ষতা ও মৌলিক চিন্তাধারার মাধ্যমে ব্যঙ্গচিত্রকে নিছক হাস্যরসের পরিবর্তে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে পরিণত করেছিলেন। তাঁর চিত্রগুলি তৎকালীন বাঙালি সমাজকে আত্মবিশ্লেষণে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল।


📌 সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (২ নম্বর) 📌 (২-৩টি বাক্যে উত্তর দাও)

১. প্রশ্ন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ কী নামে প্রকাশিত হয়?

উত্তর: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত কৃত ‘The Abbey of Bliss’ নামে প্রকাশিত হয়।

২. প্রশ্ন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন?

উত্তর: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সন্ন্যাসী বিদ্রোহী ‘সন্তান দল’-এর প্রধান নেতা ছিলেন সত্যানন্দ।

৩. প্রশ্ন: কোন পটভূমিকায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি রচিত হয়?

উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অষ্টাদশ শতকের বাংলার ভয়াবহ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০) এবং সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের পটভূমিকায় ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) উপন্যাসটি রচনা করেন।

৪. প্রশ্ন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের কোন্ বাহিনী সীমাহীন আত্মবলিদানের জন্য প্রস্তুত ছিল?

উত্তর: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ‘সন্তান দল’ নামক সন্ন্যাসী বাহিনী দেশমাতার মুক্তির জন্য সীমাহীন আত্মবলিদান ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিল।

৫. প্রশ্ন: প্রথম কে, কী শিরোনামে ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটির ইংরেজি অনুবাদ করেন?

উত্তর: শ্রী অরবিন্দ ঘোষ (Aurobindo Ghose) প্রথম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে ‘Mother, I bow to thee!’ শিরোনামে ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতটির ইংরেজি অনুবাদ করেন।

৬. প্রশ্ন: স্বাধীন ভারতের সরকার কোন্ গানটিকে ভারতের জাতীয় স্তোত্রের মর্যাদা দেয়?

উত্তর: স্বাধীন ভারতের সরকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে ভারতের জাতীয় স্তোত্রের (National Song) মর্যাদা দেয়।

৭. প্রশ্ন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্রের নাম লেখো।

উত্তর: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের দুটি প্রধান চরিত্র হল:

  • সত্যানন্দ (বিদ্রোহী নেতা)
  • মহেন্দ্র (গৃহত্যাগী যুবক)

৮. প্রশ্ন: উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটির কীরূপ অবদান ছিল?

উত্তর: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বিশেষ অবদান রাখে:

  • এটি স্বদেশকে ‘মা’ রূপে কল্পনা করে দেশপ্রেমকে ধর্মীয় স্তরে উন্নীত করে।
  • এর ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়।
  • সন্তান দলের আত্মত্যাগ বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে।

৯. প্রশ্ন: বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম লেখো।

উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল: ‘আনন্দমঠ’, ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘দেবী চৌধুরানী’, ‘সীতারাম’, ‘রাজসিংহ’, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ ইত্যাদি।

১০. প্রশ্ন: ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি কে রচনা করেন? এটি কবে প্রকাশিত হয়?

উত্তর:

  • রচনা: ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থটি রচনা করেন স্বামী বিবেকানন্দ।
  • প্রকাশ: এটি প্রথম ১৮৯৯ সাল থেকে ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

১১. প্রশ্ন: স্বামী বিবেকানন্দ কীভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, ভারতীয় সমাজে শূদ্রের জাগরণ ঘটবেই?

উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ ‘বর্তমান ভারত’ গ্রন্থে ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, সমাজে ক্ষমতার পালাবদল চক্রাকারে ঘটে। বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ, পরে ক্ষত্রিয় এবং ব্রিটিশ যুগে বৈশ্যদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, এরপর অনিবার্যভাবেই ভারতে তথাকথিত নিম্নবর্গীয় শূদ্র বা শ্রমজীবী মানুষের জাগরণ ঘটবে এবং সমাজে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

১২. প্রশ্ন: ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক গোরা পল্লিগ্রামের সমাজের কী ধরনের ত্রুটি লক্ষ করেছে?

উত্তর: ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক গোরা পল্লিগ্রাম পরিদর্শনের সময় সমাজের কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করে:

  • যথাযথ শিক্ষার অভাবে মানুষের মধ্যে কুসংস্কারাচ্ছন্নতা।
  • প্রয়োজনে বা বিপদে একে অপরকে সাহায্য বা ভরসা না দিয়ে সামাজিক আচার-বিচার নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করা।

১৩. প্রশ্ন: ভারতের ধর্মীয় বিষয়ে গোরার কী উপলব্ধি হয়?

উত্তর: প্রাথমিকভাবে গোরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও আচারনিষ্ঠ হলেও, পরে নিজের জন্মরহস্য জানার পর তার উপলব্ধি হয় যে, ধর্ম বা জাতি মানুষের একমাত্র বা শ্রেষ্ঠ পরিচয় নয়। সে সংকীর্ণ ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে এক বৃহত্তর মানবধর্ম ও ‘ভারতবর্ষীয়’ সত্তার সন্ধান পায়।

১৪. প্রশ্ন: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রের নাম লেখো।

উত্তর: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হল: ‘ভারতমাতা’, ‘বঙ্গমাতা’ (ভারতমাতার পূর্বনাম), ‘সাজাহানের মৃত্যু’, ‘নির্বাসিত যক্ষ’, ‘গণেশ জননী’, ‘শেষযাত্রা’ ইত্যাদি।

১৫. প্রশ্ন: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আঁকা ‘ভারতমাতা’র হাতে থাকা দ্রব্যগুলির দ্বারা কীভাবে স্বদেশিয়ানা ও জাতীয়তাবাদী অনুভূতি প্রচারের চেষ্টা করেছেন?

উত্তর: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভারতমাতা’র চার হাতে বেদ (শিক্ষা), ধানের শিষ (অন্ন), জপের মালা (দীক্ষা) ও শ্বেতবস্ত্র (বস্ত্র) দেখিয়েছেন। এই দ্রব্যগুলি ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রতীক। এর মাধ্যমে তিনি বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের যুগে ভারতীয়দের মধ্যে আত্মনির্ভরতা, স্বদেশিয়ানা ও জাতীয়তাবাদী অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

১৬. প্রশ্ন: বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ভারতমাতা’ ও অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’র মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ভারতমাতাকে মূলত একটি বিপন্ন, শৃঙ্খলিতা দেশমাতৃকা (‘মা যা হয়েছেন’ – কালীরূপ) রূপে দেখিয়েছেন, যাকে সন্তানদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্ত করতে হবে। অন্যদিকে, অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ হলেন একজন শান্ত, স্নিগ্ধ, দেবীপ্রতিমা (লক্ষ্মীর আদলে), যিনি সন্তানদের শিক্ষা-অন্ন-বস্ত্র-দীক্ষা দিয়ে আশীর্বাদ করছেন; তিনি সমৃদ্ধ অথচ করুণাময়ী। বঙ্কিমের ভারতমাতা বিপ্লবের ডাক দেয়, অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা স্বদেশি ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক।

১৭. প্রশ্ন: উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির কীরূপ ভূমিকা ছিল?

উত্তর: ‘ভারতমাতা’ চিত্রটি উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে:

  • এটি জাতীয়তাবাদের মতো বিমূর্ত ধারণাকে একটি সুস্পষ্ট দৃশ্যরূপ দেয়।
  • স্বদেশি আন্দোলনের সময় এটি মিছিল ও শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে মানুষকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।
  • দেশকে ‘মা’ রূপে কল্পনা করে তাঁর সেবায় আত্মনিয়োগের প্রেরণা জোগায়।

১৮. প্রশ্ন: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অঙ্কিত ‘ভারতমাতা’ চিত্রটির বর্ণনা দাও।

উত্তর: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘ভারতমাতা’ (১৯০৫) চিত্রটিতে গৈরিক বসন পরিহিতা, চতুর্ভুজা এক দেবীকে শান্ত, স্নিগ্ধ তাপসীর রূপে দেখা যায়। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে যথাক্রমে:

  • বেদ: শিক্ষার প্রতীক।
  • ধানের শিষ: অন্নের বা খাদ্যের প্রতীক।
  • জপের মালা: দীক্ষার বা আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
  • শ্বেতবস্ত্র: বস্ত্রের বা আচ্ছাদনের প্রতীক। এই চিত্রটি নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

১৯. প্রশ্ন: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের জনক’ বলা হয় কেন?

উত্তর: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম বাঙালি শিল্পী যিনি ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুনকে তৎকালীন সমাজের অসঙ্গতি, ভণ্ডামি এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সমালোচনার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর পূর্বে অন্য কেউ ব্যঙ্গচিত্রকে এতটা শৈল্পিক উৎকর্ষ ও সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতার সাথে ব্যবহার করেননি। তাই তাঁকে ‘বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের জনক’ বলা হয়।

২০. প্রশ্ন: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কয়েকটি ব্যঙ্গচিত্রের নাম উল্লেখ করো।

উত্তর: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র হল: ‘অদ্ভুত লোক’, ‘বিরূপ বজ্র’ ও ‘নয়া হুল্লোড়’ নামক সংকলনের অন্তর্গত ‘জাতাসুর’, ‘খল ব্রাহ্মণ’, ‘বিদ্যার কারখানা’, ‘বাকযন্ত্র’, ‘পরভূতের কাকলি’, ‘প্রচণ্ড মমতা’ ইত্যাদি।

২১. প্রশ্ন: ব্যঙ্গচিত্র কেন আঁকা হয়?

উত্তর: ব্যঙ্গচিত্র আঁকার প্রধান কারণগুলি হল:

  • সমকালীন সমাজ, রাজনীতি বা সংস্কৃতির কোনো ত্রুটি, অসংগতি বা ভণ্ডামিকে হাস্যকর বা বিদ্রুপাত্মকভাবে তুলে ধরা।
  • প্রচলিত কোনো কুপ্রথা বা অন্যায় সম্পর্কে মানুষকে সহজভাবে অবহিত ও সচেতন করা।
  • কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয়কে সাধারণ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও সহজে বোধগম্য করে তোলা।
  • নিছক হাস্যরস ও আনন্দ পরিবেশন করা, যার মাধ্যমে শিক্ষাও দেওয়া যায়।

২২. প্রশ্ন: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা বিভিন্ন চিত্রে ব্যঙ্গ করা হয়েছে এমন কয়েকটি বিষয়ের উদাহরণ দাও।

উত্তর: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রে যেসব বিষয় ব্যঙ্গের শিকার হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ:

  • পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য ‘বাবু’ শ্রেণির চালচলন ও কৃত্রিমতা।
  • উচ্চবিত্ত সমাজের অন্তঃসারশূন্যতা ও ভণ্ডামি।
  • ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অধার্মিক ব্রাহ্মণদের আচরণ (‘খল ব্রাহ্মণ’)।
  • ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি (‘বিদ্যার কারখানা’)।
  • সমাজে প্রচলিত জাতপাত প্রথা (‘জাতাসুর’)।

২৩. প্রশ্ন: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা করেছিলেন? অথবা, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ব্যঙ্গচিত্রগুলিতে কীভাবে ঔপনিবেশিক সমাজের সমালোচনা করেছেন?

উত্তর: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে সরাসরি বা প্রতীকের সাহায্যে ঔপনিবেশিক সমাজের বিভিন্ন দিককে সমালোচনা করেছেন:

  • জাতিভেদ: ‘জাতাসুর’ চিত্রে তিনি ব্রাহ্মণ পুরোহিতের নীচে নিম্নবর্ণের নিষ্পেষিত হওয়ার দৃশ্য এঁকে জাতপাতের তীব্র সমালোচনা করেন।
  • শিক্ষাব্যবস্থা: ‘বিদ্যার কারখানা’ চিত্রে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ভারতীয়দের নিজস্বতা হরণ করে ব্রিটিশদের অনুকরণকারী কেরানিতে পরিণত করছে।
  • ‘বাবু’ সংস্কৃতি: পাশ্চাত্য অনুরাগী ‘বাবু’ শ্রেণির দ্বিচারিতা ও অন্তঃসারশূন্যতাকে তিনি বিভিন্ন কার্টুনে ব্যঙ্গ করেছেন।
  • ব্রিটিশ নিপীড়ন: ‘প্রচণ্ড মমতা’র মতো চিত্রে তিনি ব্রিটিশ শাসনের আপাত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার আড়ালে থাকা শোষণ ও নিপীড়নকে কটাক্ষ করেছেন।

কিছু অতিরিক্ত সম্ভাব্য প্রশ্ন ও উত্তর

২৪. প্রশ্ন: ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটির তাৎপর্য কী?

উত্তর: ‘বন্দেমাতরম্’ সংগীতটির তাৎপর্য অপরিসীম:

  • এটি দেশকে মাতৃরূপে বন্দনার মন্ত্র, যা দেশপ্রেমকে ধর্মীয় ভক্তির পর্যায়ে উন্নীত করে।
  • এটি পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জাতীয় মন্ত্র ও রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল।
  • এটি স্বাধীন ভারতে জাতীয় স্তোত্রের (National Song) মর্যাদা লাভ করেছে।

২৫. প্রশ্ন: স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’ কী এবং জাতীয়তাবাদ প্রসারে এর ভূমিকা কী?

উত্তর:

  • নব্য বেদান্ত: বিবেকানন্দ প্রাচীন অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনকে আধুনিক যুগের উপযোগী করে, কুসংস্কারমুক্ত ও মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেন, যা ‘নব্য বেদান্ত’ নামে পরিচিত। এর মূল কথা হল – ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।
  • ভূমিকা: এই দর্শন জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার ঊর্ধ্বে উঠে মানবসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরসেবার কথা বলে, যা ভারতীয়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, ঐক্য ও দেশসেবার প্রেরণা জুগিয়ে জাতীয়তাবাদ প্রসারে সহায়তা করে।

২৬. প্রশ্ন: অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত চিত্রকলারীতি বা স্কুলের নাম কী? এর দুটি বৈশিষ্ট্য লেখো।

উত্তর:

  • রীতির নাম: নব্যবঙ্গীয় চিত্ররীতি বা বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট।
  • বৈশিষ্ট্য:
    • পাশ্চাত্য প্রভাব ত্যাগ করে ভারতীয় ঐতিহ্য (যেমন – অজন্তা, মোগল, রাজপুত চিত্রকলা) ও প্রাচ্য কলাকৌশল (যেমন – জাপানি ওয়াশ টেকনিক) অনুসরণ।
    • ভারতীয় পুরাণ, ইতিহাস, লোককথা ও দৈনন্দিন জীবনকে ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন।

২৭. প্রশ্ন: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যঙ্গচিত্র ছাড়া আর কোন্ ধরনের চিত্রকলার জন্য পরিচিত ছিলেন?

উত্তর: গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যঙ্গচিত্র ছাড়াও ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী ছিলেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের রীতির মিশ্রণে নিজস্ব শৈলী তৈরি করেন। বিশেষত, তিনি কিউবিজম (Cubism) বা ঘনকবাদের ভারতীয় রূপকার হিসেবে পরিচিত। তাঁর আঁকা হিমালয়ের দৃশ্য, পুরীর মন্দির, লোকজীবনের ছবি এবং প্রতিকৃতিও বিখ্যাত।

📘 Topic A: ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ

আপনি কি সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা অধ্যায়ের প্রথম অংশ, ‘১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ’ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তরগুলি পড়েছেন? পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ওই অংশটিও অত্যন্ত জরুরি👉

📘 Topic B: সভা সমিতির যুগ — ভারতীয় রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষকাল

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের রাজনীতিতে যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল, তারই প্রেক্ষাপটে সভা-সমিতির গঠন ও তাদের কার্যকলাপ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্নোত্তর এখানে তুলে ধরা হয়েছে👉

📝 মক টেস্ট: চতুর্থ অধ্যায় – সঙ্ঘবদ্ধতার গোড়ার কথা

এই অধ্যায়ের উপর ভিত্তি করে বহুবিকল্প প্রশ্ন, অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন সহ মক টেস্টের পূর্ণ সংগ্রহ। মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অনন্য সহায়ক👉

Scroll to Top