📜 Madhyamik History Chapter 7 Question Answer: সপ্তম অধ্যায় | নারী, ছাত্র ও দলিত আন্দোলন

🚺 প্রথম ভাগ: বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ 🚺

Madhyamik History Chapter 7 Question Answer: এই অধ্যায়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে আমরা জানব কীভাবে বিশ শতকের ভারতে শুধুমাত্র প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিই নয়, বরং নারী সমাজ, ছাত্রসমাজ এবং দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলিও নিজেদের অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হয়েছিল। তাদের আন্দোলন, সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের কাহিনীগুলি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই পৃষ্ঠায় তুমি পাবে সেইসব আন্দোলনের গভীরে গিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের (সংক্ষিপ্ত, বিশ্লেষণধর্মী ও ব্যাখ্যামূলক) প্রশ্ন এবং তার বিস্তারিত, সহজবোধ্য উত্তর। এই প্রশ্নগুলি অনুশীলন করে অধ্যায়টি সম্পর্কে তোমার ধারণা যেমন স্পষ্ট হবে, তেমনই পরীক্ষার প্রস্তুতিও মজবুত হবে। চলো, শুরু করা যাক!

✏️ সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে দুজন উল্লেখযোগ্য নারী নেত্রীর নাম লেখো এবং তাদের একটি করে অবদান উল্লেখ করো।

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে দুজন উল্লেখযোগ্য নারী নেত্রী ছিলেন:

সরলাদেবী চৌধুরানি: তিনি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ স্থাপন করে স্বদেশি জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবস্থা করেন এবং যুবকদের শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতে বীরাষ্টমী ব্রত ও প্রতাপাদিত্য উৎসব চালু করেন।
খায়রুন্নেসা খাতুন: তিনি ‘নবনূর’ পত্রিকায় ‘স্বদেশানুরাগ’ নামে কবিতা লিখে মুসলিম নারীসমাজকে স্বদেশি আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন এবং স্বদেশি পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করেন।

২. অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।

উত্তর: অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল:

ব্যাপক অংশগ্রহণ: এই প্রথম সমাজের প্রায় সকল স্তরের নারীরা, এমনকি গ্রামের মহিলারাও, রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে ও আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়।
নির্দিষ্ট ভূমিকার বাইরে সক্রিয়তা: গান্ধিজি প্রাথমিকভাবে নারীদের বিদেশি পণ্য বয়কট ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইলেও, নারীরা আরও সক্রিয় ভূমিকা দাবি করে এবং পিকেটিং, অর্থ সংগ্রহ, চরকায় কাপড় বোনা এমনকি গ্রেফতার বরণ করার মতো কাজেও এগিয়ে আসে।

৩. ‘দীপালি সংঘ’ কে, কবে এবং কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেন?

উত্তর: লীলা নাগ (রায়) ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ‘দীপালি সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল:

মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদেরকে জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা।
লাঠিখেলা, অসিচালনা, শরীরচর্চার মাধ্যমে নারীদের আত্মবিশ্বাসী ও শক্তিশালী করে তোলা।
নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং তাদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কাজে উৎসাহিত করা।

৪. প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মরণীয় কেন?

উত্তর: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন কারণ:

তিনি মাস্টারদা সূর্য সেনের ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’-র একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন।
আক্রমণের পর পুলিশের হাতে ধরা না দিয়ে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন, যা তাঁকে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম সারির নারী শহিদ হিসেবে পরিচিত করে।

৫. ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।

উত্তর: ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’ ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের নারী বাহিনী। এটি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে গঠিত হয়। এই ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (পরে সেহগল)। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ১৫০০ নারী এই বাহিনীতে যোগ দিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, যা ছিল নারীশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

৬. আইন অমান্য আন্দোলনের সময়ে প্রতিষ্ঠিত দুটি নারী সংগঠনের নাম লেখো।

উত্তর: আইন অমান্য আন্দোলনের সময়ে প্রতিষ্ঠিত দুটি উল্লেখযোগ্য নারী সংগঠন হল:

নারী সত্যাগ্রহ সমিতি (কলকাতায় শান্তি দাশ ও ঊর্মিলা দেবীর উদ্যোগে ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত)।
মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ (লতিকা ঘোষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, সুভাষচন্দ্র বসুর মাতা প্রভাবতী দেবী এর সভাপতি ছিলেন)।

৭. ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দুজন উল্লেখযোগ্য নারীর নাম এবং তাঁদের কাজের ক্ষেত্র উল্লেখ করো।

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দুজন উল্লেখযোগ্য নারী হলেন:

অরুণা আসফ আলি: তিনি বোম্বাইতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং আন্দোলনের সময়ে আত্মগোপন করে বৈপ্লবিক কাজকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
ঊষা মেহতা: তিনি বোম্বাই থেকে গোপনে জাতীয় কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র ‘ভয়েস অফ ফ্রিডম’ পরিচালনা করতেন, যার মাধ্যমে আন্দোলনের খবর ও নির্দেশাবলী প্রচার করা হত।

৮. ‘গান্ধিবুড়ি’ নামে কে পরিচিত ছিলেন এবং কেন?

উত্তর: মাতঙ্গিনী হাজরা ‘গান্ধিবুড়ি’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় মেদিনীপুরের তমলুক থানা অভিযানে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ৭৩ বছর বয়সে তিনি পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের জন্যই তিনি এই নামে পরিচিত হন।

৯. ননীবালা দেবী কীভাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে সাহায্য করতেন?

উত্তর: ননীবালা দেবী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করতেন। তিনি পলাতক বিপ্লবীদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন, তাঁদের দেখাশোনা করতেন এবং তাঁদের গোপন খবর আদানপ্রদানে সহায়তা করতেন। বিপ্লবীদের কাছে তিনি ‘পিসিমা’ নামে পরিচিত ছিলেন এবং এই কাজের জন্য তাঁকে পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হতে হয়েছিল।

১০. বীণা দাস বিখ্যাত কেন?

উত্তর: বীণা দাস ছিলেন বাংলার একজন দুঃসাহসী বিপ্লবী। তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। যদিও তাঁর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তবুও এই অসম সাহসিকতার জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। এই ঘটনায় তাঁর নয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল।

📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. 💬 বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনে গান্ধিজির ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে, বিশেষত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমাত্রিক।

আহ্বান ও অনুপ্রেরণা: গান্ধিজি প্রথম জাতীয় স্তরের নেতা যিনি নারীদের ঘরের বাইরে এসে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-২২), আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-৩৪) এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে (১৯৪২) সমাজের বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নারী অংশগ্রহণ করে।
অহিংস পদ্ধতি: গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহের পদ্ধতি নারীদের জন্য আন্দোলনে যোগদান সহজ করে তুলেছিল। পিকেটিং, বিদেশি দ্রব্য বর্জন, চরকা কাটা, লবণ তৈরি, শোভাযাত্রা প্রভৃতি কর্মসূচিতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে অংশ নিতে পারত।
নারীশক্তির স্বীকৃতি: গান্ধিজি নারীশক্তিকে জাতীয় জাগরণের একটি অপরিহার্য অংশ বলে মনে করতেন। তিনি নারীদের আত্মশক্তি ও নৈতিক বলের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, নারীদের ত্যাগ ও সহনশীলতা স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল।
নির্দিষ্ট ভূমিকার সীমাবদ্ধতা ও অতিক্রম: যদিও গান্ধিজি প্রাথমিকভাবে নারীদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট ভূমিকা (যেমন – চরকা কাটা, বিদেশি দ্রব্য বয়কট) নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, কিন্তু নারীরা শীঘ্রই সেই গণ্ডি পেরিয়ে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, এমনকি কারাবরণেও দ্বিধা করেনি। বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী, সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ নারীরা তাঁর অনুপ্রেরণাতেই সামনের সারিতে এসেছিলেন।
সামাজিক সংস্কারের অভাব: তবে, গান্ধিজির নারী আন্দোলন মূলত রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন বা নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নটিকে ততটা গুরুত্ব দেননি, যতটা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণকে। তাঁর কাছে নারীর আদর্শ রূপ ছিল মূলত সেবিকা ও ত্যাগ স্বীকারকারিণীর। সুতরাং, গান্ধিজি একদিকে যেমন নারীদের জাতীয় আন্দোলনে টেনে এনে তাদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, তেমনই অন্যদিকে নারীর সামাজিক অধিকার ও মুক্তির প্রশ্নটি তাঁর ভাবনায় ততটা প্রাধান্য পায়নি।

২. 💬 আইন অমান্য আন্দোলনে বাংলার নারীদের অংশগ্রহণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর: মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া আইন অমান্য আন্দোলনে বাংলার নারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ।

সংগঠন ও নেতৃত্ব: আন্দোলনের শুরুতেই ১৯৩০ সালের ১৩ মার্চ কলকাতায় শান্তি দাশ ও ঊর্মিলা দেবীর উদ্যোগে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ গঠিত হয়। এই সমিতিতে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা, সজ্জন দেবীর মতো অবাঙালি মহিলারাও যোগ দেন। এ ছাড়া, ‘ছাত্রী সংঘ’ এবং ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’-এর সদস্যরাও পিকেটিং ও মিছিলে সক্রিয় ছিলেন।
বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ: বাংলার নারীরা লবণ আইন ভঙ্গ, বিদেশি বস্ত্র ও মদের দোকানের সামনে পিকেটিং, শোভাযাত্রা, সভা-সমিতি আয়োজন, নিষিদ্ধ পত্রিকা পাঠ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন প্রভৃতি কর্মসূচিতে নির্ভয়ে অংশ নেয়।
জেলাভিত্তিক বিস্তার: এই আন্দোলন শুধুমাত্র কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মেদিনীপুরের মাতঙ্গিনী হাজরা, কুমিল্লার লাবণ্যলতা চন্দ ও প্রভাবতী দেবী, ঢাকার আশালতা সেন, বাঁকুড়ার শান্তশীলা পালিত প্রমুখ নারীরা নিজ নিজ জেলায় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
মুসলিম মহিলাদের অংশগ্রহণ: এই আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম মহিলাও এগিয়ে এসেছিলেন। ময়মনসিংহের হালিমা খাতুন ও রাজিয়া খাতুন, গাইবান্ধার দৌলতুন্নেসা খাতুন, ২৪ পরগনার হোসেন আরা বেগম, বিক্রমপুরের ফুলবাহার বিবি প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শ্রীহট্টে জোবেদা খাতুনের নেতৃত্বে ‘শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সশস্ত্র বিপ্লবী ধারার প্রভাব: আইন অমান্য আন্দোলনের আবহে বাংলায় সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপও বৃদ্ধি পায় এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তের মতো নারীরা এই ধারায় যুক্ত হয়ে সাহসিকতার পরিচয় দেন।
ব্যাপকতা: পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলির তুলনায় আইন অমান্য আন্দোলনে বাংলার নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি ব্যাপক ও সংগঠিত। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের মহিলারাও রক্ষণশীলতার বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনে যোগ দেন। এই ব্যাপক অংশগ্রহণ বাংলার নারী সমাজে এক নতুন রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা করে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

৩. 💬 “বিশ শতকের নারী আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না” – এই উক্তিটি বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি সামাজিক কুপ্রথা, লিঙ্গবৈষম্য এবং শিক্ষার অধিকারের মতো বিষয়গুলিকেও স্পর্শ করেছিল। যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি, তবুও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নের জন্যও সচেষ্ট ছিল।

শিক্ষার প্রসার ও সচেতনতা: উনিশ শতকের সমাজসংস্কারকদের হাত ধরে যে নারীশিক্ষার সূচনা হয়েছিল, বিশ শতকে তার আরও প্রসার ঘটে। বেগম রোকেয়ার মতো ব্যক্তিত্বরা শিক্ষার মাধ্যমে নারীমুক্তির কথা বলেন। লীলা নাগের ‘দীপালি সংঘ’ নারীশিক্ষার প্রসারে বিদ্যালয় স্থাপন করে এবং ‘জয়শ্রী‘ পত্রিকার মাধ্যমে নারীজাতির সার্বিক উন্নয়নের কথা প্রচার করে।
সামাজিক অধিকারের প্রশ্ন: যদিও এই সময়ে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের ক্ষেত্রে খুব বড় অগ্রগতি হয়নি, তবুও নারীরা ধীরে ধীরে তাদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করে। বিভিন্ন মহিলা সংগঠন সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের মানোন্নয়নের জন্য আন্দোলন করে। তারা পুরুষের তৈরি করা সামাজিক বেড়াজাল মানতে চায়নি।
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার চেষ্টা: স্বদেশি আন্দোলনের সময় সরলাদেবী চৌধুরানির ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রতিষ্ঠা ছিল স্বদেশি পণ্য বিপণনের পাশাপাশি নারীদের অর্থনৈতিক কাজে উৎসাহিত করার একটি প্রচেষ্টা। বাসন্তী দেবীর ‘নারী কর্ম মন্দির’ বা আশালতা সেনের ‘শিল্পাশ্রম’ খদ্দর তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে নারীদের স্বনির্ভর করার উদ্যোগ নিয়েছিল।
সশস্ত্র বিপ্লবী ধারায় সামাজিক বিদ্রোহ: সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদানকারী নারীরা (যেমন প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত) শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যই লড়েননি, তাঁরা প্রচলিত সামাজিক ধারণাকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন যে নারীরা শুধুমাত্র ঘরের কাজেই সীমাবদ্ধ।
মহিলা সংগঠন: বিশ শতকে একাধিক মহিলা সংগঠন গড়ে ওঠে যারা নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনি অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে কাজ শুরু করে। যদিও এগুলির অধিকাংশই ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীদের দ্বারা পরিচালিত, তবুও এটি নারীচেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে একথাও ঠিক যে, এই সময়ের নারী আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নগুলি রাজনৈতিক স্বাধীনতার বৃহত্তর লক্ষ্যের অধীনে চলে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে নারীরা ধীরে ধীরে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

৪. 💬 বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে সরলাদেবী চৌধুরানির ভূমিকা আলোচনা করো।

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে যে সমস্ত নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সরলাদেবী চৌধুরানি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনি) ছিলেন অন্যতম। তাঁর কার্যাবলী শুধুমাত্র নারীসমাজকে নয়, বাংলার যুবসমাজকেও বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাঁর প্রধান অবদানগুলি হল:

লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রতিষ্ঠা: স্বদেশি দ্রব্য উৎপাদন ও তার ব্যবহারের প্রসারের লক্ষ্যে তিনি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ (আনুমানিক ১৯০৩-০৪ সাল, বঙ্গভঙ্গের সময় বিশেষভাবে সক্রিয়) নামে একটি বিপণন কেন্দ্র স্থাপন করেন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলার নারীদের দ্বারা উৎপাদিত হস্তশিল্প ও অন্যান্য স্বদেশি সামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা করেন। এটি স্বদেশি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি নারীদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পথও প্রশস্ত করে।
বীরাষ্টমী ব্রত ও প্রতাপাদিত্য উৎসব: বাংলার যুবসমাজকে শরীরচর্চা, দেশাত্মবোধ এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ (১৯০৩) প্রবর্তন করেন। এই উৎসবগুলিতে লাঠিখেলা, অসিচালনা, কুস্তি ইত্যাদির আয়োজন করে তিনি তরুণদের মধ্যে সাহস ও জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলেন।
ব্যায়াম সমিতি গঠন: যুবকদের শারীরিক ও মানসিক ভাবে শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি একাধিক ব্যায়াম সমিতি বা আখড়া গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নেন।
স্বদেশি প্রচারে সক্রিয়তা: তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ভাষণ এবং লেখনীর মাধ্যমে স্বদেশি ভাবধারা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নারীদের স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করতেন।
‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনা: ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনার (১৮৯৫-১৯০৭ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে) মাধ্যমেও তিনি জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও স্বদেশি ভাবনার প্রসারে সহায়তা করেন। সরলাদেবী চৌধুরানির এই বহুমুখী কার্যকলাপ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে এবং বাংলার নারী ও যুবসমাজের মধ্যে আত্মশক্তি ও স্বাদেশিকতার মন্ত্র জাগিয়ে তুলতে বিশেষ সাহায্য করেছিল। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে নারীরা শুধুমাত্র পরোক্ষ সমর্থক নয়, আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ও পরিচালকও হতে পারে।

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. 🏛️ বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করো। এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কী ছিল?

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক অধ্যায়। এই অংশগ্রহণের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য এবং সীমাবদ্ধতা নিচে আলোচনা করা হল: অংশগ্রহণের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য:

ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫) থেকে শুরু করে ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২) পর্যন্ত প্রতিটি প্রধান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেই নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত গান্ধিজির আহ্বানে অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীরা অভূতপূর্ব সংখ্যায় যোগ দেয়।
বিভিন্ন ধারায় অংশগ্রহণ: নারীরা শুধুমাত্র অহিংস আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনেও বাংলার নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরীর মতো বিপ্লবীরা সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন। আবার অনেকে বিপ্লবীদের আশ্রয়দান, খবর আদানপ্রদান, অস্ত্র লুকিয়ে রাখার মতো পরোক্ষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছেন (যেমন: দুকড়িবালা দেবী, ননীবালা দেবী)।
নেতৃত্বের বিকাশ: সময়ের সাথে সাথে নারীরা শুধুমাত্র অংশগ্রহণকারী হিসেবেই নয়, নেতৃত্বের ভূমিকাতেও উঠে এসেছেন। সরোজিনী নাইডু, বাসন্তী দেবী, ঊর্মিলা দেবী, নেলী সেনগুপ্ত, অরুণা আসফ আলি, সুচেতা কৃপালনী, মাতঙ্গিনী হাজরা, লীলা নাগ প্রমুখ নারীরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের পুরোভাগে থেকেছেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (সেহগল) ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’-এর নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সামাজিক বাধা অতিক্রম: তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার বহু বাধা অতিক্রম করে নারীরা এই আন্দোলনগুলিতে যোগ দিয়েছিল। পর্দা প্রথা, শিক্ষার অভাব, সামাজিক অনুশাসন – এ সবকিছু উপেক্ষা করে তাদের এই অংশগ্রহণ ছিল এক সামাজিক বিপ্লবেরও ইঙ্গিত।
বিভিন্ন স্তরের নারীদের অংশগ্রহণ: মূলত শহরকেন্দ্রিক, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের অংশগ্রহণ বেশি হলেও, কৃষক ও শ্রমিক পরিবারের নারীরাও বিভিন্ন আঞ্চলিক আন্দোলন এবং ক্ষেত্রবিশেষে জাতীয় আন্দোলনেও সামিল হয়েছে। আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
সংগঠন তৈরি: নারীরা নিজেদের দাবিদাওয়া ও আন্দোলনের জন্য বিভিন্ন সংগঠনও গড়ে তুলেছিল, যেমন – ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’, ‘দীপালি সংঘ’, ‘মহিলা রাষ্ট্রীয় সংঘ’ ইত্যাদি। আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা:
পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী আন্দোলন পুরুষ নেতাদের দ্বারাই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হত। জাতীয়তাবাদী নেতারা নারীশক্তিকে আন্দোলনে কাজে লাগাতে চাইলেও, তাদের মূলত সহযোগী ভূমিকা বা গান্ধিজির ভাষায় ‘ত্যাগ ও সেবার প্রতিমূর্তি’ হিসেবেই দেখা হত। নারীর নিজস্ব রাজনৈতিক বা সামাজিক মুক্তির প্রশ্নটি প্রায়শই গৌণ থেকেছে।
শ্রেণি ও বর্ণের বিভেদ: নারী আন্দোলনে মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত হিন্দু নারীদের প্রাধান্যই বেশি ছিল। দলিত বা প্রান্তিক সম্প্রদায়ের নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম ছিল, অথবা তাদের সংগ্রাম পৃথকভাবে বিকশিত হয়েছে। মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণও সবক্ষেত্রে সমান ছিল না, যদিও কিছু ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা যায়।
মূল লক্ষ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা: নারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের মুক্তি। ফলে, নারীর সামাজিক অধিকার, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ইত্যাদি বিষয়গুলি ততটা গুরুত্ব পায়নি।
প্রকৃত নারীমুক্তির অভাব: নারীশিক্ষার প্রসার ঘটলেও তার উদ্দেশ্য প্রকৃত অর্থে নারীমুক্তি বা সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল না। জাতীয়তাবাদী ভাবনায় নারীর স্থান মূলত গৃহের মধ্যেই নির্দিষ্ট ছিল। পরিশেষে বলা যায়, বিশ শতকের ভারতে নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। বহু বাধা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা নিজেদের যোগ্যতা ও সাহসিকতার প্রমাণ রেখেছে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে। এই অংশগ্রহণ পরবর্তীকালে ভারতে নারী অধিকার আন্দোলনের পথকেও প্রশস্ত করেছিল।

২. 🏛️ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আলোচনা করো। এই প্রসঙ্গে দীপালি সংঘ এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করো।

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী ধারাও অত্যন্ত সক্রিয় ছিল, এবং এই ধারায় নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও অনুপ্রেরণাদায়ক। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের সাধারণ ভূমিকা: নারীরা সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে দুভাবে অংশগ্রহণ করতেন:

পরোক্ষ সহায়তা: অনেকে সরাসরি আক্রমণে না গিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন, সংবাদ আদানপ্রদান করতেন, অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও লুকিয়ে রাখতেন এবং বিপ্লবীদের সেবাশুশ্রূষা করতেন। দুকড়িবালা দেবী (বিপ্লবীদের পিস্তল লুকিয়ে রাখার জন্য কারারুদ্ধ) এবং ননীবালা দেবী (বিপ্লবীদের ‘পিসিমা’ নামে পরিচিত, পলাতক বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতেন) এই ধরনের ভূমিকার উজ্জ্বল উদাহরণ।
প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ: বহু নারী সরাসরি বিপ্লবী দলে যোগ দিয়ে অস্ত্রচালনা, বোমা তৈরি, গুপ্তহত্যা এবং বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা শুধুমাত্র সহযোগী হিসেবে নয়, নেতৃত্বের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছেন। দীপালি সংঘের অবদান: বিপ্লবী লীলা নাগ (রায়) ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ‘দীপালি সংঘ’ নামে একটি নারী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল:
নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করা।
সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য নারীদের প্রস্তুত করা। এই লক্ষ্যে সংঘে লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, অসিচালনা ও শরীরচর্চার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।
নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো। দীপালি সংঘের উদ্যোগে ঢাকায় ১২টি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, ‘দীপালি স্কুল’, ‘নারী শিক্ষামন্দির’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯২৬ সালে লীলা নাগ ভারতের প্রথম ছাত্রী সংগঠন ‘দীপালি ছাত্রী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
‘জয়শ্রী‘ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করা হত (১৯৩১), যার মাধ্যমে নারীজাতির সার্বিক উন্নয়নের কথা বলা হত। এই সংঘ বহু বিপ্লবী নারীকে অনুপ্রাণিত ও সংগঠিত করেছিল, যাদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার অন্যতম। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের অবদান: প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছিলেন বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের এক অগ্নিশিখা।
ছাত্রী অবস্থাতেই তিনি বিপ্লবী ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন এবং ‘দীপালি সংঘ’ ও পরে ‘ছাত্রী সংঘের’ সদস্য হন।
কলকাতায় বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করার পর তিনি চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্য সেনের ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’-তে যোগ দেন। ‘ফুলতার‘ ছিল তাঁর ছদ্মনাম।
তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৮ এপ্রিল, ১৯৩০), জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ এবং ধলঘাটের সংঘর্ষে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর নিষ্ঠা ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে সূর্য সেন তাঁকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দেন।
আক্রমণ সফল হওয়ার পর নিরাপদে তাঁর সঙ্গীদের পশ্চাদপসরণের সুযোগ করে দিলেও, তিনি নিজে ধরা পড়ার আগে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর এই আত্মবলিদান তাঁকে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে দীপালি সংঘ নারীদের বিপ্লবী ধারায় সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁদের অবদান পরবর্তী প্রজন্মের বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল।

🧑‍🎓 দ্বিতীয় ভাগ: বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ 🧑‍🎓

✏️ সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে (১৯০৫) ছাত্ররা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা বিলিতি পণ্য বর্জন, পিকেটিং, স্বদেশি দ্রব্যের প্রচার, স্কুল-কলেজ ত্যাগ এবং বিভিন্ন প্রতিবাদী সভা-মিছিলে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।

২. কার্লাইল সার্কুলার কী ছিল?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেখে ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই আন্দোলন থেকে ছাত্রদের বিরত রাখার জন্য তৎকালীন বাংলার মুখ্য সচিব টমাস কার্লাইল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর একটি নির্দেশনামা জারি করেন, যা কার্লাইল সার্কুলার নামে পরিচিত। এই নির্দেশিকায় বলা হয়, যে সকল ছাত্র স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নেবে, তাদের সরকারি স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

৩. অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এর প্রধান উদ্যোক্তা কে ছিলেন?

উত্তর: কার্লাইল সার্কুলার এবং অন্যান্য দমনমূলক নির্দেশের প্রতিবাদে এবং বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষাদানের বিকল্প ব্যবস্থা করার জন্য অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (৪ নভেম্বর, ১৯০৫)। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রিপন কলেজের ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু।

৪. বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের দুজন বিখ্যাত বিপ্লবীর নাম লেখো যারা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

উত্তর: বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের দুজন বিখ্যাত বিপ্লবী যারা ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ ‘অলিন্দ যুদ্ধ’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা হলেন বিনয়কৃষ্ণ বসু এবং দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। (বাদল গুপ্তও এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ঘটনাস্থলেই আত্মহত্যা করেন)।

৫. মাস্টারদা সূর্য সেনের তৈরি বিপ্লবী দলটির নাম কী ছিল? তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক কার্যকলাপ উল্লেখ করো।

উত্তর: মাস্টারদা সূর্য সেনের তৈরি বিপ্লবী দলটির নাম ছিল ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’। তাঁর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক কার্যকলাপ হল ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এবং চট্টগ্রামে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা।

৬. আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের একটি উদাহরণ দাও।

উত্তর: আইন অমান্য আন্দোলনের সময় (১৯৩০-৩৪) ছাত্ররা স্কুল-কলেজ বর্জন করে, পিকেটিং-এ অংশ নেয় এবং নিষিদ্ধ রাজনৈতিক গ্রন্থ পাঠ করে। বিশেষত বিলিতি পণ্য ও বস্ত্রের দোকানের সামনে পিকেটিং এবং লবণ আইন ভঙ্গের কর্মসূচিতে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।

৭. ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কেমন ছিল?

উত্তর: ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল প্রধান প্রাণশক্তি। প্রধান নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিল, পিকেটিং, ধর্মঘট, স্কুল-কলেজ বর্জন এবং বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজের (যেমন – টেলিগ্রাফের তার কাটা, রেললাইন অবরোধ) মাধ্যমে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দেয়।

৮. রশিদ আলি দিবস কবে এবং কেন পালিত হয়েছিল?

উত্তর: ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি রশিদ আলি দিবস পালিত হয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকে ব্রিটিশ সরকার ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে, তার প্রতিবাদে এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে কলকাতার ছাত্রসমাজ, বিশেষত মুসলিম ছাত্র লিগ ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে এই দিবস পালিত হয় ও ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।

৯. অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের দুটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা উল্লেখ করো।

উত্তর: অসহযোগ আন্দোলনে (১৯২০-২২) ছাত্রদের দুটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হল:

হাজার হাজার ছাত্র সরকারি স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয় বা আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেয়।
তারা ‘তিলক স্বরাজ ফান্ডে’ অর্থ সংগ্রহে এবং স্বদেশি দ্রব্য, বিশেষত চরকা ও খদ্দরের প্রচারে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে।

১০. ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। এরপর তাঁদের সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের যে সশস্ত্র লড়াই হয়, সেটি ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. 💬 বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলন ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল:

ব্রিটিশ বিরোধিতা: এই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করা। তারা তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়ার চেয়ে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নকেই বেশি গুরুত্ব দিত।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিপূরক: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মতো প্রধান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলিতে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারা এই আন্দোলনগুলির বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এবং সেগুলিকে গণমুখী করে তুলেছে।
স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ: বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এমনকি স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার বা সরকারি শাস্তির ঝুঁকি নিয়েও তারা পিছু হটেনি।
সংগঠন প্রবণতা: আন্দোলনের প্রয়োজনে ছাত্ররা বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছে, যেমন – অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি, বা বিভিন্ন বিপ্লবী দলের যুব শাখা।
অহিংস ও বিপ্লবী উভয় ধারায় অংশগ্রহণ: গান্ধিজির আহ্বানে বহু ছাত্র অহিংস আন্দোলনে যোগ দিলেও, একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সশস্ত্র বিপ্লবী পথ বেছে নিয়েছিল। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স প্রভৃতি দলে বহু ছাত্র ও যুবক সক্রিয় ছিল।
আদর্শবাদী ও ত্যাগী মনোভাব: বিশ শতকের ছাত্র আন্দোলন ছিল মূলত আদর্শবাদী এবং ত্যাগ ও দেশপ্রেমের দ্বারা অনুপ্রাণিত। হেমনদাস কালানি বা মাতঙ্গিনী হাজরার মতো (যদিও তিনি ছাত্রী ছিলেন না, তবে যুবসমাজের কাছে প্রেরণা ছিলেন) আত্মত্যাগের উদাহরণ ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করত।
নেতৃত্বের অভাব ও স্ব-নেতৃত্ব: অনেক সময়ই জাতীয় নেতারা গ্রেফতার হলে ছাত্ররাই আন্দোলনের নেতৃত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে, বিশেষত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় এটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই বিশ শতকের ভারতের ছাত্র আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল স্থান অধিকার করে আছে।

২. 💬 ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ আগস্ট শুরু হওয়া ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে এক স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ, এবং এই বিদ্রোহে ছাত্রসমাজ অগ্রণী ও নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল।

নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ: আন্দোলনের শুরুতেই গান্ধিজি সহ কংগ্রেসের প্রথম সারির সমস্ত নেতা গ্রেফতার হলে দেশ কার্যত নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ছাত্ররাই বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেয়।
আন্দোলনের প্রসার: ছাত্ররা স্কুল-কলেজ বর্জন করে, ধর্মঘট পালন করে এবং গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের বার্তা সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেয়। বিহারের পাটনায় সচিবালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ছাত্ররা পুলিশের গুলির সম্মুখীন হয়। বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও এলাহहाबाद বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাশকতামূলক কাজে (টেলিগ্রাফ-টেলিফোন লাইন কাটা, রেল অবরোধ) যুক্ত হয়ে পড়ে এবং গ্রামীণ মানুষকে সংগঠিত করে।
সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ: ছাত্ররা নির্ভীকভাবে মিছিল, পিকেটিং, সরকারি সম্পত্তি দখল এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক ধ্বংস করার মতো কাজে লিপ্ত হয়। ওড়িশার বালেশ্বর, কটক, কোরাপুটে ছাত্ররাই ছিল আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি। সিন্ধুপ্রদেশে রেললাইন সরানোর দায়ে ১৯ বছর বয়সী হেমু কালানির ফাঁসি হয়, যা ছাত্রসমাজের আত্মত্যাগের এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
বাংলায় ছাত্র আন্দোলন: বাংলার কলকাতা, মেদিনীপুর, হুগলি সহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্ররা স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে মিছিল, মিটিং, পিকেটিং এবং পথ অবরোধের মাধ্যমে আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে। মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনেও ছাত্রদের ভূমিকা ছিল।
যুবশক্তির স্ফূরণ: ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে অনেক ঐতিহাসিক ‘ছাত্র ও যুবকদের আন্দোলন’ বলেও অভিহিত করেন, কারণ এই পর্বে তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, সাহস এবং সাংগঠনিক প্রয়াস ছিল অভূতপূর্ব। তারাই এই আন্দোলনকে গণবিদ্রোহের চরিত্র দিয়েছিল। সুতরাং, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কঠিন সময়ে, যখন জাতীয় নেতৃত্ব কারারুদ্ধ, তখন ছাত্রসমাজই নিজেদের জীবন বিপন্ন করে অসম সাহসিকতার সঙ্গে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

৩. 💬 অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি কেন এবং কীভাবে গঠিত হয়েছিল? এর কার্যকলাপ কী ছিল?

উত্তর: অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি ছিল বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রসমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী সংগঠন।

গঠনের প্রেক্ষাপট: ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে যখন বাংলার ছাত্রসমাজ স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনে ব্যাপকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন ব্রিটিশ সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়ে। ছাত্র আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন বাংলার মুখ্য সচিব আর. ডব্লিউ. কার্লাইল একটি দমনমূলক নির্দেশ বা সার্কুলার জারি করেন (১০ অক্টোবর, ১৯০৫), যা কার্লাইল সার্কুলার নামে পরিচিত। এই সার্কুলারে বলা হয়, যে সকল ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেবে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং প্রয়োজনে স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকেও ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, ব্যর্থতায় তাদের সরকারি অনুদান বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হয়। এর পরপরই লিয়ন সার্কুলার ও পেডলার সার্কুলার জারি করা হয়।
প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব: এই দমনমূলক কার্লাইল সার্কুলারের প্রতিবাদে এবং স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের স্বার্থরক্ষার জন্য ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ নভেম্বর কলকাতার রিপন কলেজের (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর উদ্যোগে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠিত হয়। এই সোসাইটির সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত ব্রাহ্মনেতা ও ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র এবং সম্পাদক ছিলেন শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু।
উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ: অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপ ছিল:
- কার্লাইল সার্কুলার ও অন্যান্য দমনমূলক নির্দেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো।
- স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য যে সকল ছাত্র স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হবে বা শাস্তি পাবে, তাদের শিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করা। এই লক্ষ্যে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এটি সহায়তা করে।
- ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করা।
- দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশি আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করা।
- বিদেশি পণ্যের দোকানের সামনে পিকেটিং সংগঠিত করা।
- সোসাইটির সদস্যরা অসুস্থ ও দুর্গত আন্দোলনকারীদের সেবা করত। অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি শুধুমাত্র একটি প্রতিবাদী সংগঠন ছিল না, এটি ছিল স্বদেশি যুগে ছাত্র ঐক্যের প্রতীক এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণাশক্তি। এটি প্রমাণ করেছিল যে সরকারি দমননীতি ছাত্র আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারবে না।

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. 🏛️ বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো। এই প্রসঙ্গে ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ এবং মাস্টারদা সূর্য সেনের কার্যকলাপ বিশেষভাবে উল্লেখ করো।

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনও এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল, এবং এই ধারায় ছাত্র ও যুবসমাজ निर्णायक ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের সাহস, আত্মত্যাগ এবং আদর্শবাদ বিপ্লবী আন্দোলনকে নতুন উদ্দীপনা জুগিয়েছিল।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সাধারণ ভূমিকা:

আদর্শগত প্রেরণা: ছাত্র ও যুবসমাজ সহজেই জাতীয়তাবাদী ও বিপ্লবী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হত। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, বিবেকানন্দের স্বদেশপ্রেমের বাণী এবং সমসাময়িক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী (যেমন – আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম, রাশিয়ার নিহিলিস্ট আন্দোলন) তাদের মধ্যে বিপ্লবের আগুন জ্বেলেছিল।
গুপ্ত সমিতির মূল শক্তি: অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিগুলির মূল সদস্য ও কর্মী ছিল ছাত্র ও যুবকেরা। তারাই ছিল এই সংগঠনগুলির প্রাণশক্তি।
দুঃসাহসিক অভিযান: বোমা তৈরি, অস্ত্র সংগ্রহ, অত্যাচারী ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও তাদের সহযোগীদের হত্যা, রাজনৈতিক ডাকাতি, সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতো দুঃসাহসিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলি মূলত ছাত্র ও যুব বিপ্লবীরাই সম্পন্ন করত। ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশ, ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ বিপ্লবীরা ছাত্রাবস্থাতেই এই পথে এসেছিলেন।
প্রচার ও সংগঠন: বিপ্লবের বার্তা গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়া, নতুন সদস্য সংগ্রহ করা এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজেও ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা নিত।
নারী ছাত্রদের অংশগ্রহণ: পুরুষ ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রী ও তরুণীরাও এই সময়ে বিপ্লবী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় যোগ দিয়েছিল (যেমন – প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস প্রমুখ)।

বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বি.ভি.) দলের কার্যকলাপ: বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ছিল বাংলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন।

প্রতিষ্ঠা: এর সূচনা হয় ১৯২৮ সালে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনকালে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে। পরে হেমচন্দ্র ঘোষের (ঢাকার বিপ্লবী) প্রভাবে এটি একটি শক্তিশালী বিপ্লবী দলে পরিণত হয়।
লক্ষ্য ও পদ্ধতি: এই দলের লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করা। তারা ‘অপারেশন ফ্রিডম’-এর আওতায় অত্যাচারী ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যার পরিকল্পনা করে।
অলিন্দ যুদ্ধ: বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের তিনজন দুঃসাহসী তরুণ বিপ্লবী বিনয় বসু (মেডিকেল ছাত্র), বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ প্রবেশ করে কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। এরপর ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে তাদের যে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়, তা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধে বাদল গুপ্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন, বিনয় বসু পরে হাসপাতালে মারা যান এবং দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি হয়। এই ঘটনা ব্রিটিশ প্রশাসনকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
মেদিনীপুরে কার্যকলাপ: বি.ভি.-র মেদিনীপুর শাখার সদস্যরা পরপর তিনজন অত্যাচারী জেলাশাসককে (পেডি, ডগলাস, বার্জ) হত্যা করে বিপ্লবী কার্যকলাপে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

মাস্টারদা সূর্য সেন ও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন: সূর্য সেন (মাস্টারদা) ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের এক কিংবদন্তি নায়ক, এবং তাঁর কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ছাত্র ও যুবসমাজ।

ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি (I.R.A.) গঠন: তিনি চট্টগ্রামে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ নামে একটি সুসংগঠিত বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই ছিল ছাত্র ও যুবক (যেমন – গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, অনন্ত সিং, অম্বিকা চক্রবর্তী)।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৮ এপ্রিল, ১৯৩০): মাস্টারদার নেতৃত্বে তাঁর বিপ্লবী বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে চট্টগ্রামের পুলিশ অস্ত্রাগার ও সহকারী বাহিনীর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। তারা টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং চট্টগ্রামে কয়েকদিনের জন্য ব্রিটিশ শাসন অচল করে দিয়ে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করে।
জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ: অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপ্লবীরা জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নিলে ২২ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে তাদের এক অসম যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ১২ জন বিপ্লবী শহিদ হন, কিন্তু মাস্টারদা ও অন্যেরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
পরবর্তী কার্যকলাপ ও আত্মদান: এরপর সূর্য সেন আত্মগোপন করে বিপ্লবী কার্যকলাপ চালিয়ে যান। অবশেষে ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়। ছাত্র ও যুবসমাজের এই সক্রিয় অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।

২. 🏛️ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র আন্দোলনের বিবর্তন আলোচনা করো।

উত্তর: বিশ শতকের প্রথমার্ধে (১৯০৫-১৯৪৭) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ছাত্রসমাজ সক্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের অংশগ্রহণের প্রকৃতি ও তীব্রতা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে।

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১): প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ
- ভূমিকা: এই আন্দোলনেই বাংলার ছাত্রসমাজ প্রথম ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে সামিল হতে উৎসাহিত করেন।
- কার্যাবলী: ছাত্ররা বিলিতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পণ্য বয়কট, পিকেটিং, স্বদেশি দ্রব্যের প্রচার, জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদান প্রভৃতিতে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। কার্লাইল সার্কুলারের মতো দমনমূলক নির্দেশের প্রতিবাদে অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি গঠিত হয়, যার মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্ররা।
- গুরুত্ব: এই আন্দোলন ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং তাদের সংগঠিত প্রতিবাদের প্রথম অভিজ্ঞতা দেয়।
অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২): গান্ধিজির আহ্বানে দেশব্যাপী জাগরণ
- ভূমিকা: মহাত্মা গান্ধির আহ্বানে এই আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
- কার্যাবলী: হাজার হাজার ছাত্র সরকারি স্কুল-কলেজ বর্জন করে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে (যেমন – কাশী বিদ্যাপীঠ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, গুজরাট বিদ্যাপীঠ) যোগ দেয়। তারা বিদেশি বস্ত্র পোড়ানো, তিলক স্বরাজ ফান্ডে অর্থ সংগ্রহ, মাদক দোকানের সামনে পিকেটিং এবং চরকা ও খদ্দরের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- গুরুত্ব: এই আন্দোলন ছাত্রসমাজকে অহিংস প্রতিরোধের পথে চালিত করে এবং জাতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচির সঙ্গে তাদের নিবিড়ভাবে যুক্ত করে।
আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-১৯৩৪): প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ও পুলিশি নির্যাতন
- ভূমিকা: এই আন্দোলনেও ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয়, তবে তাদের উপর পুলিশি অত্যাচারের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়।
- কার্যাবলী: ছাত্ররা লবণ আইন ভঙ্গ, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক গ্রন্থপাঠ, স্কুল-কলেজের সামনে পিকেটিং, বিলিতি পণ্য বর্জন প্রভৃতি কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিল। অনেক ছাত্র কারাবরণ করে।
- গুরুত্ব: এই পর্বে ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা বৃদ্ধি পায়। তবে, গান্ধিজির আন্দোলন প্রত্যাহার এবং বিভিন্ন ধারার বিপ্লবী কার্যকলাপের প্রতি আকর্ষণও এই সময়ে কিছু ছাত্রের মধ্যে দেখা যায়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): নেতৃত্বের ভূমিকায় ছাত্রসমাজ
- ভূমিকা: এই আন্দোলনকে অনেক ক্ষেত্রে ‘ছাত্র ও যুব বিদ্রোহ’ বলা হয়। প্রথম সারির নেতারা গ্রেফতার হলে ছাত্ররাই বহু স্থানে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।
- কার্যাবলী: ছাত্ররা ধর্মঘট, স্কুল-কলেজ সম্পূর্ণ বর্জন, সরকারি দপ্তর ও সম্পত্তির উপর আক্রমণ, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন লাইন কাটা, রেললাইন অবরোধ, গোপন ইস্তেহার প্রচার, কংগ্রেস রেডিও পরিচালনা এবং গ্রামে গ্রামে গিয়ে গণজাগরণ সৃষ্টির মতো বৈপ্লবিক ও জঙ্গি কর্মসূচিতে লিপ্ত হয়। বিহারের পাটনায় সচিবালয়ে পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে ৭ জন ছাত্র শহিদ হয়। সিন্ধুপ্রদেশে হেমু কালানির ফাঁসি হয়।
- গুরুত্ব: এই আন্দোলনে ছাত্ররা অসাধারণ সাহস, সংগঠন ক্ষমতা ও আত্মত্যাগের পরিচয় দেয়। তারা প্রমাণ করে যে তারা শুধুমাত্র অনুগামী নয়, সংকটকালে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতেও সক্ষম।

সুতরাং, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রাথমিক অংশগ্রহণ থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সর্বাত্মক সংগ্রাম পর্যন্ত, ভারতের ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ অভিজ্ঞতায়, সাহসিকতায় এবং সাংগঠনিক দক্ষতায় বিকশিত হয়েছে, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

তৃতীয় ভাগ: বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ – চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

✏️ সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. দলিত কাদের বলা হত? গান্ধিজি তাঁদের কী নামে অভিহিত করেন?

উত্তর: ভারতীয় সমাজে অতি প্রাচীনকাল থেকে বর্ণভেদ প্রথার কারণে সর্বনিম্ন স্তরে থাকা এবং উচ্চবর্ণের দ্বারা অত্যাচারিত, শোষিত ও অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত জনগোষ্ঠীকে সাধারণত দলিত নামে অভিহিত করা হত। এদের মধ্যে পঞ্চম জাতি, চণ্ডাল, অতি শূদ্র প্রভৃতি বিভিন্ন গোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহাত্মা গান্ধি এই দলিতদের ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) আখ্যা দিয়েছিলেন।

২. ভারতে দলিত আন্দোলনের দুজন উল্লেখযোগ্য নেতার নাম লেখো।

উত্তর: ভারতে দলিত আন্দোলনের দুজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকর এবং মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে।

৩. জ্যোতিবা ফুলে দলিতদের উন্নয়নের জন্য কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন? তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম কী?

উত্তর: জ্যোতিবা ফুলে দলিত, বিশেষত শূদ্রদের ন্যায়ের জন্য এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ‘সত্যশোধক সমাজ’ (১৮৭৩) প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘গুলামগিরি’।

৪. ভাইকম সত্যাগ্রহ (১৯২৪) কোথায় এবং কেন হয়েছিল? এর নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?

উত্তর: ভাইকম সত্যাগ্রহ (১৯২৪) দক্ষিণ ভারতের ত্রিবাঙ্কুর (বর্তমান কেরালা) রাজ্যের ভাইকম নামক স্থানে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী রাস্তা দলিতদের ব্যবহারের অধিকার আদায়ের জন্য হয়েছিল। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এজাভা সম্প্রদায়ের সমাজসংস্কারক শ্রীনারায়ণ গুরু এবং তাঁর অনুগামীরা।

৫. পুনা চুক্তি (১৯৩২) কাদের মধ্যে এবং কেন স্বাক্ষরিত হয়েছিল?

উত্তর: পুনা চুক্তি (২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২) স্বাক্ষরিত হয়েছিল মহাত্মা গান্ধি এবং ড. বি. আর. আম্বেদকরের মধ্যে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতির মাধ্যমে হিন্দু সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে, তার প্রতিবাদে গান্ধিজি আমরণ অনশন শুরু করেন। গান্ধিজির জীবন সংশয় হলে, আম্বেদকর দলিতদের পৃথক নির্বাচনের দাবি ত্যাগ করে যৌথ নির্বাচনের নীতি মেনে নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

৬. ড. আম্বেদকর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুটি সংগঠনের নাম লেখো।

উত্তর: ড. বি. আর. আম্বেদকর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দুটি উল্লেখযোগ্য সংগঠন হল:

‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ (১৯২৪), বোম্বাই।
‘সারাভারত তপশিলি জাতি ফেডারেশন’ (১৯৪২) (All India Scheduled Castes Federation)। (এছাড়াও তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ (১৯৩৬) এবং ‘সারাভারত নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস’ (১৯৩০) প্রতিষ্ঠা করেন।)

৭. মাহার সত্যাগ্রহ (১৯২৭) কী ছিল?

উত্তর: ড. বি. আর. আম্বেদকরের নেতৃত্বে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের মাহার অঞ্চলে দলিত মাহার সম্প্রদায়ের মানুষদের পৌরসভার কূপ (জলাশয়) থেকে জল ব্যবহারের অধিকার আদায়ের জন্য যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করা হয়েছিল, তাই মাহার সত্যাগ্রহ নামে পরিচিত।

৮. বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নাম এবং তাঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠনের নাম লেখো।

উত্তর: বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন শ্রী গুরুচাঁদ ঠাকুর (শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র)। তাঁর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে নমঃশূদ্রদের আর্থসামাজিক উন্নতির লক্ষ্যে ‘নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতি’ গড়ে উঠেছিল।

৯. ‘মতুয়া’ কাদের বলা হয়? এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা কে?

উত্তর: বাংলার নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে এবং জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে এক নতুন ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচারের উদ্দেশ্যে শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর যে ভক্তিবাদী সংগঠন ও সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, তাই ‘মতুয়া’ নামে পরিচিত।

১০. আত্মসম্মান আন্দোলন কে এবং কেন শুরু করেন?

উত্তর: দক্ষিণ ভারতে, বিশেষত মাদ্রাজে, ব্রাহ্মণদের সামাজিক আধিপত্য এবং জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ই. ভি. রামস্বামী নাইকার (পেরiyar) ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মসম্মান আন্দোলন শুরু করেন।

📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. 💬 দলিত অধিকার বিষয়ে গান্ধিজি ও ড. আম্বেদকরের মধ্যেকার বিতর্কের মূল দিকগুলি আলোচনা করো।

উত্তর: দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধি এবং ড. ভীমরাও আম্বেদকর উভয়েই আন্দোলন করলেও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতির মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল, যা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এই বিতর্কের মূল দিকগুলি হল:

বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা:
- আম্বেদকর মনে করতেন যে, হিন্দু সমাজে প্রচলিত বর্ণভেদ প্রথাই হল দলিতদের দুর্দশার মূল কারণ এবং এই প্রথার ভিত্তি হল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু শাস্ত্র। তাই তিনি বর্ণভেদ প্রথার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ (Annihilation of Caste) দাবি করেছিলেন। তাঁর মতে, এই প্রথা বজায় রেখে দলিতদের উন্নতি সম্ভব নয়।
- অন্যদিকে, গান্ধিজি বর্ণাশ্রম বা বর্ণভেদ প্রথাকে ভারতীয় সমাজের একটি ভিত্তি হিসেবে দেখতেন এবং এর সম্পূর্ণ উচ্ছেদের পরিবর্তে এর সংস্কারের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি অস্পৃশ্যতাকে বর্ণাশ্রমের বিকৃতি এবং হিন্দুধর্মের ‘কলঙ্ক’ বলে মনে করতেন। তিনি ‘বৃক্ষ’ (বর্ণব্যবস্থা) বাঁচিয়ে ‘পরগাছা’ (অস্পৃশ্যতা) দূর করতে চেয়েছিলেন।
রাজনৈতিক অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব:
- আম্বেদকর দলিতদের জন্য আইনসভা ও সরকারি চাকরিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সংরক্ষিত আসনের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আধিপত্য থেকে মুক্ত না হলে দলিতদের প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। এই কারণেই তিনি ব্রিটিশ সরকারের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিকে সমর্থন করেছিলেন।
- গান্ধিজি দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, এটি হিন্দু সমাজকে আরও বিভক্ত করবে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করবে। তিনি দলিতদের হিন্দু সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতেন এবং যৌথ নির্বাচনের অধীনে আসন সংরক্ষণের পক্ষপাতী ছিলেন। এই মতপার্থক্যের জেরেই পুনা চুক্তি (১৯৩২) স্বাক্ষরিত হয়।
আন্দোলনের পদ্ধতি ও লক্ষ্য:
- আম্বেদকর দলিতদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য একটি আইনগত ও সাংবিধানিক লড়াইয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি দলিতদের সংগঠিত করে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং আত্মমর্যাদা বোধ জাগানোর চেষ্টা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দলিতদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা।
- গান্ধিজি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হৃদয় পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ‘হরিজন’ পত্রিকা প্রকাশ, ‘হরিজন সেবক সংঘ’ প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তিগত প্রচারের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মাধ্যমে দলিতদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়া।

এই বিতর্ক সত্ত্বেও, গান্ধিজি ও আম্বেদকর উভয়ের প্রচেষ্টাই স্বাধীন ভারতে দলিতদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

২. 💬 বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের কারণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।

উত্তর: উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলায় দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে নমঃশূদ্রদের আন্দোলন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি নিচে আলোচনা করা হল:

নমঃশূদ্র আন্দোলনের কারণ:

সামাজিক অমর্যাদা ও অস্পৃশ্যতা: নমঃশূদ্ররা (পূর্বে চণ্ডাল নামে পরিচিত) বাংলার হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের দ্বারা চরমভাবে অবহেলিত ও অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হত। মন্দিরে প্রবেশ, জলাশয় ব্যবহার, শিক্ষা গ্রহণ এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে তাদের উপর নানা বিধিনিষেধ ছিল।
অর্থনৈতিক শোষণ ও দারিদ্র্য: নমঃশূদ্রদের অধিকাংশই ছিল ভূমিহীন কৃষক, ভাগচাষি, মৎস্যজীবী বা অন্যান্য নিম্ন আয়ের পেশার সঙ্গে যুক্ত। জমিদার, মহাজন এবং উচ্চবর্ণের ভূস্বামীদের দ্বারা তারা অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হত। দারিদ্র্য ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।
শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে বঞ্চনা: শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ থেকে তারা বহুলাংশে বঞ্চিত ছিল। ফলে, সরকারি চাকরি বা অন্যান্য সম্মানজনক পেশায় তাদের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত।
আত্মমর্যাদা বোধের জাগরণ: শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও তাঁর পুত্র শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে মতুয়া ধর্মের প্রসার নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগিয়ে তোলে। তাঁরা নিজেদের সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে।
রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: বিশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন নীতি (যেমন – ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, পৃথক নির্বাচনের ভাবনা) এবং অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাবলী নমঃশূদ্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

নমঃশূদ্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য:

ধর্মীয় সংস্কার ও সামাজিক ঐক্য: এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত মতুয়া আন্দোলন-কে কেন্দ্র করে, যা ছিল একটি ভক্তিবাদী ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। এটি নমঃশূদ্রদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলে।
শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ: গুরুচাঁদ ঠাকুর নমঃशূদ্রদের উন্নতির জন্য শিক্ষার উপর বিশেষভাবে জোর দেন। তাঁর উদ্যোগে নমঃশূদ্রদের জন্য বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নাম পরিবর্তন ও পরিচিতি প্রতিষ্ঠা: ‘চণ্ডাল’ নামের পরিবর্তে ‘নমঃশূদ্র’ নামটি সরকারিভাবে স্বীকৃতি লাভ করে (১৯১১ সালের আদমশুমারিতে), যা তাদের আত্মসম্মান বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
সংগঠন ও সম্মেলন: নমঃশূদ্ররা নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য বিভিন্ন সংগঠন (যেমন – নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, উন্নয়নী সভা, বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গীয় দলিত শ্রেণি সমিতি) গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন সম্মেলন আয়োজন করে।
রাজনৈতিক অধিকারের দাবি: ধীরে ধীরে এই আন্দোলন শুধুমাত্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক অধিকার (যেমন – আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব, সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ) আদায়ের আন্দোলনে পরিণত হয়। তারা পৃথক নির্বাচনের দাবিকেও সমর্থন করেছিল।
কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব: অনেক নমঃশূদ্র নেতা কংগ্রেসকে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সংগঠন বলে মনে করতেন এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল ধারা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন। তারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কিছু সুযোগ-সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য দলিত সম্প্রদায়ের এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের উদাহরণ।

৩. 💬 ড. বি. আর. আম্বেদকরকে ‘দলিত আন্দোলনের জনক’ বলা হয় কেন? দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান উল্লেখ করো।

উত্তর: ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকরকে ভারতের ‘দলিত আন্দোলনের জনক’ বা প্রধান স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয় কারণ তিনি দলিত সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আজীবন নিরলস সংগ্রাম করেছিলেন এবং তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ড. আম্বেদকরের অবদান:

সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ:
- আম্বেদকর নিজে মাহার সম্প্রদায়ের সন্তান হওয়ায় বাল্যকাল থেকেই অস্পৃশ্যতা ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে দলিতদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে।
- তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলায় মাহার সত্যাগ্রহ পরিচালনা করেন, যার মাধ্যমে দলিতদের সাধারণ জলাশয় থেকে জল ব্যবহারের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- ওই বছরই তিনি অস্পৃশ্যতাকে বৈধতা দানকারী প্রাচীন গ্রন্থ ‘মনুস্মৃতি’ প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান।
- ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার আদায়ের জন্য কলারাম মন্দির সত্যাগ্রহ শুরু করেন।
সংগঠন ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন:
- দলিতদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ে ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সর্বভারতীয় নিপীড়িত শ্রেণির কংগ্রেস’ (All India Depressed Classes Congress) এবং ১৯৩৬ সালে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ গঠন করেন।
- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সারাভারত তপশিলি জাতি ফেডারেশন’ (All India Scheduled Castes Federation) প্রতিষ্ঠা করে দলিতদের রাজনৈতিক ভাবে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন।
শিক্ষার প্রসার:
- আম্বেদকর গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার মাধ্যমেই দলিতদের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব। এই লক্ষ্যে তিনি ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ‘পিপলস এডুকেশন সোসাইটি’ স্থাপন করে দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার আদায়:
- তিনি ১৯৩০ ও ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে দলিতদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ও অন্যান্য রাজনৈতিক অধিকারের দাবি জানান।
- ব্রিটিশ সরকারের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিতে দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার স্বীকৃত হলে গান্ধিজি তার প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। এই পরিস্থিতিতে আম্বেদকর পুনা চুক্তি (১৯৩২) স্বাক্ষর করে দলিতদের জন্য আইনসভায় সংরক্ষিত আসন (সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলীর অধীনে) আদায় করেন, যা পৃথক নির্বাচনের চেয়েও বেশি ছিল।
- স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার খসড়া কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি অস্পৃশ্যতাকে আইনত নিষিদ্ধ করেন (সংবিধানের ১৭ নং ধারা) এবং দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন।

আম্বেদকরের এই বহুমুখী ও নিরলস সংগ্রামের ফলেই ভারতের দলিত শ্রেণি ধীরে ধীরে সামাজিক অবহেলা ও বঞ্চনার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। তাই তাঁকে ‘দলিত আন্দোলনের জনক’ বলা যথার্থ।

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Madhyamik History Chapter 7 Question Answer)

১. 🏛️ বিশ শতকের ভারতে দলিত আন্দোলনের প্রধান ধারাগুলি আলোচনা করো। এই প্রসঙ্গে জ্যোতিবা ফুলে, শ্রীনারায়ণ গুরু, ড. আম্বেদকর এবং গান্ধিজির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করো।

উত্তর: বিশ শতকের ভারতে দলিত আন্দোলন ছিল বহুধা বিস্তৃত এবং বিভিন্ন নেতা ও সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ লাভ এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়। এই আন্দোলনের প্রধান ধারা এবং উল্লিখিত ব্যক্তিদের ভূমিকা নিচে আলোচনা করা হল:

আন্দোলনের প্রধান ধারা ও বৈশিষ্ট্য:

সামাজিক সংস্কার ও ধর্মীয় প্রতিবাদ: অনেক আন্দোলনই শুরু হয়েছিল হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ গোঁড়ামি, বর্ণবৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। এর লক্ষ্য ছিল সামাজিক রীতিনীতির সংস্কার এবং দলিতদের ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা (যেমন – মন্দিরে প্রবেশ)।
শিক্ষা ও আত্মশক্তির বিকাশ: দলিত নেতারা শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁরা মনে করতেন, শিক্ষার মাধ্যমেই দলিতদের মধ্যে সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে এবং তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হবে।
অর্থনৈতিক মুক্তি: ভূমিহীনতা, বেগার শ্রম, স্বল্প মজুরি ইত্যাদি অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির দাবিও দলিত আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
রাজনৈতিক অধিকার ও প্রতিনিধিত্বের দাবি: আইনসভায় আসন সংরক্ষণ, সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ এবং পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি দলিত আন্দোলনকে এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা দিয়েছিল।
অব্রাহ্মণ আন্দোলন: দক্ষিণ ভারতে দলিত আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রেই অব্রাহ্মণ আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, যেখানে ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও ধর্মীয় আধিপত্যের বিরোধিতা করা হয়েছিল।

বিভিন্ন নেতা ও তাঁদের ভূমিকা:

জ্যোতিবা ফুলে (মহারাষ্ট্র):
- তাঁকে মহারাষ্ট্রে ‘সমাজ বিপ্লবের জনক’ বলা হয়। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সত্যশোধক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
- তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্ত করা, তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য খর্ব করা।
- তিনি নারীশিক্ষা এবং বিধবাবিবাহের সমর্থক ছিলেন।
- তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলামগিরি’-তে তিনি বর্ণভেদ প্রথার তীব্র সমালোচনা করেন। ‘দীনমিত্র’ ছিল তাঁর সমাজের মুখপত্র।
শ্রীনারায়ণ গুরু (কেরালা):
- তিনি ছিলেন দক্ষিণ ভারতের এজাভা সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা ও সমাজসংস্কারক।
- তিনি “এক জাতি, এক ধর্ম, এক ঈশ্বর” – এই আদর্শ প্রচার করেন এবং জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেন।
- তাঁর নেতৃত্বে দলিতদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ভাইকম সত্যাগ্রহ (১৯২৪) সংগঠিত হয়, যা ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।
- তিনি দলিতদের জন্য নিজস্ব মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
ড. বি. আর. আম্বেদকর (সর্বভারতীয়):
- তাঁকে ভারতের দলিত আন্দোলনের প্রধান স্থপতি ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
- তিনি দলিতদের সামাজিক ন্যায়ের জন্য মাহার সত্যাগ্রহ (১৯২৭), কলারাম মন্দির সত্যাগ্রহ (১৯৩০) পরিচালনা করেন এবং ‘মনুস্মৃতি’ দাহ করে বর্ণাশ্রমের বিরোধিতা করেন।
- তিনি ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ (১৯২৪), ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ (১৯৩৬), ‘সারাভারত তপশিলি জাতি ফেডারেশন’ (১৯৪২) ইত্যাদি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
- গোলটেবিল বৈঠকে তিনি দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের জোরালো দাবি জানান, যা পরে পুনা চুক্তির (১৯৩২) মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনে রূপান্তরিত হয়।
- স্বাধীন ভারতের সংবিধানের খসড়া কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি অস্পৃশ্যতা বিলোপ এবং দলিতদের জন্য বিভিন্ন সাংবিধানিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি বর্ণভেদ প্রথার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ চেয়েছিলেন।
মহাত্মা গান্ধি (সর্বভারতীয়):
- গান্ধিজি অস্পৃশ্যতাকে হিন্দুধর্মের ‘সবচেয়ে বড় কলঙ্ক’ বলে অভিহিত করেন এবং এর অবসানের জন্য দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করেন।
- তিনি দলিতদের ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) নামে অভিহিত করে তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন।
- ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সারাভারত অস্পৃশ্যতাবিরোধী সংঘ’ (পরে ‘হরিজন সেবক সংঘ’) প্রতিষ্ঠা করেন।
- ‘হরিজন’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন এবং দলিতদের মন্দির প্রবেশ, সাধারণ জলাশয় ব্যবহার ও শিক্ষার অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেন।
- তবে, গান্ধিজি বর্ণাশ্রম প্রথার উচ্ছেদের পরিবর্তে এর সংস্কার এবং হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকেই দলিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছিলেন, যা আম্বেদকরের অবস্থানের থেকে পৃথক ছিল। তিনি দলিতদের পৃথক নির্বাচনেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন।

এই প্রধান ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক নেতা ও সংগঠন দলিতদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যা ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে।

২. 🏛️ বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা করো। এই আন্দোলনে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: অবিভক্ত বাংলায়, বিশেষত পূর্ববঙ্গের জেলাগুলিতে, নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ছিল অন্যতম বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠী। দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক অবহেলা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার প্রতিক্রিয়ায় উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে যে শক্তিশালী আন্দোলন তারা গড়ে তোলে, তাই নমঃশূদ্র আন্দোলন নামে পরিচিত।

আন্দোলনের উদ্ভব ও কারণ:

সামাজিক অবস্থান: নমঃশূদ্ররা (পূর্বে ‘চণ্ডাল’ নামে পরিচিত) বর্ণহিন্দু সমাজে অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হত। শিক্ষা, মন্দিরে প্রবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ এবং উচ্চবর্ণের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তাদের উপর নানা বিধিনিষেধ ছিল। এই সামাজিক অমর্যাদা তাদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
অর্থনৈতিক দুর্দশা: তাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র কৃষক, ভাগচাষি, মৎস্যজীবী ও শ্রমিক। জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা তারা শোষিত হত এবং প্রায়শই ঋণের দায়ে জর্জরিত থাকত।
আত্মপরিচয়ের আকাঙ্ক্ষা: উনিশ শতকের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার সীমিত প্রভাব তাদের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগিয়ে তোলে। তারা নিজেদের হীন অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।

আন্দোলনের ক্রমবিকাশ:

প্রাথমিক পর্যায় (শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ও মতুয়া আন্দোলন):
- নমঃশূদ্র আন্দোলনের সূচনা হয় মূলত শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের (১৮১২-১৮৭৮) নেতৃত্বে মতুয়া ধর্ম আন্দোলন-কে কেন্দ্র করে। তিনি ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন।
- তিনি জাতিভেদ প্রথার ঊর্ধ্বে উঠে এক নতুন ভক্তিবাদী ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচার করেন, যেখানে কর্ম ও ভক্তির উপর জোর দেওয়া হয়। তাঁর প্রচারিত সহজ-সরল ধর্মমত নমঃশূদ্রদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
- মতুয়া সংঘ বা দল গঠনের মাধ্যমে তিনি নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মশক্তি, আত্মমর্যাদা ও সামাজিক ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। “হাতে কাম, মুখে নাম” ছিল তাঁর অন্যতম মূলমন্ত্র।
সংগঠিত রূপ ও প্রসার (শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর):
- শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৭) মতুয়া আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করেন এবং নমঃশূদ্র আন্দোলনকে এক সংগঠিত রূপ দেন।
- শিক্ষার প্রসার: তিনি উপলব্ধি করেন যে শিক্ষার মাধ্যমেই নমঃশূদ্রদের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব। তাঁর উদ্যোগে ও প্রেরণায় নমঃশূদ্রদের জন্য প্রায় চার হাজার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
- নাম পরিবর্তন ও সামাজিক মর্যাদা: তাঁর আন্দোলনের ফলেই ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারিতে ‘চণ্ডাল’ নামের পরিবর্তে ‘নমঃশূদ্র’ নামটি সরকারিভাবে গৃহীত হয়, যা ছিল এই সম্প্রদায়ের আত্মসম্মান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- সংগঠন প্রতিষ্ঠা: তিনি নমঃশূদ্রদের স্বার্থরক্ষার জন্য ‘নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ বা নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সভাপতিত্বে বিভিন্ন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (যেমন – ১৮৮১ সালে খুলনায় নিখিল বঙ্গ নমঃশূদ্র সম্মেলন)।
- রাজনৈতিক অধিকারের দাবি: গুরুচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের জন্য সরকারি চাকরি এবং আইনসভায় প্রতিনিধিত্বের দাবিও জানান। তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই বিষয়ে দরবার করেন।
বিশ শতকে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ:
- গুরুচাঁদ ঠাকুরের পরবর্তী সময়ে মুকুন্দবিহারী মল্লিক, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রমুখ নেতারা নমঃশূদ্র আন্দোলনকে রাজনৈতিক পথে চালিত করেন।
- তারা বিভিন্ন সংগঠন (যেমন – উন্নয়নী সভা, বেঙ্গল নমঃশূদ্র অ্যাসোসিয়েশন, নিখিলবঙ্গ নমঃশূদ্র সমিতি, বঙ্গীয় দলিত শ্রেণি সমিতি) গড়ে তোলেন।
- নমঃশূদ্ররা বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) সমর্থন করেছিল, কারণ তারা মনে করেছিল নতুন প্রদেশে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পাবে।
- তারা ড. আম্বেদকরের পৃথক নির্বাচনের দাবি এবং ব্রিটিশ সরকারের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতিকে সমর্থন করে। পুনা চুক্তির তারা সমালোচনাও করেছিল।
- ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে বাংলার আইনসভায় দলিতদের জন্য ২০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত হয়, যা ছিল তাদের আন্দোলনের অন্যতম সাফল্য।

সীমাবদ্ধতা: নমঃশূদ্র আন্দোলন নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা, সচেতনতা ও কিছু রাজনৈতিক অধিকার লাভে সফল হলেও, জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন মূল ধারার স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে তারা অনেকখানি বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সুযোগ আদায়ের নীতি অনেক সময় জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হয়েছে। দেশভাগের (১৯৪৭) পর নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে এলে তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে।

শ্রীহরিচাঁদ ও শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল বাংলার দলিত জাগরণের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল না, বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটিকেও সামনে এনেছিল।