
Madhyamik History Chapter 3 Question Answer in Bengali: এই অধ্যায়ের গভীর এবং বিস্তারিত আলোচনা আমরা এই ওয়েবপেজে তিনটি প্রধান উপ-পরিচ্ছেদের (sub-topics) মাধ্যমে তোমাদের সামনে তুলে ধরেছি, যাতে প্রতিটি বিষয় তোমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারো।
এই প্রধান তিনটি উপ-পরিচ্ছেদ হলো: ১. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও সেই বিষয়ে আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া ২. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, এবং বাংলায় ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন ৩. নীল বিদ্রোহ
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এই প্রতিটি উপ-পরিচ্ছেদের জন্য আমরা পরীক্ষার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতির লক্ষ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য অপরিহার্য তিন ধরনের প্রশ্নোত্তরের বিস্তারিত আয়োজন রেখেছি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য এই তিন ধরনের প্রশ্নের অনুশীলন করা অত্যাবশ্যক, যেগুলির নম্বর বিভাজন পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত নিম্নরূপ থাকে:
- সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন: মাধ্যমিক পরীক্ষায় এই ধরনের প্রতিটি প্রশ্নের জন্য ২ নম্বর বরাদ্দ থাকে।
- বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন: এই ধরনের প্রতিটি প্রশ্নের মান থাকে ৪ নম্বর।
- ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন: এই ধরনের প্রতিটি প্রশ্নের মান থাকে ৮ নম্বর।
আমাদের এই সুবিন্যস্ত এবং বিভাগ-ভিত্তিক আলোচনা তোমাদের তৃতীয় অধ্যায়টির প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আয়ত্ত করতে এবং মাধ্যমিক পরীক্ষায় আসা বিভিন্ন নম্বরের (২, ৪, এবং ৮) এই সকল জরুরি প্রশ্নগুলির অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসের সাথে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হতে সাহায্য করবে।
🌳 প্রথম ভাগ: ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও সেই বিষয়ে আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া 🌳

✏️ সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Short Answer Questions)
১. ব্রিটিশ সরকার কেন অরণ্য আইন প্রণয়ন করেছিল? দুটি প্রধান কারণ লেখো।
উত্তর: ব্রিটিশ সরকার একাধিক কারণে অরণ্য আইন প্রণয়ন করেছিল। দুটি প্রধান কারণ হল:
- রাজস্ব বৃদ্ধি: সরকার অরণ্য ও অরণ্যজাত সম্পদকে সরাসরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে তার বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল।
- শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার: রেলপথ নির্মাণ, জাহাজ তৈরি এবং অন্যান্য শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উন্নতমানের কাঠের জোগান নিশ্চিত করা এবং বনজ সম্পদের একচেটিয়া বাণিজ্য করাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।
২. ভারতে প্রথম কবে এবং কার উদ্যোগে ‘বন বিভাগ’ (Forest Department) স্থাপিত হয়েছিল?
উত্তর: ভারতে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড লরেন্সের শাসনকালে জার্মান বনবিশারদ ডায়েট্রিক ব্রান্ডিসের উদ্যোগে প্রথম ‘বন বিভাগ’ (Forest Department) স্থাপিত হয়েছিল। ডায়েট্রিক ব্রান্ডিস ছিলেন এর প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল।
৩. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনগুলির মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের নাম ও তাদের পাসের সাল উল্লেখ করো।
উত্তর: ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনগুলির মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হল:
- ভারতীয় অরণ্য আইন (Indian Forest Act): প্রথম আইনটি পাস হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পরবর্তীকালে এটি সংশোধিত হয়ে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে আরও কঠোরভাবে প্রণীত হয়।
- ফরেস্ট চার্টার (Forest Charter): এটি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে জারি করা হয়েছিল, যা অরণ্যের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল। (কিছু ক্ষেত্রে প্রথম অরণ্য আইন হিসেবেও এটিকে গণ্য করা হয়)।
৪. ‘সংরক্ষিত অরণ্য’ (Reserved Forest) এবং ‘সুরক্ষিত অরণ্য’ (Protected Forest) বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের অরণ্য আইন অনুসারে অরণ্যকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। তার মধ্যে দুটি হল:
- সংরক্ষিত অরণ্য: এই ধরনের অরণ্যের উপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ বা অরণ্য সম্পদ সংগ্রহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।
- সুরক্ষিত অরণ্য: এই অরণ্যগুলিতে কিছু নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সাধারণ মানুষ কাঠ সংগ্রহ ও পশুচারণ করতে পারত, তবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কাঠ কাটা নিষিদ্ধ ছিল।
৫. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের ফলে আদিবাসী সমাজের দুটি প্রধান সমস্যা কী হয়েছিল?
উত্তর: ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের ফলে আদিবাসী সমাজের দুটি প্রধান সমস্যা হয়েছিল:
- জীবিকা ও বাসস্থানের সংকট: অরণ্যের উপর তাদের চিরাচরিত অধিকার কেড়ে নেওয়ায় তাদের জীবন-জীবিকা (যেমন – শিকার, ফলমূল সংগ্রহ, পশুপালন, ঝুম চাষ) মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বহু আদিবাসী অরণ্য থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়।
- সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর আঘাত: অরণ্য ছিল আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। অরণ্য আইন তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং সামাজিক রীতিনীতির উপর হস্তক্ষেপ করে, যা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর আঘাত হানে।
৬. ‘ঝুম চাষ’ বা ‘পোড়ু চাষ’ কী? অরণ্য আইন কীভাবে এই প্রথাকে প্রভাবিত করে?
উত্তর: ‘ঝুম চাষ’ বা ‘পোড়ু চাষ’ হল এক ধরনের স্থানান্তর কৃষি পদ্ধতি, যেখানে আদিবাসী ও অন্যান্য অরণ্যচারী মানুষ অরণ্যের কিছু অংশ পুড়িয়ে পরিষ্কার করে সেখানে কিছুদিন চাষবাস করে এবং জমির উর্বরতা কমে গেলে অন্য স্থানে চলে যায়। ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন অরণ্যকে ‘সংরক্ষিত’ ও ‘সুরক্ষিত’ ঘোষণা করে এই প্রথাকে বহুলাংশে নিষিদ্ধ করে দেয়, কারণ সরকার মনে করত এটি অরণ্য সম্পদের ক্ষতি করে এবং রাজস্ব আদায়ে বাধা সৃষ্টি করে।
৭. কোল বিদ্রোহের (১৮৩১-৩২) দুটি প্রধান কারণ কী ছিল?
উত্তর: কোল বিদ্রোহের দুটি প্রধান কারণ ছিল:
- বহিরাগতদের শোষণ: ছোটনাগপুর অঞ্চলে বহিরাগত জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার (দিকু) এবং ব্রিটিশ কর্মচারীদের অনুপ্রবেশ ও তাদের দ্বারা কোলদের উপর নির্মম শোষণ ও অত্যাচার।
- ভূমি ও অরণ্যের অধিকার হরণ: নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা এবং অরণ্য আইনের ফলে কোলদের চিরাচরিত ভূমি ও অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যা তাদের জীবন-জীবিকাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়।
৮. সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৬) দুজন প্রধান নেতার নাম লেখো। এই বিদ্রোহের একটি প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহের দুজন প্রধান নেতা ছিলেন সিধু এবং কানু (তাঁদের আরও দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরবও ছিলেন)। এই বিদ্রোহের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল ভাগনাডিহি (বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অংশ)।
৯. মুন্ডা বিদ্রোহের (১৮৯৯-১৯০০) প্রধান নেতা কে ছিলেন? এই বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর: মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা। এই বিদ্রোহের (‘উলগুলান’ নামেও পরিচিত) প্রধান লক্ষ্য ছিল:
- বহিরাগত দিকু (জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার) ও ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘মুন্ডা রাজ’ বা স্বাধীন মুন্ডা শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
- মুন্ডাদের চিরাচরিত ভূমি ও অরণ্যের অধিকার পুনরুদ্ধার করা।
১০. ‘দিকু’ কাদের বলা হত? আদিবাসী বিদ্রোহগুলিতে তাদের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে (যেমন – ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা) বাইরে থেকে আসা অ-আদিবাসী মহাজন, ব্যবসায়ী, জমিদার, ঠিকাদার এবং ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারীদের আদিবাসীরা ‘দিকু’ নামে অভিহিত করত। আদিবাসী বিদ্রোহগুলিতে দিকুরা প্রধানত শোষক ও অত্যাচারী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। তারা আদিবাসীদের জমি কেড়ে নিত, চড়া সুদে ঋণ দিত, বেগার শ্রম খাটাত এবং তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ করত, যা আদিবাসী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল।
📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical Answer Questions)

১. 💬 ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন কীভাবে আদিবাসী জীবন ও জীবিকাকে প্রভাবিত করেছিল?
উত্তর: ব্রিটিশ সরকার ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনকালে একাধিক অরণ্য আইন (যেমন – ১৮৫৫ সালের ফরেস্ট চার্টার, ১৮৬৫ ও ১৮৭৮ সালের ভারতীয় অরণ্য আইন) প্রণয়ন করে। এই আইনগুলি ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার উপর সুদূরপ্রসারী ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল:
- চিরাচরিত অধিকার হরণ: আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে অরণ্যের উপর অবাধ অধিকার ভোগ করত। অরণ্য থেকে তারা খাদ্য (ফলমূল, পশুপাখি শিকার), জ্বালানি কাঠ, গৃহনির্মাণের সরঞ্জাম এবং ঔষধি লতাপাতা সংগ্রহ করত। অরণ্য ছিল তাদের জীবনধারণের প্রধান উৎস। নতুন অরণ্য আইন এই চিরাচরিত অধিকার কেড়ে নেয় এবং অরণ্যকে সরকারের সম্পত্তিতে পরিণত করে।
- জীবিকার সংকট: অরণ্যের উপর নির্ভরশীল আদিবাসীদের জীবিকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- ঝুম চাষ বা পোড়ু চাষ (স্থানান্তর কৃষি), যা অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রধান কৃষি পদ্ধতি ছিল, তা সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত অরণ্যে নিষিদ্ধ করা হয়।
- পশুচারণের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যার ফলে পশুপালনভিত্তিক জীবিকাও সংকটের মুখে পড়ে।
- অরণ্য থেকে কাঠ, মধু, মোম, লতাপাতা সংগ্রহের অধিকার সীমিত বা সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়ায় তাদের আয়ের পথ রুদ্ধ হয়।
- বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ: বহু অরণ্যকে ‘সংরক্ষিত’ ঘোষণা করার ফলে আদিবাসীদের তাদের ancestral ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, যা তাদের সামাজিক ও মানসিক জীবনে গভীর আঘাত হানে।
- বহিরাগতদের শোষণ বৃদ্ধি: অরণ্য আইন প্রয়োগের নামে বনকর্মী, পুলিশ, ঠিকাদার এবং মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণ বৃদ্ধি পায়। আদিবাসীরা প্রায়শই স্বল্প মজুরিতে বন বিভাগে কাজ করতে বা বেগার শ্রম দিতে বাধ্য হত।
- সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা: অরণ্য শুধুমাত্র আদিবাসীদের জীবিকার উৎসই ছিল না, তাদের সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। অরণ্য আইন তাদের এই সাংস্কৃতিক জীবনেও হস্তক্ষেপ করে, যা তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দেয়।
এই সমস্ত কারণে ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনগুলি আদিবাসী সমাজে এক গভীর সংকট তৈরি করে এবং তাদের অনেকেই ব্রিটিশ শাসন ও বহিরাগত শোষকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথে যেতে বাধ্য হয়।
২. 💬 কোল বিদ্রোহের (১৮৩১-৩২) কারণ ও গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর: উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে যে সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, তার মধ্যে ছোটনাগপুর অঞ্চলের কোল সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কোল বিদ্রোহের কারণ:
- ভূমি ও অরণ্যের অধিকার হরণ: ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা (যেমন – চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব) এবং অরণ্য আইনের ফলে কোলদের চিরাচরিত যৌথ মালিকানাধীন ভূমি (খুঁৎকাঠি প্রথা) ও অরণ্যের উপর তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। জমি চলে যায় বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ঠিকাদারদের হাতে।
- বহিরাগত ‘দিকু’দের শোষণ: ছোটনাগপুর অঞ্চলে বহিরাগত হিন্দু, মুসলিম ও শিখ মহাজন, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের (যাদের কোলরা ‘দিকু’ বা অত্যাচারী বিদেশি বলত) আগমন ঘটে। এরা চড়া সুদে ঋণ দিত, কোলদের জমিজমা আত্মসাৎ করত, তাদের বেগার শ্রম দিতে বাধ্য করত এবং তাদের নারীদের উপর অত্যাচার করত।
- অতিরিক্ত করের বোঝা: ব্রিটিশ সরকার ও স্থানীয় জমিদাররা কোলদের উপর বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত কর (যেমন – আবগারি শুল্ক, হাঁড়িয়া বা পচাই মদের উপর কর) চাপিয়ে দেয়, যা তাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব ছিল না।
- আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা: ব্রিটিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল জটিল এবং কোলদের কাছে অপরিচিত। এই ব্যবস্থা প্রায়শই শোষক মহাজন ও জমিদারদের পক্ষ নিত, ফলে কোলরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হত।
- সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে হস্তক্ষেপ: ব্রিটিশ শাসন ও বহিরাগতদের আগমনের ফলে কোলদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনেও নানাভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছিল, যা তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
কোল বিদ্রোহের গুরুত্ব:
- ব্যাপকতা ও তীব্রতা: কোল বিদ্রোহ শুধুমাত্র ছোটনাগপুরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ প্রভৃতি অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহীরা তীর, ধনুক, টাঙ্গি, তলোয়ার নিয়ে দিকু ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
- ঐক্যের প্রতীক: এই বিদ্রোহ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী (যেমন – মুন্ডা, হো, ওঁরাও) এবং কিছু অ-আদিবাসী দরিদ্র মানুষকেও ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
- ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপানো: কোল বিদ্রোহের তীব্রতা ব্রিটিশ সরকারকে সাময়িকভাবে হলেও বিচলিত করে তুলেছিল। সরকার নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করলেও, এটি প্রমাণ করে যে আদিবাসী সমাজ তাদের উপর হওয়া অন্যায়-অবিচার নীরবে সহ্য করবে না।
- প্রশাসনিক সংস্কারের সূচনা: বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ সরকার কোলদের অসন্তোষ কিছুটা প্রশমিত করার জন্য ছোটনাগপুর অঞ্চলে কিছু প্রশাসনিক সংস্কার করতে বাধ্য হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি (South-Western Frontier Agency) নামে একটি পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল গঠন করা হয় এবং কোলদের চিরাচরিত কিছু প্রথাকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয় (যদিও তা ছিল খুবই সীমিত)।
- পরবর্তী বিদ্রোহের অনুপ্রেরণা: কোল বিদ্রোহ পরবর্তীকালে অন্যান্য আদিবাসী বিদ্রোহ, যেমন সাঁওতাল বা মুন্ডা বিদ্রোহের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
কোল বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও, ঔপনিবেশিক শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের প্রতিরোধ সংগ্রামের ইতিহাসে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
৩. 💬 সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৬) প্রধান কারণগুলি কী ছিল? এই বিদ্রোহের ফলাফল ও তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে সংঘটিত অন্যতম শক্তিশালী ও ব্যাপক আদিবাসী গণ-অভ্যুত্থান। এটি ‘সাঁওতাল হুল’ (হুল কথার অর্থ বিদ্রোহ) নামেও পরিচিত।
সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান কারণ:
- ভূমি ও অরণ্যের অধিকার হারানো: সাঁওতালরা মূলত রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশে (বর্তমান ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী অঞ্চল) জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাস করত, এই অঞ্চল ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রাপ্তদেশ) নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ সরকার এই জমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এবং উচ্চহারে রাজস্ব চাপায়। নতুন অরণ্য আইনও তাদের অরণ্যের উপর চিরাচরিত অধিকার কেড়ে নেয়।
- মহাজনী শোষণ: বহিরাগত মহাজন ও ব্যবসায়ীরা (দিকু) চড়া সুদে সাঁওতালদের ঋণ দিত এবং ঋণের জালে জড়িয়ে তাদের জমিজমা ও ফসল আত্মসাৎ করত। তাদের বিভিন্ন ধরনের কারচুপি ও প্রতারণার শিকার হতে হত।
- সরকারি কর্মচারী ও পুলিশের অত্যাচার: ব্রিটিশ পুলিশ, বন বিভাগের কর্মচারী এবং অন্যান্য সরকারি আমলারা সাঁওতালদের উপর নানাভাবে অত্যাচার করত, ঘুষ নিত এবং তাদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করত।
- রেললাইন নির্মাণ ও ঠিকাদারদের শোষণ: রাজমহল পাহাড় অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের সময় বহু সাঁওতালকে স্বল্প মজুরিতে বা বেগার শ্রমে নিয়োগ করা হয়। রেলের ঠিকাদাররাও তাদের উপর শোষণ চালাত।
- বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা: ব্রিটিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল সাঁওতালদের কাছে অপরিচিত ও জটিল। আদালতে তারা প্রায়শই ন্যায়বিচার পেত না, কারণ মহাজন ও জমিদাররা সহজেই সাক্ষ্যপ্রমাণ নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারত।
- সামাজিক ও ধর্মীয় অবমাননা: সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথা ও ধর্মীয় বিশ্বাসকেও অনেক সময় অবজ্ঞা করা হত, যা তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে।
বিদ্রোহের ফলাফল ও তাৎপর্য:
- প্রাথমিক সাফল্য ও ব্যাপকতা: ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধু ও কানুর (এবং তাদের আরও দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব) নেতৃত্বে ভাগনাডিহির মাঠে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেয়। বিদ্রোহীরা মহাজন, জমিদার, পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের উপর আক্রমণ চালায় এবং ডাক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভাগলপুর ও মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
- নির্মম দমননীতি: ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীর-ধনুক ও আঞ্চলিক অস্ত্র বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। প্রায় ১৫ থেকে ২৫ হাজার সাঁওতাল এই বিদ্রোহে প্রাণ হারান। সিধু ও কানু সহ প্রধান নেতারা ধরা পড়েন ও তাদের ফাঁসি হয়।
- সাঁওতাল পরগনা গঠন: বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের অসন্তোষ কিছুটা প্রশমিত করার জন্য ১৮৫৫ সালেই (মতান্তরে ১৮৫৬) ভাগলপুর ও বীরভূম জেলার কিছু অংশ নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করে। এই অঞ্চলে সাঁওতালদের জন্য কিছু বিশেষ আইন (যেমন – সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইন) প্রণয়ন করা হয়, যাতে বহিরাগত মহাজনদের শোষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
- ঐক্য ও প্রতিরোধের প্রতীক: সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এটি ঔপনিবেশিক শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
- পরবর্তী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা: এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে ভারতের কৃষক ও আদিবাসী আন্দোলনগুলির জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory Answer Questions)
১. 🏛️ ঔপনিবেশিক ভারতে বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি কী ছিল? এই বিদ্রোহগুলির বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর: উনিশ শতকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসনে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য আদিবাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। এই বিদ্রোহগুলির পিছনে কিছু সাধারণ কারণ যেমন ছিল, তেমনই প্রতিটি বিদ্রোহের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বও ছিল।
আদিবাসী বিদ্রোহের প্রধান কারণসমূহ:
- ভূমি ও অরণ্যের অধিকার হরণ:
- ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা (যেমন: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি) আদিবাসীদের চিরাচরিত যৌথ ভূমি মালিকানা প্রথাকে (যেমন: মুন্ডাদের ‘খুঁৎকাঠি’ প্রথা) ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে।
- বিভিন্ন অরণ্য আইন (যেমন: ১৮৫৫, ১৮৬৫, ১৮৭৮ সালের আইন) প্রণয়ন করে সরকার অরণ্যের উপর আদিবাসীদের চিরাচরিত অধিকার (যেমন: শিকার, ফলমূল-কাঠ সংগ্রহ, পশুচারণ, ঝুম চাষ) কেড়ে নেয়। অরণ্যকে ‘সংরক্ষিত’ ও ‘সুরক্ষিত’ ঘোষণা করে তাদের জীবন-জীবিকাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়।
- বহিরাগত ‘দিকু’দের শোষণ:
- আদিবাসী অঞ্চলে বহিরাগত অ-আদিবাসী মহাজন, ব্যবসায়ী, জমিদার, ঠিকাদার এবং ব্রিটিশ সরকারি কর্মচারীদের (যাদের আদিবাসীরা সম্মিলিতভাবে ‘দিকু’ বা অত্যাচারী বিদেশি বলত) অনুপ্রবেশ ঘটে।
- এই দিকুরা চড়া সুদে ঋণ দিয়ে আদিবাসীদের ঋণের জালে জড়িয়ে তাদের জমিজমা আত্মসাৎ করত, তাদের স্বল্প মজুরিতে বা বেগার শ্রমে খাটাতে বাধ্য করত এবং বিভিন্নভাবে প্রতারণা ও শোষণ করত।
- অতিরিক্ত করের বোঝা ও নতুন মুদ্রার প্রচলন:
- ব্রিটিশ সরকার ও স্থানীয় জমিদাররা আদিবাসীদের উপর বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত কর (যেমন: আবগারি শুল্ক, লবণ কর, চৌকিদারি কর) চাপিয়ে দেয়।
- ঐতিহ্যবাহী বিনিময় প্রথার পরিবর্তে মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন আদিবাসীদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে, কারণ তাদের হাতে নগদ অর্থের অভাব ছিল।
- আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা:
- ব্রিটিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল জটিল, ব্যয়বহুল এবং আদিবাসীদের কাছে অপরিচিত। এই ব্যবস্থা প্রায়শই শোষক মহাজন ও জমিদারদের পক্ষ নিত, ফলে আদিবাসীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হত।
- সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে হস্তক্ষেপ:
- ব্রিটিশ শাসন ও বহিরাগতদের আগমনের ফলে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছিল। খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণের প্রচেষ্টাও অনেক আদিবাসী সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
বিদ্রোহগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
- অস্ত্রশস্ত্র: আদিবাসীরা মূলত তাদের চিরাচরিত অস্ত্রশস্ত্র (যেমন: তীর, ধনুক, টাঙ্গি, তলোয়ার, বল্লম) নিয়েই আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর মোকাবিলা করত।
- নেতৃত্ব: প্রতিটি বিদ্রোহেরই কিছু স্থানীয় নেতা ছিলেন, যারা তাদের সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রামের পথে চালিত করতেন। এই নেতারা অনেক সময় নিজেদের দৈব ক্ষমতার অধিকারী বলেও দাবি করতেন (যেমন: বিরসা মুন্ডা)।
- লক্ষ্য: বেশিরভাগ বিদ্রোহের প্রধান লক্ষ্য ছিল দিকু ও ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের চিরাচরিত অধিকার ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করা এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
- সংগঠনের অভাব: বিদ্রোহগুলি মূলত স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ থাকত এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বা সর্বভারতীয় কোনো সংগঠনের অভাব ছিল।
- নির্মম দমন: ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত কঠোর ও নির্মমভাবে এই বিদ্রোহগুলি দমন করত। হাজার হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করা হত বা কারারুদ্ধ করা হত।
গুরুত্ব ও ফলাফল:
- ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপানো: যদিও বেশিরভাগ আদিবাসী বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিল, তবুও এগুলি ঔপনিবেশিক শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এবং ব্রিটিশদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।
- প্রশাসনিক সংস্কার: কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহের তীব্রতা ব্রিটিশ সরকারকে আদিবাসী অঞ্চলগুলির জন্য কিছু প্রশাসনিক সংস্কার করতে বা বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য করেছিল (যেমন: সাঁওতাল পরগনা গঠন, ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস)।
- ঐক্য ও প্রতিরোধের প্রতীক: এই বিদ্রোহগুলি ঔপনিবেশিক শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে ভারতের সাধারণ মানুষের, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
- পরবর্তী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা: আদিবাসী বিদ্রোহগুলি পরবর্তীকালের কৃষক আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। এগুলি প্রমাণ করে যে, সংগঠিত প্রতিরোধ শোষক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা, নাগা, কুকি, ওঁরাও প্রভৃতি বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিদ্রোহগুলি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছে।
২. 🏛️ মুন্ডা বিদ্রোহের (উলগুলান) কারণ, গুরুত্ব ও বিরসা মুন্ডার ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর: উনিশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সংঘটিত আদিবাসী বিদ্রোহগুলির মধ্যে ছোটনাগপুর অঞ্চলের মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিদ্রোহ ‘উলগুলান’ (যার অর্থ ‘ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা’ বা ‘প্রবল বিক্ষোভ’) নামেও পরিচিত এবং এর প্রধান নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা।
মুন্ডা বিদ্রোহের কারণ:
- ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন ও ‘খুঁৎকাঠি’ প্রথার অবসান: মুন্ডারা ঐতিহ্যগতভাবে ‘খুঁৎকাঠি’ বা জমির যৌথ মালিকানা প্রথায় অভ্যস্ত ছিল। ব্রিটিশ সরকার নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এই প্রথা বাতিল করে দেয় এবং জমির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে মুন্ডাদের হাত থেকে জমি চলে যায় বহিরাগত জমিদার, মহাজন ও ঠিকাদারদের (দিকু) হাতে।
- অরণ্যের অধিকার হরণ: ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন মুন্ডাদের অরণ্যের উপর চিরাচরিত অধিকার (যেমন – কাঠ সংগ্রহ, পশুচারণ) কেড়ে নেয়, যা তাদের জীবন-জীবিকাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়।
- বেগার শ্রম ও ঋণের জাল: বহিরাগত দিকুরা মুন্ডাদের স্বল্প মজুরিতে বা বিনা পারিশ্রমিকে বেগার শ্রম (বেঠবেগারি) দিতে বাধ্য করত। চড়া সুদে ঋণ দিয়ে মহাজনরা তাদের ঋণের জালে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত করত।
- খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ: খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডাদের মধ্যে ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তরকরণের কাজ চালাত। যদিও তারা শিক্ষার প্রসারে কিছু ভূমিকা রেখেছিল, তবুও অনেক মুন্ডা মনে করত যে মিশনারিরা ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক এবং তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিরোধী।
- ব্রিটিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা: ব্রিটিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থা মুন্ডাদের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। আদালতগুলি প্রায়শই দিকুদের পক্ষ নিত।
- বিরসা মুন্ডার উত্থান ও নতুন ধর্মের প্রচার: এই শোষণ ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে বিরসা মুন্ডা নিজেকে ঈশ্বরের দূত (‘বিরসা ভগবান’) হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ‘বিরসাইত’ নামে এক নতুন একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রবর্তন করেন। তিনি মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করে শোষণমুক্ত ‘মুন্ডা রাজ’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
বিরসা মুন্ডার ভূমিকা:
- ঐক্যবদ্ধকরণ ও নেতৃত্ব: বিরসা মুন্ডা তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে মুন্ডা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও প্রতিরোধের স্পৃহা জাগিয়ে তোলেন।
- নতুন ধর্মের প্রবর্তন: তাঁর প্রচারিত ‘বিরসাইত’ ধর্ম মুন্ডাদের শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পথই দেখায়নি, এটি তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবেও সচেতন করে তুলেছিল। তিনি মূর্তিপূজা, কুসংস্কার এবং মাদক সেবনের বিরোধিতা করেন।
- ‘উলগুলান’-এর ডাক: বিরসা মুন্ডা ব্রিটিশ শাসন এবং দিকুদের শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক স্বাধীন ‘বিরসাইত রাজ্য’ বা ‘মুন্ডা রাজ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘উলগুলান’ বা প্রবল বিক্ষোভের ডাক দেন।
- সশস্ত্র সংগ্রাম: তাঁর নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহীরা তীর, ধনুক, টাঙ্গি প্রভৃতি पारंपरिक অস্ত্র নিয়ে দিকু ও ব্রিটিশ পুলিশ ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তারা থানা, সরকারি দপ্তর এবং জমিদার-মহাজনদের উপর আক্রমণ চালায়।
মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল:
- তীব্র প্রতিরোধ: মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক তীব্র ও আপোসহীন প্রতিরোধ। এটি প্রমাণ করে যে আদিবাসী সমাজ তাদের উপর হওয়া অন্যায় নীরবে মেনে নেবে না।
- ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন: বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করা হলেও, ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য এবং তাদের স্বার্থ কিছুটা রক্ষা করার জন্য ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন’ (Chotanagpur Tenancy Act) পাস করে। এই আইনের মাধ্যমে মুন্ডাদের চিরাচরিত ‘খুঁৎকাঠি’ প্রথাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বেগার শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
- আদিবাসী চেতনার উন্মেষ: বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ মুন্ডা তথা অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- বিরসা মুন্ডার কিংবদন্তি: বিরসা মুন্ডা আদিবাসী সমাজে ‘বিরসা ভগবান’ রূপে পূজিত হতে থাকেন এবং তাঁর সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। তিনি আজও ভারতের আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের এক মহান প্রতীক।
মুন্ডা বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের দ্বারা কঠোরভাবে দমিত হলেও, এটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
🕌 দ্বিতীয় ভাগ: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ এবং বাংলায় ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন 🕌

✏️ সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Short Answer Questions)
১. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ কবে এবং কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?
উত্তর: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ মূলত ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (কিছু ক্ষেত্রে ১৮০২ পর্যন্ত) প্রধানত বাংলা ও বিহারের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত উত্তরবঙ্গ (যেমন – রংপুর, দিনাজপুর), ঢাকা, ময়মনসিংহ, বগুড়া প্রভৃতি স্থানে সংঘটিত হয়েছিল।
২. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখো।
উত্তর: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের দুজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক (সন্ন্যাসী নেতা) এবং মজনু শাহ (ফকির নেতা)। (অন্যান্য নেতাদের মধ্যে দেবী চৌধুরানী, চিরাগ আলি, মুসা শাহ প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য)।
৩. কোন সাহিত্যিক তাঁর কোন উপন্যাসে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের উল্লেখ করেছেন?
উত্তর: সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) এবং ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৮৮৪) -তে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করেছেন।
৪. ওয়াহাবি কথার অর্থ কী? ভারতে এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
উত্তর: ওয়াহাবি কথার অর্থ হল ‘নবজাগরণ’। ভারতে এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি (বা সৈয়দ আহমদ শাহীদ)।
৫. বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল এবং এর নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?
উত্তর: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল চব্বিশ পরগনার বারাসত মহকুমার নারকেলবেড়িয়া গ্রাম। এখানে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীর।
৬. তিতুমীর কেন বিখ্যাত? তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কী ছিল?
উত্তর: তিতুমীর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষক ও অন্যান্য নিম্নবর্গের মানুষকে অত্যাচারী জমিদার, নীলকর এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বলে বিখ্যাত। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল নারকেলবেড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করা।
৭. ফরাজি কথার অর্থ কী? ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?
উত্তর: ফরাজি কথার অর্থ হল ‘ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’ (অর্থাৎ, যা আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত)। ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার হাজি শরিয়ত উল্লাহ।
৮. ফরাজি আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর: ফরাজি আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মের সংস্কার সাধন করে মুসলমানদের কোরান নির্দেশিত পথে ফিরিয়ে আনা এবং অইসলামিক রীতিনীতি দূর করা। পরবর্তীকালে এটি জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনেও পরিণত হয়।
৯. দুদু মিয়া কে ছিলেন? তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি কী ছিল?
উত্তর: দুদু মিয়া (মহম্মদ মুহসিন) ছিলেন ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজি শরিয়ত উল্লাহর সুযোগ্য পুত্র এবং এই আন্দোলনের পরবর্তী প্রধান নেতা। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল – “জমির মালিক আল্লাহ, সুতরাং জমির উপর কর ধার্য করার অধিকার কারও নেই” বা “লাঙ্গল যার জমি তার”।
১০. ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য উল্লেখ করো।
উত্তর: ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য হল:
- ওয়াহাবি আন্দোলন: এর লক্ষ্য ছিল ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (বিধর্মীর দেশ) থেকে ‘দার-উল-ইসলাম’ (ইসলামের দেশ)-এ পরিণত করা এবং এটি ছিল মূলত একটি ব্রিটিশ-বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম।
- ফরাজি আন্দোলন: এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মের সংস্কার, পরে এটি কৃষক স্বার্থরক্ষার আন্দোলনে পরিণত হয় এবং জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। এটি ওয়াহাবি আন্দোলনের মতো সরাসরি ব্রিটিশ উচ্ছেদের ডাক ততটা দেয়নি।

📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical Answer Questions)
১. 💬 সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কারণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তর: অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় সংঘটিত হওয়া সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ আন্দোলন।
বিদ্রোহের কারণ:
- অর্থনৈতিক শোষণ: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রবর্তিত নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা (যেমন – ইজারাদারি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) এবং অতিরিক্ত করের বোঝা সাধারণ কৃষক ও কারিগরদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১৭৭০) এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।
- ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত: ব্রিটিশ সরকার তীর্থকর আরোপ করে এবং সন্ন্যাসী ও ফকিরদের অবাধ তীর্থযাত্রা ও ধর্মপালনে বাধা সৃষ্টি করে। যাযাবর সন্ন্যাসী ও ফকিরদের ভিক্ষাবৃত্তিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
- বাণিজ্যে ক্ষতি: কোম্পানির কর্মচারীরা একচেটিয়াভাবে লবণ, সুপারি, তামাক প্রভৃতির ব্যবসা করায় বহু সন্ন্যাসী ও ফকির, যারা এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- সামাজিক অস্থিরতা: মন্বন্তর ও অর্থনৈতিক শোষণের ফলে বহু কৃষক ও কারিগর কর্মহীন হয়ে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের দলে যোগ দেয়, যা বিদ্রোহের শক্তি বৃদ্ধি করে।
- জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার: জমিদার ও মহাজনদের শোষণ এবং কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতিও এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল।
বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য:
- দীর্ঘস্থায়িত্ব: এই বিদ্রোহ প্রায় চার দশক (১৭৬৩-১৮০০/১৮০২ খ্রিঃ) ধরে চলেছিল, যা এর ব্যাপকতা ও গভীরতা প্রমাণ করে।
- ব্যাপক এলাকা: বিদ্রোহ উত্তরবঙ্গ (রংপুর, দিনাজপুর), ঢাকা, ময়মনসিংহ, বগুড়া, মালদহ, পাবনা, রাজশাহী এবং বিহারের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: এই বিদ্রোহে হিন্দু সন্ন্যাসী (যেমন – নাগা, গিরি, গোঁসাই) এবং মুসলিম ফকির (যেমন – মাদারী, বুরহানা) সম্প্রদায়ের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছিল, যা ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
- নেতৃত্ব: ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, মজনু শাহ, চিরাগ আলি, মুসা শাহ প্রমুখ নেতারা এই বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
- সংগ্রামের পদ্ধতি: বিদ্রোহীরা মূলত গেরিলা পদ্ধতিতে ইংরেজ কুঠি, সরকারি খাজনাখানা এবং জমিদার-মহাজনদের উপর আক্রমণ চালাত।
- সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ: শুধুমাত্র সন্ন্যাসী-ফকিররাই নন, কর্মচ্যুত সৈনিক, বেকার কারিগর এবং অত্যাচারিত কৃষকরাও এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন।
এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের দ্বারা কঠোরভাবে দমিত হলেও, এটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

২. 💬 তিতুমীরের নেতৃত্বে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের (বারাসত বিদ্রোহ) সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই বিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
উত্তর: সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মীর নিসার আলি ওরফে তিতুমীর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁর আন্দোলন মূলত বারাসত অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত ছিল বলে এটি ‘বারাসত বিদ্রোহ’ নামেও পরিচিত।
আন্দোলনের বিবরণ:
- প্রেক্ষাপট: তিতুমীর মক্কায় হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমদের সংস্পর্শে আসেন এবং ওয়াহাবি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হন। দেশে ফিরে তিনি চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের সংস্কার এবং জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন।
- লক্ষ্য: তাঁর আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণ এবং অইসলামিক রীতিনীতি দূর করা। পরবর্তীকালে এটি অত্যাচারী জমিদার (বিশেষত হিন্দু জমিদার যেমন – কৃষ্ণদেব রায়, কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়), নীলকর এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী কৃষক প্রতিরোধে পরিণত হয়।
- নারকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা নির্মাণ: তিতুমীর তাঁর অনুগামীদের নিয়ে চব্বিশ পরগনার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি শক্তিশালী বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন (১৮৩১) এবং নিজেকে ‘বাদশা’ ঘোষণা করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোলাম মাসুম ছিলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি।
- সংগ্রাম: তিতুমীরের বাহিনী স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে একাধিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের কাছারি আক্রমণ করে।
- দমন ও পতন: ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহকে কঠোর হাতে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নির্দেশে ব্রিটিশ সেনাপতি কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী গোলন্দাজ কামান নিয়ে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। এই অসম যুদ্ধে তিতুমীর ও তাঁর বহু অনুগামী বীরের মতো লড়াই করে প্রাণ দেন। বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয় এবং বহু বিদ্রোহীকে বন্দি করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
ব্যর্থতার কারণ:
- অসম যুদ্ধ: তিতুমীরের বাহিনী ছিল মূলত লাঠি, সড়কি, তলোয়ারের মতো দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত। অন্যদিকে, ব্রিটিশ বাহিনী ছিল আধুনিক কামান ও বন্দুকধারী সুশিক্ষিত সৈন্য। এই অসম যুদ্ধে তাদের পরাজয় ছিল অনিবার্য।
- সংগঠনের দুর্বলতা: তিতুমীরের আন্দোলন মূলত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল এবং এর কোনো সর্বভারতীয় বা সুসংহত সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না।
- আধুনিক রণকৌশলের অভাব: বিদ্রোহীরা মূলত সনাতন পদ্ধতিতে যুদ্ধ করত, যা আধুনিক ব্রিটিশ রণকৌশলের সামনে টিকতে পারেনি।
- শিক্ষিত মুসলিম সমাজের অসহযোগিতা: বাংলার শিক্ষিত ও অভিজাত মুসলিম সমাজ এই আন্দোলনকে সমর্থন করেনি, যা আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়।
- ব্রিটিশ সরকারের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা: ব্রিটিশরা তাদের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল।
বারাসত বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এটি বাংলার কৃষক সমাজের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধী চেতনার উন্মেষে এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৩. 💬 ফরাজি আন্দোলনের আদর্শ ও কার্যকলাপ সম্পর্কে আলোচনা করো। এই আন্দোলন কি শুধুমাত্র ধর্মীয় আন্দোলন ছিল?
উত্তর: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় যে সমস্ত কৃষক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তার মধ্যে ফরাজি আন্দোলন ছিল অন্যতম।
ফরাজি আন্দোলনের আদর্শ:
- প্রতিষ্ঠাতা ও মূলনীতি: এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুরের হাজি শরিয়ত উল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)। ‘ফরাজি’ কথার অর্থ হল ‘ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’। শরিয়ত উল্লাহ ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণ এবং কোরান নির্দেশিত পথে জীবনযাপনের উপর জোর দেন। তিনি সকল অইসলামিক রীতিনীতি (যেমন – পির পূজা, মহরম পালন) বর্জন করার আহ্বান জানান।
- ‘দার-উল-হারব’ ঘোষণা: তিনি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) বলে ঘোষণা করেন এবং এই দেশে জুম্মা ও ঈদের নামাজ পড়া অনুচিত বলে মনে করতেন।
- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব: শরিয়ত উল্লাহর পুত্র ও আন্দোলনের পরবর্তী নেতা দুদু মিয়াঁ (মহম্মদ মুহসিন, ১৮১৯-১৮৬২) এই আন্দোলনকে আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “জমির মালিক আল্লাহ, সুতরাং জমির উপর কর ধার্য করার অধিকার কারও নেই।” এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন।
ফরাজি আন্দোলনের কার্যকলাপ:
- ধর্মীয় সংস্কার: ফরাজিরা ইসলাম ধর্মের মৌলিক অনুশাসনগুলি কঠোরভাবে মেনে চলত এবং মূর্তি পূজা, পির পূজা, মহরমের তাজিয়া নির্মাণ প্রভৃতি অইসলামিক প্রথা বর্জন করত।
- কৃষক স্বার্থরক্ষা: দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ক্রমশ জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী কৃষক আন্দোলনে পরিণত হয়। তিনি কৃষকদের জমিদারদের অন্যায় কর না দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
- সংগঠন ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা: দুদু মিয়াঁ সমগ্র বাংলাকে কয়েকটি ‘হালকা’ বা অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য একজন করে ‘খলিফা’ বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। তিনি একটি শক্তিশালী লাঠিয়াল বাহিনীও গঠন করেছিলেন। স্থানীয় স্তরে বিচার ও সালিশির জন্য নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
- ব্রিটিশ বিরোধিতা: যদিও ফরাজি আন্দোলন সরাসরি ব্রিটিশ উচ্ছেদের ডাক দেয়নি, তবে জমিদার ও নীলকরদের শোষণ, যারা ছিল ব্রিটিশ শাসনেরই অঙ্গ, তার বিরোধিতা করার ফলে এটি প্রকারান্তরে ব্রিটিশ-বিরোধী চরিত্র লাভ করে।
আন্দোলনের প্রকৃতি (শুধুমাত্র ধর্মীয় আন্দোলন ছিল কি?): ফরাজি আন্দোলন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ছিল না।
- এর সূচনা হয়েছিল ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণের লক্ষ্য নিয়ে, যেখানে কোরানের নির্দেশাবলী কঠোরভাবে মেনে চলার উপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
- কিন্তু হাজি শরিয়ত উল্লাহ এবং বিশেষত দুদু মিয়ার নেতৃত্বে এই আন্দোলন ক্রমশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী কৃষক প্রতিরোধে পরিণত হয়। জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার এবং অন্যায় করের বিরুদ্ধে ফরাজিরা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে।
- দুদু মিয়ার “জমির মালিক আল্লাহ” – এই ঘোষণা কৃষকদের মধ্যে এক নতুন আত্মবিশ্বাস ও অধিকারবোধ জাগিয়ে তোলে।
- তাদের নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং লাঠিয়াল বাহিনী গঠনও প্রমাণ করে যে এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং একটি সমান্তরাল সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির প্রয়াসও ছিল।
সুতরাং, ফরাজি আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের আবরণে শুরু হলেও, এটি তৎকালীন বাংলার দরিদ্র কৃষক ও কারিগর শ্রেণির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory Answer Questions)
১. 🏛️ বাংলায় ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে মিল ও অমিলগুলি আলোচনা করো। এই আন্দোলনগুলির ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?
উত্তর: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় সংঘটিত ওয়াহাবি (বারাসত বিদ্রোহ) এবং ফরাজি আন্দোলন দুটিই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৃষক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলনের মধ্যে কিছু মিল থাকলেও, বেশ কিছু অমিলও লক্ষ্য করা যায়।
ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে মিল:
- ধর্মীয় অনুপ্রেরণা: উভয় আন্দোলনই ইসলাম ধর্মের সংস্কার ও শুদ্ধিকরণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ওয়াহাবিরা আরবের আব্দুল ওয়াহাবের আদর্শ এবং ফরাজিরা হাজি শরিয়ত উল্লাহর কোরানভিত্তিক জীবনযাপনের আদর্শ অনুসরণ করত।
- কৃষক ও নিম্নবর্গের অংশগ্রহণ: দুটি আন্দোলনেই মূলত দরিদ্র কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য নিম্নবর্গের মুসলিম জনগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।
- ব্রিটিশ-বিরোধী চরিত্র: যদিও ফরাজি আন্দোলন সরাসরি ব্রিটিশ উচ্ছেদের ডাক দেয়নি, তবুও জমিদার ও নীলকরদের (যারা ছিল ব্রিটিশ শাসনের স্তম্ভ) বিরোধিতা করার ফলে উভয় আন্দোলনই প্রকারান্তরে ব্রিটিশ-বিরোধী চরিত্র লাভ করেছিল। ওয়াহাবি আন্দোলন (তিতুমীরের নেতৃত্বে) তো সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল।
- নেতৃত্ব: উভয় আন্দোলনেই শক্তিশালী নেতার (তিতুমীর এবং শরিয়ত উল্লাহ ও দুদু মিয়া) আবির্ভাব ঘটেছিল, যারা সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
- সংগঠন: উভয় আন্দোলনই নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামো (যেমন – তিতুমীরের বাহিনী ও বাঁশের কেল্লা, দুদু মিয়ার খলিফা ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা) গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল।
ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলনের মধ্যে অমিল:
তুলনার বিষয় | ওয়াহাবি আন্দোলন (তিতুমীরের নেতৃত্বে) | ফরাজি আন্দোলন (শরিয়ত উল্লাহ ও দুদু মিয়ার নেতৃত্বে) |
---|---|---|
মূল লক্ষ্য | ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের শোষণ থেকে মুসলিম কৃষকদের রক্ষা করা। ভারতকে ‘দার-উল-ইসলাম’-এ পরিণত করা। | ইসলাম ধর্মের সংস্কার ও শুদ্ধিকরণ, অইসলামিক প্রথা বর্জন এবং পরবর্তীকালে জমিদার-নীলকরদের শোষণ প্রতিরোধ ও কৃষক স্বার্থরক্ষা। ‘দার-উল-হারব’-এ জুম্মা ও ঈদের নামাজ অনুচিত বলে ঘোষণা। |
পদ্ধতি | মূলত সশস্ত্র সংগ্রামের উপর নির্ভরশীল ছিল। বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ। | প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণ প্রচার ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার উপর জোর দেওয়া হয়। পরে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। |
বিস্তার | প্রধানত বারাসত ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে (২৪ পরগনা, নদিয়া) সীমাবদ্ধ ছিল। | মূলত পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর, ঢাকা, বরিশাল, পাবনা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। |
ব্রিটিশ বিরোধিতা | সরাসরি ও আপোসহীন ব্রিটিশ বিরোধিতা। | পরোক্ষ ব্রিটিশ বিরোধিতা; প্রধান লক্ষ্য ছিল জমিদার ও নীলকরদের শোষণ। |
উভয় আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ:
- অসম যুদ্ধ ও আধুনিক অস্ত্রের অভাব: উভয় আন্দোলনই ছিল মূলত দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত সাধারণ মানুষের লড়াই, যা ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্র ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সামনে টিকতে পারেনি।
- সংগঠনের দুর্বলতা ও আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা: আন্দোলনগুলি মূলত স্থানীয় স্তরে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাদের মধ্যে কোনো সর্বভারতীয় সমন্বয় বা দীর্ঘস্থায়ী সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না।
- শিক্ষিত ও অভিজাত মুসলিম সমাজের সমর্থনের অভাব: বাংলার শিক্ষিত ও অভিজাত মুসলিম শ্রেণি এই আন্দোলনগুলিকে সমর্থন করেনি, যা তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।
- ব্রিটিশ সরকারের কঠোর দমননীতি: ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত নির্মমভাবে এই বিদ্রোহগুলি দমন করে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করা হয়, দুদু মিয়াঁকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং বহু আন্দোলনকারীকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়।
- ধর্মীয় সংকীর্ণতা (কিছু ক্ষেত্রে): যদিও উভয় আন্দোলনই কৃষক স্বার্থের কথা বলেছিল, তবুও তাদের ধর্মীয় আবরণ অনেক অমুসলিমকে এই আন্দোলন থেকে দূরে রেখেছিল, যা তাদের গণভিত্তিকে কিছুটা হলেও সীমিত করেছিল।
ব্যর্থতা সত্ত্বেও, এই আন্দোলনগুলি বাংলার কৃষক সমাজে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঐতিহ্য তৈরি করেছিল, যা পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
২. 🏛️ সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৬) কারণ, প্রকৃতি এবং ফলাফল ও গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করো।
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬), যা ‘সাঁওতাল হুল’ নামেও পরিচিত, ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে সংঘটিত হওয়া অন্যতম বৃহৎ, সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী আদিবাসী গণ-অভ্যুত্থান। এর কারণ, প্রকৃতি, ফলাফল ও গুরুত্ব নিচে আলোচনা করা হলো:
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ:
- ভূমি ও অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চনা:
- সাঁওতালরা ঐতিহ্যগতভাবে রাজমহল পাহাড়ের প্রান্তদেশ ও মুর্শিদাবাদের একাংশে জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষবাস করত। এই অঞ্চল ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রান্তদেশ) নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও অন্যান্য ভূমিরাজস্ব নীতির মাধ্যমে এই জমির উপর সাঁওতালদের চিরাচরিত অধিকার কেড়ে নেয় এবং উচ্চহারে রাজস্ব ধার্য করে।
- ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন তাদের অরণ্য থেকে কাঠ, ফলমূল সংগ্রহ এবং পশুচারণের অধিকার খর্ব করে, যা তাদের জীবন-জীবিকার উপর চরম আঘাত হানে।
- মহাজনী শোষণ ও ঋণের জাল:
- বহিরাগত মহাজন ও ব্যবসায়ীরা (যাদের সাঁওতালরা ‘দিকু’ বলত) চড়া সুদে (৫০% থেকে ৫০০% পর্যন্ত) সাঁওতালদের ঋণ দিত। একবার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়লে তাদের পক্ষে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠত।
- মহাজনরা বিভিন্ন ধরনের কারচুপি (যেমন – ‘কেনারাম’ ও ‘বেচারাম’ নামক বাটখারার ব্যবহার) এবং প্রতারণার মাধ্যমে সাঁওতালদের ফসল ও জমি আত্মসাৎ করত।
- সরকারি কর্মচারী ও পুলিশের অত্যাচার:
- ব্রিটিশ পুলিশ, বন বিভাগের কর্মচারী, দারোগা এবং অন্যান্য সরকারি আমলারা সাঁওতালদের উপর নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাত। তারা ঘুষ নিত, সাঁওতাল নারীদের সম্মানহানি করত এবং তাদের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করত।
- রেললাইন নির্মাণ ও ঠিকাদারদের শোষণ:
- ভাগলপুর থেকে বর্ধমান পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের সময় বহু সাঁওতালকে স্বল্প মজুরিতে বা বেগার শ্রমে (বিনা পারিশ্রমিকে কাজ) নিয়োগ করা হয়। রেলের ঠিকাদাররাও তাদের উপর নির্মম শোষণ চালাত।
- বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা:
- ব্রিটিশ আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং সাঁওতালদের কাছে অপরিচিত। আদালতে তারা প্রায়শই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হত, কারণ মহাজন ও জমিদাররা সহজেই সাক্ষ্যপ্রমাণ নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারত।
- সামাজিক ও ধর্মীয় অবমাননা:
- সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় বিশ্বাসকে অনেক সময় বহিরাগতরা ও ব্রিটিশরা অবজ্ঞা করত, যা তাদের আত্মসম্মানে আঘাত করত।
বিদ্রোহের প্রকৃতি:
- এটি ছিল মূলত কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহ।
- এটি ছিল বহিরাগত শোষক (দিকু) এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত প্রতিরোধ।
- বিদ্রোহীরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শোষণ থেকেই মুক্তি চায়নি, তারা একটি স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য বা ‘সাঁওতাল রাজ’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যেখানে তাদের নিজস্ব আইন ও শাসনব্যবস্থা থাকবে।
- সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব প্রমুখ নেতারা নিজেদের ঈশ্বরের দূত হিসেবেও প্রচার করেছিলেন, যা বিদ্রোহে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
ফলাফল ও গুরুত্ব:
- প্রাথমিক সাফল্য ও ব্যাপকতা: ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ভাগনাডিহির মাঠে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল সমবেত হয়ে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেয় এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহীরা মহাজন, জমিদার, পুলিশ ফাঁড়ি, রেল স্টেশন এবং সরকারি দপ্তরের উপর আক্রমণ চালায়। ভাগলপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, হাজারিবাগ, ছোটনাগপুর পর্যন্ত এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
- নির্মম দমননীতি: ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সাঁওতালদের তীর-ধনুক ও पारंपरिक অস্ত্র বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। সেনাপতি জার্ভিস, মেজর বারোজ প্রমুখের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ হাজার সাঁওতাল প্রাণ হারান। সিধু ও কানু সহ প্রধান নেতারা ধরা পড়েন ও তাদের ফাঁসি হয়।
- সাঁওতাল পরগনা গঠন: বিদ্রোহ দমনের পর ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের অসন্তোষ কিছুটা প্রশমিত করার জন্য ১৮৫৫ সালেই (৩১ ডিসেম্বর, আইন পাস হয় ১৮৫৬ সালে) ভাগলপুর ও বীরভূম জেলার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বর্গমাইল এলাকা নিয়ে ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করে। এই অঞ্চলে সাঁওতালদের জন্য কিছু বিশেষ প্রশাসনিক ও আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয় (যেমন – সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইন)।
- ঐক্য ও প্রতিরোধের প্রতীক: সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এটি ঔপনিবেশিক শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এটি প্রমাণ করে যে শান্তিপ্রিয় আদিবাসীরাও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
- পরবর্তী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা: এই বিদ্রোহ পরবর্তীকালে ভারতের কৃষক ও আদিবাসী আন্দোলনগুলির জন্য এক গভীর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। এটি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশেও পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং রক্তক্ষয়ী অধ্যায়।
🏞️ তৃতীয় ভাগ: নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০) 🏞️

✏️ সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Short Answer Questions)
১. নীল চাষের দুটি প্রধান পদ্ধতির নাম লেখো।
উত্তর: নীল চাষের দুটি প্রধান পদ্ধতি ছিল:
- এলাকা চাষ বা নিজ আবাদি: এই পদ্ধতিতে নীলকর সাহেবরা নিজেরাই জমি কিনে বা ভাড়া নিয়ে ভাড়াটে মজুরদের দ্বারা নীল চাষ করাত।
- বেএলাকা চাষ বা রায়তি বা দাদনি প্রথা: এই পদ্ধতিতে নীলকররা চাষিদের অগ্রিম টাকা (দাদন) দিয়ে তাদের নিজেদের জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য করত। এটিই ছিল বেশি প্রচলিত ও শোষণমূলক।
২. ‘দাদন’ কী? নীল চাষের ক্ষেত্রে এটি কীভাবে ব্যবহৃত হত?
উত্তর: ‘দাদন’ কথার অর্থ হল অগ্রিম অর্থ বা ঋণ। নীল চাষের ক্ষেত্রে নীলকর সাহেবরা গরিব চাষিদের নীল চাষ করার জন্য সামান্য কিছু টাকা অগ্রিম দিত। এই দাদন গ্রহণ করলে চাষিরা নীলকরদের নির্দিষ্ট দামে নীল বিক্রি করতে এবং তাদের নির্দেশমতো জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য থাকত।
৩. নীল বিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) দুজন প্রধান নেতার নাম লেখো।
উত্তর: নীল বিদ্রোহের দুজন প্রধান নেতা ছিলেন নদিয়া জেলার চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। (এছাড়াও রফিক মণ্ডল, কাদের মোল্লা, বৈদ্যনাথ সর্দার, মেঘাই সর্দার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য)।
৪. নীল বিদ্রোহ প্রথম কোথায় শুরু হয়েছিল?
উত্তর: নীল বিদ্রোহ প্রথম শুরু হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নদিয়া জেলার চৌগাছা ও গোবিন্দপুর গ্রামে।
৫. ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি কে রচনা করেন? এটি কবে এবং কোথা থেকে প্রকাশিত হয়?
উত্তর: ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচনা করেন দীনবন্ধু মিত্র। এটি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়।
৬. ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি কে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন? কার নামে এটি প্রকাশিত হয়েছিল?
উত্তর: ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এটি রেভারেন্ড জেমস লঙ সাহেবের নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
৭. নীল বিদ্রোহের সময় বাংলার ছোটলাট কে ছিলেন? এই বিদ্রোহে তাঁর ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: নীল বিদ্রোহের সময় বাংলার ছোটলাট বা লেফটেনান্ট গভর্নর ছিলেন স্যার জন পিটার গ্রান্ট (জে.পি. গ্রান্ট)। তিনি নীলচাষিদের উপর হওয়া অত্যাচারের বিষয়ে সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং প্রকৃত অবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য ‘নীল কমিশন’ (১৮৬০) গঠন করেন। তিনি একটি নির্দেশ জারি করে বলেন যে, চাষিরা স্বেচ্ছায় নীল চাষ করতে রাজি না হলে তাদের জোর করা যাবে না।
৮. নীল কমিশন (১৮৬০) কেন গঠিত হয়েছিল? এর প্রধান সুপারিশ কী ছিল?
উত্তর: নীল বিদ্রোহের ব্যাপকতা এবং নীলচাষিদের উপর হওয়া অত্যাচারের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ছোটলাট জে.পি. গ্রান্ট নীল কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন ডব্লিউ. এস. সিটনকার। কমিশনের প্রধান সুপারিশ ছিল, চাষিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নীল চাষে বাধ্য করা যাবে না এবং নীলকরদের দাদন প্রথার অবসান ঘটাতে হবে।
৯. নীল বিদ্রোহে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার ভূমিকা কী ছিল? এই পত্রিকার সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা নীল বিদ্রোহের সমর্থনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই পত্রিকা নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং চাষিদের দুর্দশার কথা সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করে জনমত গঠনে সাহায্য করেছিল। এর তৎকালীন সম্পাদক ছিলেন হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
১০. নীল বিদ্রোহকে ‘প্রথম সফল কৃষক বিদ্রোহ’ বলা হয় কেন?
উত্তর: নীল বিদ্রোহকে ‘প্রথম সফল কৃষক বিদ্রোহ’ বলা হয় কারণ এই বিদ্রোহের ফলেই সরকার নীল কমিশন গঠন করতে এবং নীলকরদের অত্যাচার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। চাষিরা নীল চাষের বাধ্যতামূলক শৃঙ্খল থেকে বহুলাংশে মুক্তি পেয়েছিল এবং দাদন প্রথা কার্যত উঠে গিয়েছিল। এটি ছিল কৃষক ঐক্যের এক গুরুত্বপূর্ণ জয়।
📖 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical Answer Questions)
১. 💬 নীল চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিবরণ দাও।
উত্তর: উনিশ শতকে বাংলায় নীলকর সাহেবরা নীল চাষিদের উপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার ও শোষণ চালাত, তা ছিল নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ। অত্যাচারের বিভিন্ন দিক ছিল:
- দাদন প্রথার শোষণ: নীলকররা চাষিদের সামান্য কিছু টাকা অগ্রিম বা ‘দাদন’ দিয়ে তাদের উৎকৃষ্ট জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য করত। একবার দাদন নিলে চাষিরা নীলকরদের ক্রীতদাসে পরিণত হত এবং বাজার দরের চেয়ে অনেক কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। এই ঋণ কখনও শোধ হত না, বরং বংশপরম্পরায় চলতে থাকত।
- জমি কেড়ে নেওয়া ও শারীরিক নির্যাতন: যে সকল চাষি নীল চাষ করতে অস্বীকার করত বা নীলকরদের নির্দেশ অমান্য করত, তাদের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হত, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হত এবং তাদের উপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালানো হত। নীলকুঠিতে চাষিদের ধরে নিয়ে গিয়ে চাবুক মারা, আটক করে রাখা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
- পঞ্চম ও সপ্তম আইন (১৮৩০): এই আইনগুলির মাধ্যমে নীলকরদের হাতে চাষিদের উপর অত্যাচার করার অবাধ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল। নীল চাষে রাজি না হলে চাষিদের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের মামলা করা যেত এবং তাদের গ্রেফতার করা যেত।
- মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া: প্রতিবাদী চাষিদের শায়েস্তা করার জন্য নীলকররা প্রায়শই তাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করত। আদালতের রায়ও সাধারণত নীলকরদের পক্ষেই যেত।
- সামাজিক অত্যাচার: নীলকর সাহেবরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শোষণই করত না, তারা চাষিদের সামাজিক জীবনেও হস্তক্ষেপ করত। চাষিদের পরিবারের নারীদের উপর অত্যাচার ও অসম্মানজনক আচরণের বহু ঘটনা ঘটেছিল।
- অন্যান্য শস্য চাষে বাধা: নীল চাষ লাভজনক না হওয়া সত্ত্বেও চাষিদের ধান, পাট বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় শস্য চাষ করতে দেওয়া হত না। তাদের উৎকৃষ্ট জমিতে জোর করে নীল চাষ করানো হত, যার ফলে খাদ্য সংকটও দেখা দিত।
এই নির্মম অত্যাচার ও শোষণই নীল চাষিদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ বা নীল বিদ্রোহের পথে ঠেলে দিয়েছিল।
২. 💬 নীল বিদ্রোহে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ভূমিকা আলোচনা করো।
উত্তর: নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০) শুধুমাত্র নীল চাষিদের একক সংগ্রাম ছিল না, বাংলার সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই বিদ্রোহকে সমর্থন জুগিয়েছিল এবং এর সাফল্য ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল।
- নীল চাষি: তারাই ছিল এই বিদ্রোহের প্রধান চালিকাশক্তি। নদিয়া জেলার চৌগাছা ও গোবিন্দপুর গ্রামের বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস প্রথম বিদ্রোহের সূচনা করেন। এরপর বাংলার বিভিন্ন জেলার (যেমন – যশোহর, পাবনা, খুলনা, ফরিদপুর, মালদহ, রাজশাহী) হাজার হাজার নীল চাষি ঐক্যবদ্ধভাবে নীল চাষ বন্ধ করে দেয় এবং নীলকরদের আক্রমণ প্রতিহত করে।
- গ্রামের সাধারণ মানুষ: গ্রামের অন্যান্য পেশার মানুষ, যেমন – কারিগর, জেলে, নাপিত, ধোপা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষও নীল চাষিদের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং নীলকরদের সামাজিক বয়কট করে।
- জমিদারদের একাংশ: যদিও বেশিরভাগ জমিদার নীলকরদের পক্ষ নিয়েছিল, তবুও কিছু কিছু বিদ্যোৎসাহী ও দেশপ্রেমিক জমিদার (যেমন – নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়, সাধুহাটির মথুরানাথ আচার্য) নীল চাষিদের সমর্থন করেন এবং তাদের সাহায্য করেন।
- শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি: বাংলার উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীল বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।
- হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় সাহসিকতার সঙ্গে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী এবং চাষিদের দুর্দশার কথা নিয়মিত প্রকাশ করে জনমত গঠন করেন।
- দীনবন্ধু মিত্র তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০)-এ নীল চাষিদের উপর নীলকরদের নির্মম অত্যাচারের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেন, যা শিক্ষিত সমাজকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।
- শিশিরকুমার ঘোষ (পরে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র প্রতিষ্ঠাতা) গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা প্রচার করেন।
- আইনজীবী: কিছু আইনজীবী (যেমন – শম্ভুনাথ পণ্ডিত) নীল চাষিদের পক্ষে সওয়াল করেন এবং তাদের আইনি সহায়তা দেন।
- খ্রিস্টান মিশনারি: রেভারেন্ড জেমস লঙ ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করায় (তাঁর নামে) তাঁকে কারাদণ্ড ও জরিমানা ভোগ করতে হয়েছিল। এর মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে নীলকরদের অত্যাচার তুলে ধরেছিলেন।
এইভাবে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও সমর্থনের ফলেই নীল বিদ্রোহ এক শক্তিশালী গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল এবং আংশিকভাবে হলেও সাফল্য লাভ করেছিল।
৩. 💬 ‘নীলদর্পণ’ নাটক কীভাবে নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল?
উত্তর: দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি (১৮৬০) শুধুমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম ছিল না, এটি ছিল নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে এক শক্তিশালী সামাজিক ও রাজনৈতিক দলিল। এর গুরুত্ব ছিল বহুমাত্রিক:
- নীলকরদের অত্যাচারের বাস্তব চিত্র: এই নাটকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও মর্মস্পর্শীভাবে নীলকর সাহেবদের শোষণ, অত্যাচার, দুর্নীতি এবং নীল চাষিদের অসহায় জীবনযাত্রার করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। গোলকচন্দ্রের পরিবার এবং অন্যান্য চরিত্রের মাধ্যমে চাষিদের দুর্দশা, তাদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, নারীদের অসম্মান – এই সমস্ত কিছুই নাটকে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
- শিক্ষিত সমাজের বিবেক জাগ্রত করা: ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের বিবেককে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার পাশাপাশি এই নাটকটি জনমত গঠনে এবং নীলকরদের বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজের সহানুভূতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচার: মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক এই নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ (রেভারেন্ড জেমস লঙের নামে প্রকাশিত) ইউরোপের মানুষের কাছেও নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী পৌঁছে দেয়। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার কিছুটা হলেও চাপের মুখে পড়ে। এই অনুবাদের জন্য জেমস লঙকে কারাদণ্ড ও জরিমানা ভোগ করতে হয়েছিল, যা ঘটনাটিকে আরও বেশি প্রচার দেয়।
- বিদ্রোহীদের অনুপ্রেরণা: ‘নীলদর্পণ’ নাটক গ্রামেগঞ্জে অভিনীত হওয়ার ফলে সাধারণ চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিল। নাটকের দৃশ্যগুলি তাদের মনে সাহস ও প্রতিরোধের স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিল।
- ঐতিহাসিক দলিল: এই নাটকটি উনিশ শতকের বাংলার গ্রামীণ সমাজ, নীল চাষের পদ্ধতি, নীলকরদের শোষণ এবং কৃষক প্রতিরোধের এক মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেও বিবেচিত হয়। এটি সমসাময়িক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বুঝতে সাহায্য করে।
সুতরাং, ‘নীলদর্পণ’ নাটক শুধুমাত্র নীল বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি ছিল না, এটি বিদ্রোহের বিস্তার, জনমত গঠন এবং পরবর্তীকালে নীলকরদের অত্যাচার বন্ধে পরোক্ষভাবে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এটি ছিল কলমের শক্তির এক বলিষ্ঠ উদাহরণ।
📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory Answer Questions)
১. 🏛️ নীল বিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) কারণ, বিস্তার ও ফলাফল আলোচনা করো। এই বিদ্রোহে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্রের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০) ছিল উনিশ শতকের বাংলায় সংঘটিত হওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সফল কৃষক আন্দোলন। এর কারণ, বিস্তার, ফলাফল এবং এই বিদ্রোহে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্রের ভূমিকা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল:
নীল বিদ্রোহের কারণ:
- শোষণমূলক দাদন প্রথা: নীলকর সাহেবরা বাংলার গরিব চাষিদের সামান্য কিছু টাকা অগ্রিম (দাদন) দিয়ে তাদের উৎকৃষ্ট জমিতে নীল চাষ করতে বাধ্য করত। একবার দাদন নিলে চাষিরা নীলকরদের প্রায় ক্রীতদাসে পরিণত হত এবং বাজার দরের চেয়ে অনেক কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। এই ঋণ কখনও শোধ হত না।
- জমি ও ফসলের ক্ষতি: নীল চাষ মাটির উর্বরতা নষ্ট করত এবং নীল চাষের জমিতে অন্য কোনো লাভজনক ফসল (যেমন – ধান, পাট) চাষ করা যেত না, ফলে খাদ্য সংকট দেখা দিত।
- নীলকরদের অত্যাচার: যে সকল চাষি নীল চাষ করতে অস্বীকার করত বা দাদনের টাকা শোধ করতে পারত না, তাদের উপর নীলকর সাহেব ও তাদের লাঠিয়াল বাহিনী অকথ্য অত্যাচার চালাত। চাষিদের অপহরণ, মারধর, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, গবাদিপশু কেড়ে নেওয়া, নারীদের উপর অত্যাচার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
- পঞ্চম ও সপ্তম আইন (১৮৩০): এই আইনগুলির মাধ্যমে নীলকরদের হাতে চাষিদের উপর অত্যাচার করার এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।
- বিচার ব্যবস্থার পক্ষপাতিত্ব: ব্রিটিশ আদালত ও পুলিশ প্রশাসন প্রায়শই নীলকরদের পক্ষ নিত, ফলে নির্যাতিত চাষিরা ন্যায়বিচার পেত না।
- ছোটলাটের ঘোষণা (১৮৫৯): ১৮৫৯ সালে বাংলার তৎকালীন ছোটলাট জে. পি. গ্রান্ট একটি ঘোষণা করেন যে, চাষিরা স্বেচ্ছায় নীল চাষ করতে রাজি না হলে তাদের জোর করা যাবে না। এই ঘোষণাকে চাষিরা নীল চাষ বন্ধের সরকারি নির্দেশ বলে মনে করে এবং বিদ্রোহে উৎসাহিত হয়।
বিদ্রোহের বিস্তার:
- বিদ্রোহের প্রথম সূচনা হয় ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নদিয়া জেলার চৌগাছা ও গোবিন্দপুর গ্রামে। এখানকার চাষি বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস প্রথম নীল চাষ বন্ধের ডাক দেন।
- এই বিদ্রোহ দ্রুত বাংলার অন্যান্য জেলায় (যেমন – যশোহর, পাবনা, খুলনা, ফরিদপুর, মালদহ, রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, বীরভূম) ছড়িয়ে পড়ে।
- চাষিরা ঐক্যবদ্ধভাবে নীল চাষ বন্ধ করে দেয়, নীলকুঠি আক্রমণ করে, নীলকর সাহেব ও তাদের কর্মচারীদের প্রতিরোধ করে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের হত্যাও করে।
- বিভিন্ন স্থানীয় নেতা (যেমন – পাবনার রফিক মণ্ডল, মালদহের কাদের মোল্লা, সুন্দরবনের রহিমউল্লা, বাঁকুড়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও মেঘাই সর্দার) এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন।
ফলাফল ও গুরুত্ব:
- নীল কমিশন গঠন (১৮৬০): বিদ্রোহের ব্যাপকতা ও তীব্রতায় ব্রিটিশ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, চাষিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নীল চাষে বাধ্য করা যাবে না এবং দাদন প্রথা কার্যত বেআইনি ঘোষিত হয়।
- নীল চাষের অবসান: কমিশনের সুপারিশ এবং চাষিদের দৃঢ় প্রতিরোধের ফলে বাংলায় ধীরে ধীরে নীল চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এটি ছিল কৃষক ঐক্যের এক বিরাট সাফল্য।
- কৃষক সচেতনতা বৃদ্ধি: নীল বিদ্রোহ বাংলার কৃষকদের মধ্যে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের শক্তি সম্পর্কে অবহিত করে।
- জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: এই বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে হলেও জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশে সাহায্য করেছিল, কারণ এটি প্রমাণ করে যে ঐক্যবদ্ধ গণপ্রতিরোধের মাধ্যমে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকেও হারানো সম্ভব।
হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা:
- হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার নির্ভীক সম্পাদক।
- তিনি তাঁর পত্রিকায় নিয়মিতভাবে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার, শোষণ এবং নীল চাষিদের দুঃখ-দুর্দশার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতেন।
- তাঁর লেখাগুলি শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে নীল চাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে এবং জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- তিনি নীল চাষিদের আইনি লড়াইয়েও সাহায্য করতেন এবং তাদের অভাব-অভিযোগ সরকারের কাছে পৌঁছে দিতেন। নীল বিদ্রোহের সময় তাঁর পত্রিকা ছিল চাষিদের প্রধান কণ্ঠস্বর।
দীনবন্ধু মিত্রের ভূমিকা:
- দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী, যিনি নীলচাষ অধ্যুষিত অঞ্চলে কাজ করার সুবাদে নীলকরদের অত্যাচার খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।
- তিনি ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘নীলদর্পণ’ নামে একটি কালজয়ী নাটক রচনা করেন।
- এই নাটকে তিনি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও মর্মস্পর্শীভাবে নীল চাষিদের উপর নীলকরদের নির্মম অত্যাচার, শোষণ এবং তাদের অসহায় জীবনযাত্রার করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলেন।
- ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি শিক্ষিত বাঙালি সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং নীল বিদ্রোহের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে।
- মাইকেল মধুসূদন দত্ত কর্তৃক নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ (রেভারেন্ড জেমস লঙের নামে প্রকাশিত) ইউরোপেও নীলকরদের অত্যাচারের কথা ছড়িয়ে দেয়, যা ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত করে।
সুতরাং, নীল বিদ্রোহ ছিল ভারতের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, এবং এই সংগ্রামে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও দীনবন্ধু মিত্রের মতো ব্যক্তিত্বদের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
