উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার | মাধ্যমিক প্রশ্নোত্তর | SmartExamPrep | Free History Tutorials

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার! উনিশ শতকের বাংলা ছিল এক যুগান্তকারী সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের সাক্ষী। এই সময়েই পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় এবং দেশীয় মনীষীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সমাজের গভীরে প্রোথিত নানা কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও ও তাঁর নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী, বিভিন্ন ব্রাহ্মসমাজ, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিত্বরা তাঁদের চিন্তা ও কর্মের দ্বারা এক নতুন বাংলা তথা আধুনিক ভারত গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

মাধ্যমিক ইতিহাসের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় – ‘উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা’ – থেকে পরীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন আসে। তোমাদের পরীক্ষার প্রস্তুতিকে আরও সহজ ও সম্পূর্ণ করে তোলার জন্য, এই পৃষ্ঠায় আমরা এই অধ্যায়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (SAQ – ২ নম্বর), বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন (৪ নম্বর) এবং ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন (৮ নম্বর) ও তাদের আদর্শ উত্তর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।

Table Of Contents
  1. 🤝⛪ উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা 🙏✨
  2. সাহিত্য, সংবাদপত্র ও শিক্ষা সংস্কার: তৈরি তো পরীক্ষার জন্য?
  3. Bengal Renaissance: বিতর্ক ও বিশ্লেষণ – সম্পূর্ণ প্রশ্নোত্তর!
  4. দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি যাচাই! মক টেস্ট দাও এখনই!

🤝⛪ উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা 🙏✨

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার অংশে তুমি জানবে উনিশ শতকে বাংলায় কীভাবে সমাজ ও ধর্মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল এবং কারা এই পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।


📜 ক) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (SAQ – প্রতিটি ২ নম্বর) (উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার)

সমাজ সংস্কার ও ব্রাহ্মসমাজ

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার: সমাজ সংস্কার ও ব্রাহ্মসমাজ

১. প্রশ্ন: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের উত্থানের দুটি প্রধান কারণ কী ছিল? 🤔

উত্তর: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের উত্থানের দুটি প্রধান কারণ ছিল: ১) পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও তার ফলে বাঙালির মনে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের প্রসার এবং ২) তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথা ও কুসংস্কার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ।

২. প্রশ্ন: ব্রাহ্মসভা কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন? এর পরবর্তী নাম কী হয়? 🏛️

উত্তর: ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রামমোহন রায়, ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে । এটিই পরবর্তীকালে, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে, ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয় ।

৩. প্রশ্ন: ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের দুটি প্রধান লক্ষ্য কী ছিল? 🎯

উত্তর: ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রাজা রামমোহন রায়ের দুটি প্রধান লক্ষ্য ছিল: ১) হিন্দুধর্মের কুসংস্কার (যেমন – জাতিভেদপ্রথা, সতীদাহপ্রথা) দূর করা এবং ২) একেশ্বরবাদী নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে হিন্দুধর্মের সংস্কার সাধন করা ।

৪. প্রশ্ন: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিলেন? 💪

উত্তর: রামমোহনের মৃত্যুর পর স্থবির হয়ে পড়া ব্রাহ্ম আন্দোলনে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে যোগ দেন) নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন । তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’-র মাধ্যমে ব্রাহ্ম মতাদর্শ প্রচার ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন ।

৫. প্রশ্ন: কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত দুটি সমাজসংস্কারমূলক কাজের উল্লেখ করো।

উত্তর: কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত দুটি সমাজসংস্কারমূলক কাজ হলো: ১) বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলা এবং ২) নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো ও শ্রমিকদের মধ্যে মদ্যপানের প্রবণতা কমানোর চেষ্টা করা ।

৬. প্রশ্ন: ‘তিন আইন’ (১৮৭২) কী ছিল? এটি কাদের প্রচেষ্টায় পাস হয়? 📜

উত্তর: ‘তিন আইন’ বা ‘নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট’ ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাস করা একটি আইন । এই আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং অসবর্ণ বিবাহকে আইনসিদ্ধ করা হয় । এটি প্রধানত কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলেই পাস হয়েছিল ।

৭. প্রশ্ন: আদি ব্রাহ্মসমাজ বলতে কী বোঝো? এর প্রধান প্রবক্তা কে ছিলেন? 🕉️

উত্তর: ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা ব্রাহ্মসমাজ থেকে বেরিয়ে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করলে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন মূল ব্রাহ্মসমাজ ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয় । এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

৮. প্রশ্ন: ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তর: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের মতপার্থক্যের (যেমন – আচার্যদের উপবীত ত্যাগ, অসবর্ণ বিবাহ) কারণে কেশবচন্দ্র ও তাঁর প্রগতিশীল অনুগামীরা ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে মূল ব্রাহ্মসমাজ থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ।

৯. প্রশ্ন: সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ কবে এবং কেন গঠিত হয়? 👨‍👩‍👧‍👦

উত্তর: সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে গঠিত হয় । কেশবচন্দ্র সেনের কিছু কার্যকলাপ (যেমন – গুরুবাদকে সমর্থন, অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ দেওয়া) নিয়ে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে মতবিরোধ দেখা দিলে শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ নেতারা এই নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ।

১০. প্রশ্ন: ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ কে প্রতিষ্ঠা করেন? 🌟

উত্তর: ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন কেশবচন্দ্র সেন । সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হওয়ার পর কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের অংশটি এই নামে পরিচিত হয়।

সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার: সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন

১১. প্রশ্ন: সতীদাহ প্রথা বলতে কী বোঝায়? 🔥👩

উত্তর: সতীদাহ প্রথা বলতে বোঝায়, স্বামীর মৃত্যুর পর তার জ্বলন্ত চিতায় বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার এক অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রথা, যা উনিশ শতকের আগেও হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল ।

১২. প্রশ্ন: সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদী কারা ছিলেন? (রামমোহনের পূর্বে) 🕯️

উত্তর: রাজা রামমোহন রায়ের আগে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিরা (যেমন – উইলিয়াম কেরি) সোচ্চার হয়েছিলেন । এছাড়াও, সুপ্রিমকোর্টের প্রধান পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারও (১৮১৭) এই প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয় বলে মত প্রকাশ করেছিলেন ।

১৩. প্রশ্ন: সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য রাজা রামমোহন রায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? (দুটি লেখো) ✍️📢

উত্তর: সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য রাজা রামমোহন রায় যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার মধ্যে দুটি হলো: ১) তিনি হিন্দুশাস্ত্র (যেমন – ‘মনুসংহিতা’) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয় এবং ২) তিনি ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামে পুস্তিকা প্রকাশ করে এবং ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে জনমত গঠন করেন ।

১৪. প্রশ্ন: ‘ধর্মসভা’ কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এর প্রধান নেতা কে ছিলেন? 🏛️

উত্তর: রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করার জন্য এবং হিন্দু ধর্মের সনাতন প্রথাগুলি রক্ষার উদ্দেশ্যে ‘ধর্মসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (১৮৩০)। এর প্রধান নেতা ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব

১৫. প্রশ্ন: সতীদাহ প্রথা কবে, কার উদ্যোগে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়? ⚖️

উত্তর: সতীদাহ প্রথা ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর, গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের উদ্যোগে, ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় । এই কাজে তাঁকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিলেন রাজা রামমোহন রায় ।

নব্যবঙ্গ (ইয়ং বেঙ্গল) আন্দোলন

১৬. প্রশ্ন: ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ কাদের বলা হতো? 🧑‍🎓✨

উত্তর: উনিশ শতকে হিন্দু কলেজের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে একদল তরুণ ছাত্র হিন্দুধর্ম ও সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যে চরমপন্থী ও যুক্তিবাদী আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামী যুবগোষ্ঠী ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ।

১৭. প্রশ্ন: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও কে ছিলেন? 👨‍🏫

উত্তর: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ছিলেন উনিশ শতকের একজন ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বংশোদ্ভূত তরুণ অধ্যাপক, কবি ও চিন্তাবিদ । তিনি হিন্দু কলেজের (১৮২৬ থেকে) অধ্যাপক হিসেবে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা, যুক্তিবাদ ও দেশপ্রেমের সঞ্চার করেছিলেন এবং নব্যবঙ্গ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন ।

১৮. প্রশ্ন: ডিরোজিও কীভাবে তাঁর ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন? 💡

উত্তর: ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যুক্তিবাদী মনোভাব, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে উৎসাহিত করতেন । তিনি বিভিন্ন দার্শনিক (যেমন – লক, হিউম, টম পেইন) ও ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারার সাথে তাদের পরিচয় করাতেন।

১৯. প্রশ্ন: ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ (১৮২৮) কী ছিল? এর উদ্দেশ্য কী ছিল? 🗣️

উত্তর: ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ ছিল ডিরোজিও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি বিতর্ক সভা । এর উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা, যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা এবং হিন্দু সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার (যেমন – জাতিভেদপ্রথা, পৌত্তলিকতা, নারীদের প্রতি বৈষম্য) বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিবাদী মনন গঠন করা ।

২০. প্রশ্ন: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর দুটি পত্রিকার নাম লেখো। 📰

উত্তর: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর ভাবধারা প্রচারিত হতো এমন দুটি পত্রিকা হলো ‘পার্থেনন’ এবং ‘ক্যালাইডোস্কোপ’ । (তাদের মৃত্যুর পর অনুগামীরা ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এনকোয়ারার’ প্রকাশ করেন )।

২১. প্রশ্ন: নব্যবঙ্গীয়রা হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিবাদ জানাতেন? 💥

উত্তর: নব্যবঙ্গীয়রা হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ, উপবীত ছিঁড়ে ফেলা এবং প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানকে ব্যঙ্গ করার মতো উগ্র পদ্ধতিতে প্রতিবাদ জানাতেন ।

২২. প্রশ্ন: ডিরোজিওকে কেন হিন্দু কলেজ থেকে পদচ্যুত করা হয়েছিল? 😥

উত্তর: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যদের উগ্র কার্যকলাপের ফলে হিন্দুসমাজে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং গোঁড়া হিন্দুদের চাপে হিন্দু কলেজের কর্তৃপক্ষ ডিরোজিওকে পদচ্যুত করতে বাধ্য হন (১৮৩১) ।

২৩. প্রশ্ন: দুজন উল্লেখযোগ্য ডিরোজিয়ানের (ডিরোজিওর অনুগামী) নাম লেখো। 🌟

উত্তর: দুজন উল্লেখযোগ্য ডিরোজিয়ান ছিলেন রাধানাথ শিকদার এবং প্যারীচাঁদ মিত্র । (অন্যান্যরা: রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়) ।

২৪. প্রশ্ন: নব্যবঙ্গ আন্দোলনের দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। 😟

উত্তর: নব্যবঙ্গ আন্দোলনের দুটি সীমাবদ্ধতা হলো: ১) তাঁদের আন্দোলন মূলত শহরের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, বৃহত্তর বাঙালি সমাজের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি এবং ২) তাঁদের কার্যকলাপ অনেক সময় গঠনমূলক না হয়ে নেতিবাচক ও উগ্র হওয়ায় সাধারণ মানুষ থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন ।

বিধবাবিবাহ আন্দোলন

বিধবাবিবাহ আন্দোলন

২৫. প্রশ্ন: উনিশ শতকে হিন্দু বিধবাদের অবস্থা কেমন ছিল? 💔

উত্তর: উনিশ শতকে হিন্দু সমাজে বিধবাদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয় ও দুর্বিষহ। কৌলীন্য প্রথা ও বাল্যবিবাহের কারণে বহু বালিকা অল্প বয়সেই বিধবা হতো এবং তাদের বাকি জীবন কঠোর আচার-বিচার, বঞ্চনা ও সামাজিক নিগ্রহের মধ্যে কাটাতে হতো; তাদের পুনর্বিবাহেরও কোনো অধিকার ছিল না ।

২৬. প্রশ্ন: বিধবাবিবাহের সমর্থনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কোন হিন্দুশাস্ত্রের উল্লেখ করেছিলেন? 📖

উত্তর: বিধবাবিবাহের সমর্থনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রধানত ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, শাস্ত্রে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের বিধান রয়েছে ।

২৭. প্রশ্ন: বিধবাবিবাহ প্রচলনের দাবিতে বিদ্যাসাগর রচিত একটি পুস্তিকার নাম লেখো। 📕

উত্তর: বিধবাবিবাহ প্রচলনের দাবিতে বিদ্যাসাগর রচিত একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা হলো ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (প্রথম খণ্ড, জানুয়ারি ১৮৫৫) ।

২৮. প্রশ্ন: বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের দুজন সমর্থকের নাম লেখো। 👍

উত্তর: বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের দুজন উল্লেখযোগ্য সমর্থক ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত । (অন্যান্য: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী, দ্বারকানাথ মিত্র, রাজনারায়ণ বসু) ।

২৯. প্রশ্ন: শান্তিপুরের তাঁতশিল্পীরা বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে কীভাবে সমর্থন জানিয়েছিল? 🧵

উত্তর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্যোগে খুশি হয়ে শান্তিপুরের তাঁতশিল্পীরা তাঁদের তৈরি শাড়ির পাড়েতে এই কথা বুনেছিলেন – ‘বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে / সদরে করেছে রিপোর্ট বিধবাদের হবে বিয়ে’

৩০. প্রশ্ন: বিধবাবিবাহ আইন কবে এবং কার আমলে পাস হয়? ⚖️🗓️

উত্তর: বিধবাবিবাহ আইন (Act XV of 1856) ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই, বড়লাট লর্ড ক্যানিং-এর আমলে পাস হয় । (এই সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন লর্ড ডালহৌসি )।

৩১. প্রশ্ন: আইনসম্মতভাবে প্রথম বিধবাবিবাহ কাদের মধ্যে কবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তর: আইনসম্মতভাবে প্রথম বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন এবং বর্ধমানের কালীমতি দেবীর মধ্যে । এই বিবাহ বিদ্যাসাগরের উদ্যোগেই সম্পন্ন হয়েছিল।

৩২. প্রশ্ন: বিদ্যাসাগর তাঁর নিজ পুত্রের সাথে কার বিবাহ দিয়েছিলেন? 👨‍👦

উত্তর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সাথে ভবসুন্দরী দেবী নামে এক বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন ।

ধর্ম সংস্কার, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ

ধর্ম সংস্কার, শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ

৩৩. প্রশ্ন: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ধর্মীয় আদর্শের মূল কথা কী ছিল? 🙏

উত্তর: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ধর্মীয় আদর্শের মূল কথা ছিল ‘সর্বধর্মসমন্বয়’ । তিনি বলতেন, সব ধর্মই সত্য এবং বিভিন্ন পথের মাধ্যমে একই ঈশ্বরকে লাভ করা যায়, অর্থাৎ ‘যত মত, তত পথ’

৩৪. প্রশ্ন: ‘যত মত, তত পথ’ – এই উক্তিটি কার? এর অর্থ কী? 💬

উত্তর: ‘যত মত, তত পথ’ – এই বিখ্যাত উক্তিটি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের । এর অর্থ হলো, ঈশ্বরলাভের জন্য বিভিন্ন ধর্ম ও সাধনার পথ প্রচলিত থাকলেও, সব পথই অবশেষে একই পরম সত্য বা ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়।

৩৫. প্রশ্ন: ‘জীবই শিব’ বা ‘যত্র জীব তত্র শিব’ – এই কথার দ্বারা শ্রীরামকৃষ্ণ কী বুঝিয়েছেন? 🌍❤️

উত্তর: ‘জীবই শিব’ বা ‘যত্র জীব তত্র শিব’ – এই কথার দ্বারা শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝিয়েছেন যে, প্রতিটি জীবের মধ্যেই ঈশ্বর বা শিব বিরাজমান । তাই জীবের সেবা করাই হলো ঈশ্বরের প্রকৃত সেবা করা ।

৩৬. প্রশ্ন: স্বামী বিবেকানন্দ কে ছিলেন? 🧘‍♂️

উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ (পূর্বাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য এবং একজন বিশ্ববরেণ্য হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক ও সমাজসংস্কারক । তিনি ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ ও বেদান্ত দর্শনকে পাশ্চাত্যে প্রচার করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

৩৭. প্রশ্ন: ‘নব্য বেদান্ত’ কী? এর প্রধান প্রবক্তা কে? 💡

উত্তর: ‘নব্য বেদান্ত’ হলো স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রচারিত বেদান্ত দর্শনের এক আধুনিক, যুক্তিনিষ্ঠ ও মানবতাবাদী ব্যাখ্যা । এর মূল কথা হলো, সকল মানুষ পরমাত্মার অংশ এবং মানবসেবাই হলো ঈশ্বরসেবার শ্রেষ্ঠ পথ। এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ

৩৮. প্রশ্ন: স্বামী বিবেকানন্দ কবে, কোথায় বিশ্বধর্ম সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছিলেন?🗣️

উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ই সেপ্টেম্বর আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে (Parliament of Religions) তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন।

৩৯. প্রশ্ন: রামকৃষ্ণ মিশন কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন? এর প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল? 🌟

উত্তর: রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী বিবেকানন্দ, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে । এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শ্রীরামকৃষ্ণের ‘সর্বধর্মসমন্বয়’ ও ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র আদর্শ প্রচার করা এবং আর্ত, দুস্থ ও পীড়িত মানুষের নিঃস্বার্থ সেবা করা ।

৪০. প্রশ্ন: ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ – এই বিখ্যাত উক্তিটি কার? ❤️

উত্তর: ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ – এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ

অন্যান্য সংস্কারক ও আন্দোলন

৪১. প্রশ্ন: লালন ফকির কে ছিলেন? তাঁর একটি বিখ্যাত গানের পংক্তি লেখো। 🎶

উত্তর: লালন ফকির (আনুমানিক ১৭৭৪-১৮৯০) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন মরমী বাউল সাধক, গীতিকার, সুরকার ও সমাজসংস্কারক । তাঁর একটি বিখ্যাত গানের পংক্তি হলো: “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে / লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে”

৪২. প্রশ্ন: বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কে ছিলেন? তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রমের নাম লেখো। 🙏

উত্তর: বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৪১-১৮৯৯) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন বিশিষ্ট ধর্মপ্রচারক ও সমাজসংস্কারক । তিনি প্রথমে ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিলেও পরে বৈষ্ণবধর্মে ফিরে আসেন এবং নব্য-বৈষ্ণব আন্দোলনের সূচনা করেন । তিনি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

৪৩. প্রশ্ন: হাজী মহম্মদ মহসীন কে ছিলেন? শিক্ষাবিস্তারে তাঁর একটি অবদান উল্লেখ করো।

উত্তর: হাজী মহম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২) ছিলেন হুগলির একজন বিখ্যাত মানবদরদি ও দানবীর ব্যক্তি । শিক্ষাবিস্তারে তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, তাঁর দান করা অর্থে পরবর্তীকালে হুগলি মহসীন কলেজ (১৮৩৬) সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইমামবাড়া হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল ।

৪৪. প্রশ্ন: ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন? এই সভার একটি পত্রিকার নাম লেখো। 📖

উত্তর: ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে । এই সভার প্রধান মুখপত্র বা পত্রিকা ছিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (প্রথম সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত) ।

৪৫. প্রশ্ন: ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ গ্রন্থটি কার লেখা? 📜

উত্তর: ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ গ্রন্থটি লিখেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

৪৬. প্রশ্ন: “ভারতবর্ষীয়দের জন্য বিজ্ঞানচর্চা” – এই বিষয়ে লর্ড আমহার্স্টকে কে চিঠি লিখেছিলেন? 🔬

উত্তর: “ভারতবর্ষীয়দের জন্য বিজ্ঞানচর্চা” (অর্থাৎ পাশ্চাত্য বিজ্ঞান শিক্ষা) প্রবর্তনের দাবি জানিয়ে লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি লিখেছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে) ।

✒️ খ) বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical – প্রতিটি ৪ নম্বর) (উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার)

প্রশ্ন ১: উনিশ শতকে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনের উত্থানের প্রধান কারণগুলি কী ছিল? 🤔📈

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলনের উত্থানের পেছনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিদ্যমান ছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার প্রভাব এবং কিছু ভারতীয় মনীষীর উদ্যোগ এই প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাহায্য করে।

প্রধান কারণসমূহ:

  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসারের ফলে যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটে । এর ফলে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ প্রচলিত কুসংস্কার ও অমানবিক প্রথাগুলির বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে ওঠে।
  • খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ: খ্রিস্টান মিশনারিরা ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের কিছু দিক সমালোচনা করলেও, তাঁদের সেবামূলক কাজ ও শিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ পরোক্ষে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
  • দেশীয় মনীষীদের উদ্যোগ: রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ সমাজসংস্কারকগণ প্রচলিত কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
  • পত্রপত্রিকার ভূমিকা: উনিশ শতকে প্রকাশিত বিভিন্ন বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র (যেমন – ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’) সামাজিক সমস্যাগুলি তুলে ধরে জনমত গঠনে সাহায্য করেছিল।

উপসংহার: এই সমস্ত কারণগুলির সম্মিলিত প্রভাবে উনিশ শতকের বাংলায় এক শক্তিশালী সমাজসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল, যা বাংলার সামাজিক জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

প্রশ্ন ২: ব্রাহ্মসমাজ কীভাবে উনিশ শতকের বাংলা সমাজে কুসংস্কার দূর করতে সচেষ্ট হয়েছিল? ⚛️🚫

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থাটি হিন্দু সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল।

কুসংস্কার দূরীকরণে ব্রাহ্মসমাজের প্রচেষ্টা:

  • সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা: ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন । তাঁর প্রচেষ্টাতেই এই অমানবিক প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয় ।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: ব্রাহ্মসমাজ জাতিভেদ প্রথার অসারতা প্রচার করে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে । কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে অসবর্ণ বিবাহকে উৎসাহিত করা হয় ।
  • বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা: ব্রাহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের মতো ক্ষতিকর প্রথাগুলির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এবং এগুলি বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানায় । এর ফলেই ‘তিন আইন’ (১৮৭২) পাস হয় ।
  • পৌত্তলিকতা ও আচারসর্বস্বতার বিরোধিতা: ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের আচারসর্বস্বতা ও পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে একেশ্বরবাদী নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার ওপর গুরুত্ব দেয় ।

উপসংহার: ব্রাহ্মসমাজের সংস্কার প্রচেষ্টাগুলি মূলত শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, তা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মনেও সচেতনতা সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল এবং হিন্দু সমাজকে অনেকটাই কুসংস্কারমুক্ত করেছিল।

প্রশ্ন ৩: সতীদাহ প্রথা রদ করার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো। 🔥👩❌

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় হিন্দু সমাজে প্রচলিত সতীদাহ প্রথার মতো এক অমানবিক ও নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে যিনি সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায় ।

রামমোহনের ভূমিকা:

  • শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার প্রয়োগ: রামমোহন রায় বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র, বিশেষত ‘মনুসংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহ প্রথা শাস্ত্রসম্মত নয় এবং শাস্ত্র একে সমর্থন করে না ।
  • জনমত গঠন: তিনি ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামে পুস্তিকা প্রকাশ করে এবং তাঁর সম্পাদিত ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় একাধিক প্রবন্ধ লিখে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে সচেষ্ট হন।
  • সরকারি আবেদন: রামমোহন রায় এই কুপ্রথা বন্ধ করার জন্য তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে বহু বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষরসহ আবেদনপত্র পেশ করেন ।
  • আইন প্রণয়নে সহায়তা: তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও যুক্তির প্রভাবেই লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।

উপসংহার: রাজা রামমোহন রায়ের অক্লান্ত সংগ্রাম ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের ফলেই হিন্দু সমাজ থেকে সতীদাহের মতো একটি বর্বর প্রথার অবসান ঘটে, যা ছিল উনিশ শতকের সমাজসংস্কারের ইতিহাসে এক বিশাল সাফল্য।

প্রশ্ন ৪: ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠীর সমাজসংস্কারমূলক কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 🧑‍🎓✨💥

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে একদল যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল ছাত্র যে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, সেই গোষ্ঠী ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ।

কার্যকলাপ:

  • যুক্তিবাদ ও স্বাধীন চিন্তার প্রসার: ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে কোনো কিছু বিনা বিচারে মেনে না নেওয়ার এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মানসিকতা তৈরি করেছিলেন । তাঁরা টমাস পেইন, হিউম, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ দার্শনিকের যুক্তিবাদী দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ।
  • ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা: ডিরোজিও ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন । এখানে হিন্দু সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার যেমন – জাতিভেদপ্রথা, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, নারীদের প্রতি বৈষম্য ইত্যাদি বিষয়ে সদস্যরা তীব্র সমালোচনা করতেন ।
  • প্রথা বিরোধিতা: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি ও রক্ষণশীলতাকে আক্রমণ করার জন্য অনেক সময় প্রচলিত প্রথা ভাঙতেন, যেমন – নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করা বা উপবীত ছিঁড়ে ফেলা ।
  • পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রচার: তাঁরা ‘এথেনিয়াম’, ‘পার্থেনন’, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এনকোয়ারার’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে তাঁদের প্রগতিশীল মতামত প্রচার করতেন।

উপসংহার: নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন অনেক সময় উগ্র ও নেতিবাচক বলে সমালোচিত হলেও, তাঁদের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উনিশ শতকের বাংলায় এক নতুন চিন্তার ঢেউ তুলেছিল এবং নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করতে সাহায্য করেছিল।

প্রশ্ন ৫: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ⚭📜❤️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত বিধবাবিবাহ আন্দোলন হিন্দু সমাজে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল।

আন্দোলনের বিবরণ:

  • শাস্ত্রীয় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা: বিদ্যাসাগর প্রথমে হিন্দুশাস্ত্র, বিশেষত ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, শাস্ত্রে বিধবাদের পুনর্বিবাহের বিধান রয়েছে । এই বিষয়ে তিনি ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫) নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা রচনা করেন ।
  • জনমত গঠন ও আবেদন: তিনি বিধবাবিবাহের সপক্ষে জনমত গঠনের জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন এবং প্রায় এক হাজার মানুষের স্বাক্ষরসহ একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পেশ করেন ।
  • আইন পাস: বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং যুক্তির প্রভাবে সরকার প্রভাবিত হয়। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই বড়লাট লর্ড ক্যানিং ১৫ নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করেন ।
  • বাস্তবায়ন: আইন পাস হওয়ার পর বিদ্যাসাগর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালীমতী দেবীর মধ্যে প্রথম আইনসম্মত বিধবাবিবাহ সম্পন্ন করান । তিনি নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রেরও এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন এবং বহু বিধবাবিবাহের আয়োজন করে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন ।

উপসংহার: রক্ষণশীল সমাজের তীব্র বিরোধিতা ও ব্যক্তিগত আক্রমণ সত্ত্বেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৃঢ় নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলন সাফল্য লাভ করে, যা ছিল নারীমুক্তি তথা উনিশ শতকের সমাজসংস্কারের ইতিহাসে এক অসামান্য অর্জন।

প্রশ্ন ৬: উনিশ শতকের ব্রাহ্ম আন্দোলনের বিবর্তন ও বিভাজন সংক্ষেপে আলোচনা করো। ⚛️➡️🌿

উত্তর: ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভা (পরে ব্রাহ্মসমাজ) উনিশ শতকের ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সময়ের সাথে সাথে এই আন্দোলন বিভিন্ন বিবর্তন ও বিভাজনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল।

বিবর্তন ও বিভাজন:

  • রামমোহন পর্ব (১৮২৮-১৮৩৩): এই পর্বে একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা, পৌত্তলিকতা ও সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা ছিল প্রধান লক্ষ্য ।
  • দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর্ব (১৮৪৩ পরবর্তী): রামমোহনের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন । তিনি ব্রাহ্মসমাজকে ব্রাহ্মধর্মে রূপান্তরিত করেন, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র মাধ্যমে মতাদর্শ প্রচার করেন এবং বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করে নিজস্ব ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ তৈরি করেন ।
  • কেশবচন্দ্র সেনের পর্ব ও প্রথম বিভাজন (১৮৫৭ পরবর্তী): কেশবচন্দ্র সেন ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিলে আন্দোলন আরও গতিশীল ও সমাজসংস্কারমুখী হয় । জাতিভেদ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে এবং অসবর্ণ বিবাহ ও নারীশিক্ষার পক্ষে তিনি জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন । কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দিলে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র ও তাঁর অনুগামীরা বেরিয়ে এসে ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন । দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বাধীন মূল সংগঠনটি তখন ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয় ।
  • দ্বিতীয় বিভাজন (১৮৭৮): কেশবচন্দ্র সেনের কিছু কার্যকলাপ (যেমন – গুরুবাদে বিশ্বাস, নিজের অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ) নিয়ে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে মতবিরোধ দেখা দেয় । এর ফলে শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ নেতারা বেরিয়ে এসে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন । কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বাধীন অংশটি ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয় ।

উপসংহার: একাধিকবার বিভাজিত হলেও, ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রতিটি ধারাই উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মীয় গোঁড়ামি হ্রাস, সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ এবং উদারনৈতিক ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

প্রশ্ন ৭: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ‘সর্বধর্মসমন্বয়’-এর আদর্শ ব্যাখ্যা করো। 🙏🕉️✝️☪️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতবর্ষের ধর্ম ও সমাজজীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬) এক নতুন আধ্যাত্মিক চেতনার সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মীয় আদর্শের মূল কথাই ছিল ‘সর্বধর্মসমন্বয়’ ।

সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ:

  • সকল ধর্মই সত্য: শ্রীরামকৃষ্ণ কোনো বিশেষ একটি ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বা একমাত্র পথ বলে মনে করতেন না। তিনি হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের সাধনা করে উপলব্ধি করেছিলেন যে, সকল ধর্মের মূল লক্ষ্য একই – ঈশ্বর বা পরম সত্যকে লাভ করা ।
  • ‘যত মত, তত পথ’: এই বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন যে, বিভিন্ন ধর্মমত ও সাধনার পথ ভিন্ন ভিন্ন হলেও, সেগুলি সবই একই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর বিভিন্ন রাস্তা মাত্র । যেমন বিভিন্ন ঘাট দিয়ে একই পুকুরের জল তোলা যায়, তেমনই বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে একই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়।
  • ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা: তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বাহ্যিক আড়ম্বরের চেয়ে আন্তরিক ভক্তি ও বিশ্বাসকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করতে সহায়ক হয়েছিল।
  • মানবসেবার আদর্শ: তিনি মানবসেবাকেই ঈশ্বরের সেবা (‘জীবই শিব’ বা ‘যত্র জীব তত্র শিব’ ) বলে মনে করতেন, যা তাঁর সর্বধর্মসমন্বয়ের ধারণাকে আরও মানবিক ও সার্বজনীন করে তুলেছিল।

উপসংহার: শ্রীরামকৃষ্ণের ‘সর্বধর্মসমন্বয়’-এর আদর্শ উনিশ শতকের ধর্মীয় বিভেদ ও সংকীর্ণতার আবহে এক নতুন সমন্বয় ও সম্প্রীতির বার্তা বহন করে এনেছিল, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

প্রশ্ন ৮: স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত‘-এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল? 💡💪

উত্তর: ভূমিকা: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) প্রাচীন ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের এক যুগোপযোগী, মানবতাবাদী ও কর্মমুখী ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা ‘নব্য বেদান্ত’ নামে পরিচিত ।

প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি:

  • মানুষ তৈরির ধর্ম (Man-making religion): বিবেকানন্দের নব্য বেদান্তের মূল কথাই ছিল মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশ ঘটানো। তিনি বলতেন, ধর্ম শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান বা তত্ত্বকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হলো মানুষ তৈরির প্রক্রিয়া, যা শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটায় ।
  • জীবে প্রেম ও সেবা (Practical Vedanta): তিনি বেদান্তের অদ্বৈতবাদকে শুধুমাত্র দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে না দেখে, তাকে সাধারণ মানুষের সেবায় প্রয়োগ করার ওপর জোর দেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” এবং ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’র আদর্শ এই ভাবনারই প্রতিফলন।
  • আত্মবিশ্বাস ও নির্ভীকতা: নব্য বেদান্ত মানুষকে আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী ও নির্ভীক হতে শেখায় । তিনি যুবসমাজকে শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা ত্যাগ করে পৌরুষ ও শক্তির সাধনা করতে আহ্বান জানান।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা ও সমন্বয়: বিবেকানন্দ জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির মেলবন্ধনের কথা বলেছিলেন ।
  • আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বজনীনতা: ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে তিনি হিন্দুধর্ম তথা বেদান্তের বিশ্বজনীন ও উদার মানবিক দিকটি তুলে ধরেছিলেন ।

উপসংহার: স্বামী বিবেকানন্দের নব্য বেদান্ত ছিল একাধারে আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক। এটি ভারতীয় যুবসমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, দেশপ্রেম ও সেবার আদর্শ সঞ্চারিত করে জাতীয় পুনর্জাগরণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রশ্ন ৯: উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের সীমাবদ্ধতাগুলি উল্লেখ করো। 😟🏙️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুধর্ম ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এই আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল, যা এর ব্যাপক প্রসারকে ব্যাহত করেছিল।

সীমাবদ্ধতাগুলি:

  • শহরকেন্দ্রিকতা ও শিক্ষিত সমাজে সীমাবদ্ধতা: ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন মূলত কলকাতা ও অন্যান্য কয়েকটি শহরের ইংরেজি শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বা সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে এর বিশেষ যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি ।
  • মুসলিম সমাজের থেকে দূরত্ব: ব্রাহ্ম আন্দোলন প্রধানত হিন্দু সমাজের সংস্কারের কাজেই নিয়োজিত ছিল। বাংলার মুসলিম সমাজের সমস্যা বা সংস্কার নিয়ে তাঁদের বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি ।
  • নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য ও বিভাজন: ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়, যার ফলে এই সমাজ একাধিকবার (১৮৬৬ ও ১৮৭৮ সালে) বিভাজিত হয় । এই বিভাজনগুলি আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছিল ।
  • জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা: কিছু ক্ষেত্রে ব্রাহ্মদের আচার-আচরণ ও জীবনযাত্রা সাধারণ হিন্দু সমাজ থেকে এতটাই পৃথক ছিল যে, তাঁরা সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

উপসংহার: এই সীমাবদ্ধতাগুলি থাকা সত্ত্বেও, ব্রাহ্মসমাজ উনিশ শতকের বাংলায় যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, একেশ্বরবাদ এবং বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রশ্ন ১০: রাজা রামমোহন রায়কে কেন ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলা হয়?✨

উত্তর: ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায়কে (১৭৭২-১৮৩৩) ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ এবং ‘ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলে অভিহিত করা হয়। তাঁর চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপের মধ্যে আধুনিক যুগের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।

‘প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলার কারণ:

  • যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি: রামমোহন রায় ধর্ম ও সমাজকে যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করতেন। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের পরিবর্তে যুক্তিনিষ্ঠ ও মানবতাবাদী আদর্শের ওপর গুরুত্ব দিতেন ।
  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি আগ্রহ: তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতের অগ্রগতির জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা অপরিহার্য। তাই তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন ।
  • সমাজ সংস্কারে উদ্যোগ: সতীদাহ প্রথার মতো অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং তা আইন করে রদ করতে সাহায্য করেন । এছাড়াও, তিনি জাতিভেদ প্রথা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন ।
  • ধর্মীয় সংস্কার ও সমন্বয়: তিনি হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা ও আচারসর্বস্বতার বিরোধিতা করে একেশ্বরবাদের প্রচার করেন এবং ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনেরও চেষ্টা করেন।
  • সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সচেতনতা: রামমোহন রায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেন এবং ভারতীয়দের রাজনৈতিক অধিকার বিষয়েও সচেতন ছিলেন । তিনি বাংলা ও ফারসি ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন ।

উপসংহার: রামমোহন রায়ের বহুমুখী প্রতিভা, দূরদৃষ্টি, যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা এবং প্রগতিশীল কার্যকলাপ তাঁকে উনিশ শতকের ভারতে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল, যার জন্য তাঁকে ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ অভিধায় ভূষিত করা হয়

প্রশ্ন ১১: উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে কেশবচন্দ্র সেনের ভূমিকা আলোচনা করো। 🗣️📜

উত্তর:ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৪) ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ব্রহ্মানন্দ’ উপাধি দেন এবং তিনি ব্রাহ্মসমাজের আচার্য পদেও নিযুক্ত হন ।

সমাজ সংস্কারে ভূমিকা:

  • সামাজিক কুপ্রথার বিরোধিতা: কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন । তাঁরা অসবর্ণ বিবাহের পক্ষেও সওয়াল করেন ।
  • ‘তিন আইন’ (নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৮৭২) প্রণয়ন: তাঁর এবং ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘তিন আইন’ পাস করতে বাধ্য হয় । এই আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয় এবং অসবর্ণ বিবাহকে আইনসিদ্ধ করা হয় ।
  • নারীশিক্ষার প্রসার: তিনি নারীশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে সিটি স্কুল, ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় প্রভৃতি স্থাপন করা হয়েছিল ।
  • অন্যান্য জনহিতকর কাজ: শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো এবং মদ্যপানের প্রবণতা কমানোর মতো জনহিতকর কাজেও তিনি উদ্যোগী ছিলেন ।

উপসংহার: কেশবচন্দ্র সেনের সংস্কারমূলক কার্যকলাপ উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক অগ্রগতিতে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল, যদিও তাঁর কিছু ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত (যেমন – অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ) পরবর্তীকালে বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।

প্রশ্ন ১২: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে ব্রাহ্ম আন্দোলনকে সংগঠিত ও পরিচালিত করেছিলেন? ⚛️✨

উত্তর:ভূমিকা: রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর (১৮৩৩) পর ব্রাহ্ম আন্দোলন যখন কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছিল, তখন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) এই আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেন এবং একে একটি সুসংহত রূপ দেন।

সংগঠন ও পরিচালনায় ভূমিকা:

  • তত্ত্ববোধিনী সভা ও পত্রিকা: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা সংস্কারমুক্ত ধর্ম আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয় । এই সভার মুখপত্র হিসেবে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (১৮৪৩) প্রকাশ করে তিনি ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ ও চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেন ।
  • ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ ও প্রচার: তিনি নিজে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন (১৮৪৩) এবং এই ধর্মমত প্রচারের জন্য প্রচারক নিযুক্ত করেন । তিনি ‘ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠান পদ্ধতি’ নামে একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন ।
  • বেদভিত্তিক সংস্কার: প্রথমদিকে তিনি হিন্দুধর্মের আদি গ্রন্থ ‘বেদ’-কে ব্রাহ্মধর্মের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যদিও পরবর্তীকালে তিনি বেদের অভ্রান্ততা ত্যাগ করে উপনিষদের একেশ্বরবাদের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।
  • খ্রিস্টান ও উগ্র পাশ্চাত্য প্রভাবের বিরোধিতা: তিনি খ্রিস্টান মিশনারি ও উগ্র পাশ্চাত্যপন্থীদের হিন্দুধর্মের ওপর অযৌক্তিক আক্রমণের প্রবলভাবে সমালোচনা করতেন ।

উপসংহার: দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ একটি সংগঠিত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, যা উনিশ শতকের বাংলার সমাজ জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

প্রশ্ন ১৩: উনিশ শতকের বাংলায় সতীদাহ প্রথা বিলোপের গুরুত্ব কী ছিল? 🔥👩🚫➡️💖

উত্তর:ভূমিকা: ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কর্তৃক সতীদাহ প্রথা আইন করে নিষিদ্ধকরণ ছিল উনিশ শতকের বাংলার সমাজ সংস্কারের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী।

গুরুত্ব:

  • নারীমুক্তি: এই আইন নারীদের এক নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল । এটি ছিল নারীমুক্তির পথে এক বিশাল পদক্ষেপ, যা সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
  • মানবতাবাদের জয়: সতীদাহ প্রথার অবসান ছিল মানবতাবাদের এক বিরাট জয়। যুক্তিবাদ ও মানবিক মূল্যবোধ শাস্ত্রীয় গোঁড়ামির ওপর প্রাধান্য পেয়েছিল।
  • সমাজ সংস্কারে প্রেরণা: সতীদাহ প্রথার মতো একটি গভীর প্রোথিত কুসংস্কার দূর করা সম্ভব হওয়ায়, অন্যান্য সমাজ সংস্কারকরাও (যেমন – বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর) উৎসাহিত হয়েছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও জনমত গঠনের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
  • আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা: এই আইন প্রমাণ করে যে, সামাজিক প্রথা হলেও, যদি তা অমানবিক ও নিষ্ঠুর হয়, তবে রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে তা বন্ধ করা যেতে পারে।

উপসংহার: সতীদাহ প্রথা বিলোপ শুধুমাত্র একটি সামাজিক কুপ্রথার অবসান ঘটায়নি, বরং এটি বাংলার সমাজে আধুনিকতা, যুক্তিবাদ ও মানবিকতার প্রসারের পথকেও প্রশস্ত করেছিল।

সতীদাহ প্রথা

প্রশ্ন ১৪: নব্যবঙ্গ (ইয়ং বেঙ্গল) আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এর ইতিবাচক অবদানগুলি কী ছিল? ✨🤔✅

উত্তর:ভূমিকা: ডিরোজিওর নেতৃত্বে পরিচালিত নব্যবঙ্গ আন্দোলন উনিশ শতকের বাংলায় এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এই আন্দোলনের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও, এর বেশ কিছু ইতিবাচক অবদানও ছিল, যা অস্বীকার করা যায় না।

ইতিবাচক অবদান:

  • যুক্তিবাদ ও স্বাধীন চিন্তার প্রসার: নব্যবঙ্গীয়রা সর্বপ্রথম বাংলার যুবসমাজে যুক্তিবাদ, বিচারবিশ্লেষণ ও স্বাধীন চিন্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁরা কোনো কিছু অন্ধভাবে মেনে নেওয়ার পরিবর্তে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন ।
  • সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: তাঁরা হিন্দু সমাজের প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, সতীদাহ প্রথা ও অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ।
  • সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল: নব্যবঙ্গীয়রা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে এবং সরকারি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করতেন ।
  • পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা: তাঁদের নির্ভীকতা, স্বদেশপ্রেম এবং প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কারক ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ‘বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক’ বলে অভিহিত করেছেন ।

সীমাবদ্ধতা (সংক্ষেপে): তাঁদের আন্দোলন মূলত শহরকেন্দ্রিক ও শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং অনেক সময় তাঁদের পদ্ধতি উগ্র হওয়ায় সাধারণ মানুষের সমর্থন তাঁরা পাননি

উপসংহার: সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, নব্যবঙ্গ আন্দোলন উনিশ শতকের বাংলায় এক বৌদ্ধিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং আধুনিকমনস্কতার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রশ্ন ১৫: আদি ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলি কী ছিল? ⚛️🆚🌿

উত্তর:ভূমিকা: ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন আদি ব্রাহ্মসমাজ এবং কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। এই দুটি সমাজের মধ্যে আদর্শ ও কার্যপদ্ধতিগত কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল।

প্রধান পার্থক্যগুলি:

বিষয়আদি ব্রাহ্মসমাজ (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর)ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (কেশবচন্দ্র সেন)
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্মেরই একটি পরিশুদ্ধ রূপ হিসেবে দেখত । বেদ ও উপনিষদের ওপর গুরুত্ব দিত (যদিও পরে দেবেন্দ্রনাথ বেদের অভ্রান্ততা ত্যাগ করেন)।ব্রাহ্মধর্মকে একটি বিশ্বজনীন ও সমন্বয়বাদী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। অন্যান্য ধর্ম থেকেও উপাদান গ্রহণে আগ্রহী ছিল।
সমাজ সংস্কারসমাজ সংস্কারের চেয়ে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দিকের ওপর বেশি জোর দিত । জাতিভেদ প্রথার সমর্থক ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ সমাজ সংস্কারকে (যেমন – অসবর্ণ বিবাহ, নারীশিক্ষা, জাতিভেদ প্রথার বিলোপ) ব্রাহ্ম আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে দেখত । এটি ছিল অনেক বেশি প্রগতিশীল।
উপাসনা পদ্ধতি ও আচার্যউপাসনা পদ্ধতিতে ঐতিহ্য বজায় রাখতে চেয়েছিল। আচার্যদের উপবীত ধারণের পক্ষে ছিল।উপাসনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সরলীকরণের পক্ষপাতী ছিল। আচার্যদের উপবীত ত্যাগ এবং সকল বর্ণের মানুষের উপাসনা পরিচালনার অধিকার দাবি করেছিল
আন্দোলনের প্রকৃতিমূলত রক্ষণশীল ও ধীরগতির সংস্কারে বিশ্বাসী ছিল।অপেক্ষাকৃত দ্রুত ও আমূল সংস্কারের পক্ষপাতী ছিল এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয় ও উদ্যমী ছিল।

উপসংহার: এই পার্থক্যগুলির কারণেই ব্রাহ্ম আন্দোলন বিভাজিত হয়েছিল, তবে উভয় শাখাই উনিশ শতকের বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে নিজস্ব পন্থায় অবদান রেখেছিল।

প্রশ্ন ১৬: হাজী মহম্মদ মহসীন কীভাবে বাংলার মুসলিম সমাজের উন্নয়নে অবদান রেখেছিলেন? 🕌💰❤️

উত্তর:ভূমিকা: দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার এক বিশিষ্ট মানবদরদি ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁর বিপুল সম্পদ মুসলিম সমাজের উন্নয়ন তথা আপামর জনসাধারণের কল্যাণে দান করে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

মুসলিম সমাজের উন্নয়নে অবদান:

  • শিক্ষা বিস্তারে সহায়তা: মহসীন উপলব্ধি করেছিলেন যে, মুসলিম সমাজের অগ্রগতির জন্য আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। তাঁর দান করা অর্থে পরবর্তীকালে ‘মহসীন শিক্ষা তহবিল’ (১৮৩৫) গঠিত হয়, যা বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ও দরিদ্র মুসলিম ছাত্রদের পড়াশোনায় সাহায্য করে।
  • হুগলি মহসীন কলেজ প্রতিষ্ঠা: তাঁর অর্থে এবং শিক্ষানুরাগী মেটকাফের উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে মহসীন কলেজ (বর্তমানে হুগলি মহসীন কলেজ) স্থাপিত হয়, যা বাংলার মুসলিম যুবকদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করে।
  • মাদ্রাসা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন: তাঁর অর্থে হুগলি কলেজিয়েট স্কুল, হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুল, হুগলি মাদ্রাসা-সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হুগলির ইমামবাড়া (১৮৪১) ও ইমামবাড়া হাসপাতাল (১৮৩৬) স্থাপিত ও পরিচালিত হয়।
  • ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে দান: তিনি তাঁর সম্পূর্ণ সম্পত্তি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক ও ধর্মীয় কাজে দান করেছিলেন (১৮০৬) । ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের (১৭৭০) সময় তাঁর দানে বহু নিরন্ন মানুষ প্রাণ ফিরে পেয়েছিল ।

উপসংহার: হাজী মহম্মদ মহসীনের নিঃস্বার্থ দান ও দূরদৃষ্টি বাংলার মুসলিম সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামগ্রিক উন্নয়নে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর মহৎ অবদানের জন্য তিনি আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।

প্রশ্ন ১৭: উনিশ শতকে লালন ফকিরের ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তাধারার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল? 🎶🤝

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার এক অসামান্য আধ্যাত্মিক সাধক, গীতিকার ও সমাজচিন্তাবিদ ছিলেন লালন ফকির (আনুমানিক ১৭৭৪-১৮৯০) । তাঁর গান ও জীবনদর্শনের মাধ্যমে তিনি ধর্মীয় সমন্বয় ও সামাজিক সাম্যের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রচার করেছিলেন।

চিন্তাধারার মূল বৈশিষ্ট্য:

  • ধর্মীয় সমন্বয় ও গোঁড়ামির বিরোধিতা: লালন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী ছিলেন না । তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন এবং তাঁর গানে এই দুই ধারার মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেন । তিনি গেয়েছেন, “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে / লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে” ।
  • মানবতাবাদ ও ‘মনের মানুষ’-এর ধারণা: লালনের দর্শনের কেন্দ্রে ছিল মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন, সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক ‘মনের মানুষ’, যার কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদ নেই । এই ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধানই ছিল তাঁর সাধনার মূল লক্ষ্য।
  • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা ও ধর্মীয় ভেদাভেদের তীব্র সমালোচনা করেন । তাঁর কাছে সকল মানুষই ছিল সমান।
  • সহজ ভাষায় গভীর তত্ত্ব: লালন কোনো প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও, তাঁর গানগুলির মাধ্যমে তিনি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় জীবনের গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন।

উপসংহার: লালন ফকিরের সমন্বয়বাদী ও মানবতাবাদী চিন্তাধারা উনিশ শতকের বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে এক নতুন আলো ফেলেছিল এবং তা আজও বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।

প্রশ্ন ১৮: বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ধর্মীয় জীবনের বিবর্তন ও তাঁর নব্য-বৈষ্ণব আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। 🙏➡️💖

উত্তর: ভূমিকা: বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৪১-১৮৯৯) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার এক বিশিষ্ট ধর্মসাধক ও সমাজসংস্কারক, যাঁর ধর্মীয় জীবনে উল্লেখযোগ্য বিবর্তন দেখা যায় । তিনি প্রথমে ব্রাহ্ম আন্দোলনে যুক্ত হলেও, পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। ধর্মীয় জীবনের বিবর্তন:

  • ব্রাহ্মসমাজে যোগদান: সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনার সময় বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন এবং কিছুদিন কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেও কাজ করেন ।
  • ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ: পরবর্তীকালে যোগসাধনা এবং বৈষ্ণব ভাবধারার প্রতি তাঁর আকর্ষণ বৃদ্ধি পেলে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তাঁর মতভেদ দেখা দেয়। তিনি ব্রাহ্মসমাজের আচার্যের পদ থেকে বিতাড়িত হন (১৮৮৬ খ্রি.)।
  • বৈষ্ণবধর্মে প্রত্যাবর্তন ও নব্য-বৈষ্ণব আন্দোলন: ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করার পর তিনি বৈষ্ণবধর্মে ফিরে আসেন এবং ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ধর্মসাধনায় মন দেন । তিনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর নীতি ও আদর্শ প্রচার করেন এবং এক নতুন ধারার বৈষ্ণব ভাবান্দোলনের (নব্য-বৈষ্ণব আন্দোলন) সূচনা করেন । অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ তাঁর এই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ।

উপসংহার: বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর ধর্মীয় জীবনের বিবর্তন ও তাঁর প্রচারিত নব্য-বৈষ্ণব ভাবধারা উনিশ শতকের বাংলার ধর্মীয় চিন্তায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।

প্রশ্ন ১৯: উনিশ শতকের বাংলা সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল? 😟🏙️👥

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, নারীশিক্ষার প্রসারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কার সাধিত হয়েছিল। তবে এই সংস্কার আন্দোলনগুলির কিছু অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাও ছিল।

প্রধান সীমাবদ্ধতা:

  • শহরকেন্দ্রিকতা: সংস্কার আন্দোলনগুলি মূলত কলকাতা ও কয়েকটি শহরের ইংরেজি শিক্ষিত, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বা সাধারণ মানুষের কাছে এর প্রভাব সেভাবে পৌঁছায়নি ।
  • জনবিচ্ছিন্নতা: অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারকদের চিন্তাভাবনা ও জীবনযাত্রা সাধারণ মানুষের থেকে এতটাই পৃথক ছিল যে, তাঁরা জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেননি।
  • মুসলিম সমাজের থেকে দূরত্ব: এই সংস্কার আন্দোলনগুলি প্রধানত হিন্দু সমাজের সমস্যা ও কুপ্রথা কেন্দ্রিক ছিল । বাংলার মুসলিম সমাজের সংস্কার বা তাদের সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এই সময়ে দেখা যায়নি, ফলে তারা এই আন্দোলনের বাইরেই থেকে গিয়েছিল।
  • সরকারি সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা: অনেক সংস্কারমূলক আইন (যেমন – সতীদাহ নিবারণ আইন, বিধবাবিবাহ আইন) প্রণয়নের জন্য সংস্কারকদের ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল।

উপসংহার: এই সীমাবদ্ধতাগুলি থাকা সত্ত্বেও, উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনগুলি বাংলার সামাজিক অচলায়তন ভাঙতে এবং আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু করতে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রশ্ন ২০: ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ কীভাবে উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারে সাহায্য করেছিল? 📖💡

উত্তর: ভূমিকা: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ (১৮৩৯) এবং এই সভার মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ (১৮৪৩) উনিশ শতকের বাংলার ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

সংস্কারমূলক ভূমিকা:

  • ব্রাহ্মধর্মের প্রচার ও ব্যাখ্যা: ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ব্রাহ্মধর্মের মূল আদর্শ, উপনিষদের একেশ্বরবাদী চিন্তাধারা এবং রামমোহন রায়ের ভাবধারাকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিত । এটি ব্রাহ্ম আন্দোলনকে একটি সুসংহত রূপ দিতে সাহায্য করে।
  • হিন্দুধর্মের কুসংস্কারের বিরোধিতা: পত্রিকাটি হিন্দু সমাজে প্রচলিত পৌত্তলিকতা, আচারসর্বস্বতা এবং অন্যান্য কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা প্রকাশ করত ।
  • সমাজ সংস্কারে সমর্থন: ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ বিভিন্ন সমাজ সংস্কারমূলক কাজের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রবন্ধ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নারীশিক্ষা, বাল্যবিবাহ রোধ ইত্যাদি বিষয়েও আলোচনা করা হতো।
  • জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার: ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ের পাশাপাশি এই পত্রিকায় ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য বিষয়ক উচ্চমানের প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো, যা বাঙালির মনন গঠনে ও জ্ঞানচর্চার প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। অক্ষয়কুমার দত্তের মতো যুক্তিবাদী লেখকের লেখা এই পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো।

উপসংহার: ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ উনিশ শতকের বাংলায় এক যুক্তিবাদী, উদারনৈতিক ও সংস্কারমুখী বাতাবরণ তৈরি করতে এবং ব্রাহ্ম আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রশ্ন ২১: স্বামী বিবেকানন্দের ‘ব্যবহারিক বেদান্ত’ বা ‘মানুষ গড়ার ধর্ম’-এর মূল কথা কী ছিল? 💪❤️🌍

উত্তর: ভূমিকা: স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) ছিলেন উনিশ শতকের এক যুগন্ধর ব্যক্তিত্ব, যিনি প্রাচীন ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের এক মানবতাবাদী ও কর্মমুখী ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা ‘ব্যবহারিক বেদান্ত’ বা ‘মানুষ গড়ার ধর্ম’ নামে পরিচিত।

মূল কথা:

  • মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বে বিশ্বাস: বিবেকানন্দের মতে, প্রতিটি মানুষই পরমাত্মার অংশ এবং প্রত্যেকের মধ্যেই অনন্ত সম্ভাবনা ও দেবত্ব সুপ্ত রয়েছে । শিক্ষার মাধ্যমে এই অন্তর্নিহিত পূর্ণতাকে বিকশিত করাই ধর্মের লক্ষ্য।
  • সেবাই পরম ধর্ম (‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’): তিনি প্রাচীন বেদান্তের জ্ঞানকে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ হিসেবে না দেখে, তাকে সাধারণ মানুষের সেবায় নিয়োজিত করার ওপর জোর দেন । তাঁর বিখ্যাত উক্তি “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” এই ভাবনারই প্রতিফলন । আর্ত, পীড়িত, দরিদ্র মানুষের সেবাকেই তিনি ঈশ্বরের প্রকৃত উপাসনা বলে মনে করতেন।
  • শারীরিক ও মানসিক শক্তির বিকাশ: বিবেকানন্দ একটি শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী ও নির্ভীক জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখতেন। তাই তিনি যুবসমাজকে শারীরিক ও মানসিক শক্তির বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলতেন, “গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।”
  • ত্যাগ ও সেবার আদর্শ: তাঁর ‘মানুষ গড়ার ধর্ম’ সন্ন্যাস ও সংসার উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। তিনি ত্যাগ ও সেবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৯৭) ।

উপসংহার: স্বামী বিবেকানন্দের ‘ব্যবহারিক বেদান্ত’ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় দর্শন ছিল না, এটি ছিল এক জীবনদর্শন যা ব্যক্তিকে আত্মবিশ্বাসী, সেবাপরায়ণ ও শক্তিশালী নাগরিকে পরিণত করতে এবং এক নতুন ভারত গঠনে অনুপ্রাণিত করেছিল।

প্রশ্ন ২২: উনিশ শতকের সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে প্রধান পার্থক্যগুলি কী ছিল? 🤔🆚💡

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার-এ রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দুজনেই ছিলেন দিকপাল ব্যক্তিত্ব। তাঁদের উভয়েরই লক্ষ্য ছিল সমাজের উন্নতি, তবে তাঁদের সংস্কারের ক্ষেত্র, পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

বিষয়রাজা রামমোহন রায়ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
প্রধান সংস্কারক্ষেত্রমূলত ধর্মীয় কুসংস্কার (পৌত্তলিকতা, আচারসর্বস্বতা) ও তার সঙ্গে জড়িত সামাজিক প্রথা (সতীদাহ) দূরীকরণের ওপর জোর দেন । আধুনিক শিক্ষার (পাশ্চাত্য) প্রবর্তনেও সচেষ্ট ছিলেন প্রধানত সামাজিক কুপ্রথা (বিধবাবিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ) এবং নারীশিক্ষার প্রসারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেন
পদ্ধতিশাস্ত্রীয় যুক্তির পাশাপাশি মানবতাবাদী ও যুক্তিবাদী আবেদন এবং সরকারের কাছে আইন প্রণয়নের জন্য সওয়াল করতেন । জনমত গঠনেও উদ্যোগী ছিলেন প্রধানত হিন্দুশাস্ত্র (যেমন ‘পরাশর সংহিতা’) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সংস্কারের শাস্ত্রীয় ভিত্তি প্রমাণ করতেন । তিনিও সরকারের কাছে আবেদন ও জনমত গঠনের ওপর জোর দেন
ধর্মীয় অবস্থানএকেশ্বরবাদী ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতা, হিন্দুধর্মের প্রচলিত রীতিনীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন নিজে সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী না হলেও, ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ সংস্কারে ব্রতী হন। তিনি প্রধানত মানবতাবাদী ছিলেন।
লক্ষ্যসামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজ ও ধর্মকে আধুনিক ও যুক্তিনিষ্ঠ করে তোলা, পাশ্চাত্য ভাবধারার সঙ্গে ভারতীয় ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটানো।মূলত নারী সমাজের দুর্দশা মোচন এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষার মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি।

উপসংহার: রামমোহন রায় ছিলেন মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক চিন্তার জগতে এক বিপ্লবের অগ্রদূত, অন্যদিকে বিদ্যাসাগর ছিলেন সমাজের তৃণমূল স্তরে, বিশেষত নারীসমাজের বাস্তব সমস্যা সমাধানের একনিষ্ঠ কর্মী। উভয়ের অবদানই উনিশ শতকের বাংলাকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

📚 গ) ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory – প্রতিটি ৮ নম্বর) (উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার)

প্রশ্ন ১: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজগুলির (আদি, ভারতবর্ষীয়, সাধারণ ও নববিধান) ভূমিকা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করো। এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা কী ছিল? (৫+৩) 🌟🏛️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ব্রাহ্ম আন্দোলন। রাজা রামমোহন রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসভা (১৮২৮) পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ নামে পরিচিত হয় এবং সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন বিবর্তন ও বিভাজনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বিভিন্ন ব্রাহ্মসমাজের সমাজসংস্কারমূলক ভূমিকা:

  1. রাজা রামমোহন রায় ও আদি ব্রাহ্মসমাজ (পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে):
    • রামমোহন রায় ব্রাহ্মসভার মাধ্যমে হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, আচারসর্বস্বতা এবং জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা করেন ।
    • তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল সতীদাহ প্রথার মতো অমানবিক রীতির অবসান ঘটানো । তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন ।
    • তিনি বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং কন্যাসন্তান হত্যারও বিরোধিতা করেন ।
    • দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে আদি ব্রাহ্মসমাজ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দিকের ওপর বেশি জোর দিলেও, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার চালায় । তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমে তাঁরা নারীশিক্ষা, বিধবাবিবাহের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়েও আলোকপাত করতেন।
  2. কেশবচন্দ্র সেন ও ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ (১৮৬৬):
    • কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্ম আন্দোলন আরও বেশি সমাজসংস্কারমুখী ও সক্রিয় হয়ে ওঠে ।
    • তাঁরা জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং অসবর্ণ বিবাহকে উৎসাহিত করেন ।
    • বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁরা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন, যার ফলস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘তিন আইন’ (নেটিভ ম্যারেজ অ্যাক্ট) পাস করে । এই আইনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয় এবং অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয় ।
    • নারীশিক্ষার প্রসারে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ।
    • তাঁরা শ্রমিকদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও মদ্যপান নিবারণের মতো কাজেও উদ্যোগী হয়েছিলেন ।
  3. সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ (১৮৭৮) ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজ:
    • কেশবচন্দ্র সেনের কিছু কার্যকলাপ (যেমন – নিজের অপ্রাপ্তবয়স্কা কন্যার বিবাহ দেওয়া) নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু প্রমুখ নেতারা ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন ।
    • সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো এবং সমাজ সংস্কারের কাজ (যেমন – নারীমুক্তি, জাতিভেদ বিলোপ, শিক্ষার প্রসার) অব্যাহত রাখে।
    • কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বাধীন অংশটি ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয় এবং এটিও ধর্মীয় সমন্বয় ও সমাজসেবার কাজ চালিয়ে যায় ।

ব্রাহ্ম আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা:

  • শহরকেন্দ্রিকতা ও শিক্ষিত সমাজে সীমাবদ্ধতা: ব্রাহ্ম আন্দোলন মূলত কলকাতা ও কয়েকটি শহরের ইংরেজি শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বা সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে এর বিশেষ যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি ।
  • মুসলিম সমাজের থেকে দূরত্ব: এই আন্দোলন প্রধানত হিন্দু সমাজের সংস্কারের কাজেই নিয়োজিত ছিল। বাংলার মুসলিম সমাজের সংস্কার বা তাদের সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যায়নি।
  • নেতাদের মধ্যে বিভাজন: ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মতপার্থক্য ও বিভাজন (১৮৬৬ ও ১৮৭৮ সালে) আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছিল ।

উপসংহার: এই সীমাবদ্ধতাগুলি সত্ত্বেও, উনিশ শতকের বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলন যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, একেশ্বরবাদ এবং বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যা বাংলার নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করে।

প্রশ্ন ২: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে সতীদাহ প্রথা বিরোধী প্রচেষ্টাগুলির পরিচয় দাও। রাজা রামমোহন রায় কীভাবে সতীদাহ প্রথা-বিরোধী আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করেন? (৩+৫) 🔥🚫👩

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতীয় হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথার মতো এক নিষ্ঠুর ও অমানবিক প্রথা প্রচলিত ছিল । স্বামীর মৃত্যুর পর তার জ্বলন্ত চিতায় বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার এই রীতি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল ।

সতীদাহ প্রথা বিরোধী প্রাথমিক প্রচেষ্টা:

  1. খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ: শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা, বিশেষত উইলিয়াম কেরি, এই প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন । কেরি এই প্রথা বন্ধের জন্য গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে আবেদনও জানিয়েছিলেন ।
  2. সরকারি বিধিনিষেধের চেষ্টা: ব্রিটিশ সরকার প্রথমদিকে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করলেও, ১৮১২, ১৮১৩ ও ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের রেগুলেশনের মাধ্যমে এই প্রথার ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার চেষ্টা করেছিল ।
  3. দেশীয় পণ্ডিতদের অভিমত: সুপ্রিমকোর্টের প্রধান পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে মত প্রকাশ করেন যে, সতীদাহ প্রথা হিন্দুশাস্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ নয় ।

রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে সাফল্য: রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ, ধারাবাহিক এবং সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন

  • শাস্ত্রীয় যুক্তির অবতারণা: রামমোহন বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র, বিশেষত ‘মনুসংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সতীদাহ প্রথা আদৌ শাস্ত্রসম্মত নয়, বরং এটি শাস্ত্রবিরুদ্ধ ।
  • পুস্তিকা ও প্রবন্ধ প্রকাশ: তিনি ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামে একাধিক পুস্তিকা প্রকাশ করেন । এছাড়াও, তাঁর সম্পাদিত ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখতেন । এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষিত সমাজে জনমত গঠন করতে সচেষ্ট হন।
  • আবেদন ও সরকারি সহযোগিতা: তিনি এই প্রথা বন্ধের জন্য বহু বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষরসহ একটি আবেদনপত্র তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন । রামমোহনের যুক্তিবাদী প্রচেষ্টা এবং собранные им данные (তাঁর সংগৃহীত তথ্য) বেন্টিঙ্ককে প্রভাবিত করে।
  • আইন প্রণয়ন ও সমর্থন: অবশেষে, রামমোহন রায়ের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেশন জারি করে সতীদাহ প্রথা আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।
  • বিদেশে প্রতি-আন্দোলনের মোকাবিলা: রক্ষণশীল হিন্দুরা (রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ‘ধর্মসভা’) এই আইনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন জানালে, রামমোহন ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রিভি কাউন্সিলের কাছে তাঁর যুক্তি পেশ করেন এবং আইনটি বহাল রাখতে সক্ষম হন ।

উপসংহার: রাজা রামমোহন রায়ের যুক্তিনিষ্ঠ শাস্ত্রালোচনা, অক্লান্ত প্রচেষ্টা এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই হিন্দু সমাজ থেকে সতীদাহের মতো একটি বর্বর প্রথার অবসান ঘটেছিল। এটি ছিল উনিশ শতকের সমাজসংস্কারের ইতিহাসে এক বিশাল মাইলফলক এবং নারীমুক্তির পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

প্রশ্ন ৩: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। এই আন্দোলনে তিনি কতটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন? (৫+৩) ⚭❤️📜

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার সমাজ সংস্কার আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১)। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হয়েছিল, যা ছিল নারীমুক্তির পথে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিবরণ:

  1. শাস্ত্রীয় ভিত্তি অনুসন্ধান ও প্রচার: বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে, হিন্দু বিধবাদের, বিশেষত বাল্যবিধবাদের, জীবন অত্যন্ত দুর্দশাপূর্ণ । তিনি প্রথমে হিন্দুশাস্ত্র, বিশেষত ‘পরাশর সংহিতা’ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, শাস্ত্রে বিধবাদের পুনর্বিবাহের বিধান রয়েছে ।
  2. পুস্তিকা রচনা: এই বিষয়ে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তিকা প্রকাশ করেন । রক্ষণশীলদের বিরোধিতার জবাবে তিনি এই প্রস্তাবের দ্বিতীয় পর্বও (অক্টোবর, ১৮৫৫) প্রকাশ করেন ।
  3. সরকারি আবেদন ও সমর্থন লাভ: ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা অক্টোবর তিনি বিধবাবিবাহ আইনসম্মত করার জন্য প্রায় এক হাজার মানুষের স্বাক্ষরসহ একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পেশ করেন । এই উদ্যোগে তিনি নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসুর মতো উদারপন্থী প্রগতিশীল হিন্দুদের সমর্থন লাভ করেন ।
  4. আইন পাস: বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও অকাট্য যুক্তির ফলে তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই ১৫ নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ করেন । (এই সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন পূর্ববর্তী বড়লাট লর্ড ডালহৌসি) ।
  5. বাস্তবায়ন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ: আইন পাস হওয়ার পর বিদ্যাসাগর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর কলকাতায় শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও কালীমতী দেবীর মধ্যে প্রথম আইনসম্মত বিধবাবিবাহ সম্পন্ন করান । তিনি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে নিজের পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গেও এক বিধবা (ভবসুন্দরী দেবী)র বিবাহ দেন । তিনি নিজ উদ্যোগে প্রায় ৬০টি বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং এর জন্য তাঁর প্রায় ৮২ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, যার ফলে তিনি প্রায় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন ।

সাফল্যের মূল্যায়ন:

  • আইনগত স্বীকৃতি: বিধবাবিবাহ আইন পাস করানো বিদ্যাসাগরের এক বিরাট সাফল্য ছিল, কারণ এটি হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের পথে আইনি বাধা দূর করেছিল।
  • সামাজিক প্রতিকূলতা: আইন পাস হলেও, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের একটি বড় অংশ বিধবাবিবাহকে সহজে মেনে নেয়নি । বিদ্যাসাগরকে এর জন্য বহু বিদ্রুপ, অপমান এমনকি হত্যার হুমকিও সহ্য করতে হয়েছিল ।
  • সুদূরপ্রসারী প্রভাব: তৎক্ষণাৎ ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তন না এলেও, বিদ্যাসাগরের এই আন্দোলন ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছিল । এটি নারীমুক্তির আদর্শকে শক্তিশালী করেছিল এবং পরবর্তী সমাজ সংস্কারের পথ প্রশস্ত করেছিল।

উপসংহার: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে পরিচালিত বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুধুমাত্র একটি আইন প্রণয়ন ছিল না, এটি ছিল প্রচলিত সামাজিক গোঁড়ামি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। তাঁর এই প্রচেষ্টা উনিশ শতকের বাংলার সমাজ জীবনে এক নতুন প্রগতিশীলতার সূচনা করেছিল।

প্রশ্ন ৪: হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের আদর্শ, কার্যকলাপ এবং সীমাবদ্ধতা আলোচনা করো। ✨🧑‍🎓🗣️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে বাংলার তরুণ সমাজে এক বৈপ্লবিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন। হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ছিলেন এই আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও প্রধান অনুপ্রেরণা ।

আদর্শ:

  • যুক্তিবাদ ও স্বাধীন চিন্তা: ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার আদর্শ এবং লক, হিউম, টম পেইনের মতো দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারার সঞ্চার করেছিলেন । তিনি তাঁদের কোনো কিছু বিনা বিচারে মেনে না নিয়ে প্রশ্ন করতে এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন ।
  • কুসংস্কার বিরোধিতা: তাঁরা হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতা, সতীদাহ প্রথা, নারীদের প্রতি বৈষম্য এবং অন্যান্য সকল প্রকার গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের তীব্র বিরোধী ছিলেন ।
  • স্বদেশপ্রেম: ডিরোজিও নিজে ইঙ্গ-পোর্তুগিজ বংশোদ্ভূত হলেও তাঁর মধ্যে গভীর স্বদেশপ্রেম ছিল, যা তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছিলেন । ‘আমার জন্মভূমি ভারতের প্রতি’ (To India – My Native Land) তাঁর বিখ্যাত কবিতা।

কার্যকলাপ:

  • অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৮): ডিরোজিও এই বিতর্ক সভা প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তাঁর ছাত্ররা বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক বিষয়ে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও আলোচনা করতেন ।
  • পত্রপত্রিকা প্রকাশ: নব্যবঙ্গীয়রা তাঁদের প্রগতিশীল মতামত প্রচারের জন্য ‘পার্থেনন’, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, ‘এথেনিয়াম’ (অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপত্র) এবং পরবর্তীকালে ‘জ্ঞানান্বেষণ’, ‘এনকোয়ারার’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশ করেন ।
  • প্রথা বিরোধিতা: হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতাকে আঘাত করার জন্য তাঁরা অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচলিত প্রথা ভাঙতেন, যেমন – নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ করা বা ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের উপহাস করা ।

সীমাবদ্ধতা:

  • উগ্রতা ও নেতিবাচকতা: তাঁদের সংস্কার প্রচেষ্টা অনেক সময় গঠনমূলক না হয়ে শুধুমাত্র প্রচলিত প্রথার উগ্র বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছিল, যা সাধারণ মানুষকে তাঁদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ।
  • জনবিচ্ছিন্নতা: নব্যবঙ্গ আন্দোলন মূলত কলকাতা শহরের ইংরেজি শিক্ষিত, হিন্দু কলেজের মুষ্টিমেয় ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজ বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি ।
  • মুসলিম সমাজের প্রতি উদাসীনতা: এই আন্দোলন হিন্দু সমাজের সংস্কারের প্রতিই মূলত মনোনিবেশ করেছিল; মুসলিম সমাজের সমস্যা নিয়ে তাঁদের বিশেষ কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি ।
  • অস্থায়িত্ব: ডিরোজিওর অকালমৃত্যুর (১৮৩১) পর এই আন্দোলন তার দিশা ও শক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলে ।

উপসংহার: নব্যবঙ্গ আন্দোলন তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উনিশ শতকের বাংলায় এক তীব্র বৌদ্ধিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং স্বদেশপ্রেম পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কারক ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের পথ দেখিয়েছিল। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ‘বাংলার আধুনিক সভ্যতার প্রবর্তক’ বলে অভিহিত করেছেন

প্রশ্ন ৫: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের ধর্মীয় চিন্তাধারা কীভাবে উনিশ শতকের বাংলায় হিন্দুধর্মের সংস্কার ও নবজাগরণে সহায়ক হয়েছিল, তা আলোচনা করো। তাঁদের প্রচারিত আদর্শের সামাজিক তাৎপর্য কী ছিল? (৫+৩) 🙏❤️💪

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে যখন বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রভাব এবং হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ জড়তা এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তখন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-১৮৮৬) ও তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) এক নতুন আধ্যাত্মিক জাগরণ ও ধর্মীয় সংস্কারের সূচনা করেন। তাঁদের চিন্তাধারা হিন্দুধর্মকে এক নবজীবন দান করে এবং সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ধর্মীয় সংস্কার ও নবজাগরণে সহায়ক চিন্তাধারা:

  1. শ্রীরামকৃষ্ণের ‘সর্বধর্মসমন্বয়’-এর আদর্শ:
    • সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা: শ্রীরামকৃষ্ণ সকল ধর্মকেই সত্য বলে মনে করতেন এবং নিজে বিভিন্ন ধর্মের (যেমন – ইসলাম, খ্রিস্টান) সাধনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সকল পথই একই ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায় । তাঁর বিখ্যাত উক্তি “যত মত, তত পথ” এই ভাবনারই প্রতিফলন ।
    • ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার বিরোধিতা: তিনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের বাহ্যিক আড়ম্বরের চেয়ে আন্তরিক ভক্তি ও বিশ্বাসকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাঁর এই উদার ও সমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি তৎকালীন ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও সংকীর্ণতা দূর করতে সহায়ক হয়েছিল ।
    • সহজ ভাষায় ধর্মপ্রচার: তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, উপমা ও গল্পের মাধ্যমে ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতেন, যা সাধারণ মানুষের কাছে হিন্দুধর্মকে আরও গ্রহণযোগ্য ও প্রাণবন্ত করে তোলে ।
  2. স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’ ও কর্মযোগ:
    • বেদান্তের মানবতাবাদী ও যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা: বিবেকানন্দ প্রাচীন ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের এক আধুনিক, যুক্তিনিষ্ঠ ও মানবতাবাদী ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা ‘নব্য বেদান্ত’ নামে পরিচিত । তিনি বলেন যে, প্রতিটি জীবের মধ্যেই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বিরাজমান, তাই “জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর”
    • ‘মানুষ গড়ার ধর্ম’: তাঁর ধর্ম ছিল ‘মানুষ তৈরির ধর্ম’ । তিনি শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাসী, শক্তিশালী ও সেবাপরায়ণ মানুষ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
    • কর্মযোগ ও সমাজসেবা: বিবেকানন্দ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মুক্তির ওপর জোর না দিয়ে, নিষ্কাম কর্ম ও সমাজসেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনার কথা বলেন। এই আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ।
    • জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা ও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি: তিনি জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে, বিশেষত হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির (বৈদান্তিক হৃদয় ও ইসলামের দেহ) মেলবন্ধন ঘটিয়ে এক শক্তিশালী ভারত গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন ।
    • আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মের প্রচার: ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিকাগো বিশ্বধর্ম সম্মেলনে তিনি হিন্দুধর্মের উদার ও বিশ্বজনীন বাণী প্রচার করে পাশ্চাত্যে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেন ।

প্রচারিত আদর্শের সামাজিক তাৎপর্য:

  • আত্মবিশ্বাস ও জাতীয়তাবাদের সঞ্চার: বিবেকানন্দের বলিষ্ঠ ও আশাবাদী বাণী পরাধীন ভারতের যুবসমাজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করেছিল। তাঁর স্বদেশপ্রেম ও সেবার আদর্শ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকে অনুপ্রাণিত করে।
  • সমাজসেবার প্রসার: রামকৃষ্ণ মিশনের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ত্রাণকার্য ইত্যাদি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজ শুরু হয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। এটি ধর্মের সঙ্গে সমাজকল্যাণের এক মেলবন্ধন ঘটায়।
  • ধর্মীয় গোঁড়ামি হ্রাস ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি: শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের উদার ও সমন্বয়বাদী ধর্মীয় চিন্তাধারা হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি কমাতে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।
  • নারীজাতির মর্যাদা বৃদ্ধি: শ্রীরামকৃষ্ণ নারীকে জগন্মাতার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখতেন এবং বিবেকানন্দও নারীশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতেন, যা সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল ।

উপসংহার: শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের সমন্বয়বাদী, মানবতাবাদী এবং কর্মমুখী ধর্মীয় চিন্তাধারা উনিশ শতকের শেষার্ধে ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার তথা ভারতের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক গভীর ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁরা হিন্দুধর্মকে কুসংস্কার ও আচারসর্বস্বতা থেকে মুক্ত করে এক নতুন প্রাণশক্তি দান করেন এবং দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন।

প্রশ্ন ৬: উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সামগ্রিক চরিত্র বিশ্লেষণ করো। এই আন্দোলনগুলির প্রধান সাফল্য ও সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল? (৪+৪) 🧐⚖️🌟

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে এক নবজাগরণের সূচনা হয়, যার গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক ছিল সমাজসংস্কার ও ধর্মসংস্কার আন্দোলন। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার সংস্পর্শে এসে এবং কিছু দেশীয় মনীষীর উদ্যোগে এই আন্দোলনগুলি গড়ে উঠেছিল, যার লক্ষ্য ছিল প্রচলিত কুসংস্কার দূর করে এক যুক্তিনিষ্ঠ, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল সমাজ ও ধর্মীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

আন্দোলনের সামগ্রিক চরিত্র:

  1. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব: এই সময়ের প্রায় সকল সংস্কারকই ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাঁরা যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও নারীমুক্তির মতো পাশ্চাত্য ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
  2. ধর্মকে ভিত্তি করে সংস্কার: অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কারকরা ধর্মীয় শাস্ত্রকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে সংস্কারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। যেমন, রামমোহন রায় শাস্ত্রের ভিত্তিতে সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করেন এবং বিদ্যাসাগর শাস্ত্র থেকেই বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে প্রমাণ তুলে ধরেন।
  3. আইন প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব: সংস্কারকরা শুধুমাত্র জনমত গঠন বা প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে, সামাজিক কুপ্রথাগুলি দূর করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা আইন প্রণয়নের ওপরও জোর দিয়েছিলেন (যেমন – সতীদাহ নিবারণ আইন, বিধবাবিবাহ আইন, তিন আইন)।
  4. মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রাধান্য: এই আন্দোলনগুলি মূলত কলকাতা ও অন্যান্য শহরের ইংরেজি শিক্ষিত, হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণ কৃষক, শ্রমিক বা মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশ এই আন্দোলনগুলিতে সেভাবে সামিল হয়নি বা এর দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়নি।
  5. প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ: ব্রাহ্মসমাজ, ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী, রামকৃষ্ণ মিশন প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই সংস্কার আন্দোলনগুলিকে সংগঠিত রূপ দিতে সাহায্য করেছিল। এছাড়াও, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা (যেমন – ‘সম্বাদ কৌমুদী’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’) সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রধান সাফল্য:

  • অমানবিক প্রথার অবসান: সতীদাহ প্রথার মতো নিষ্ঠুর প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল।
  • নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি: বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধকরণ, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা এবং নারীশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটেছিল।
  • ধর্মীয় গোঁড়ামি হ্রাস: পৌত্তলিকতা, আচারসর্বস্বতা ও জাতিভেদ প্রথার কঠোরতা কিছুটা শিথিল হয়েছিল এবং একেশ্বরবাদ ও সর্বধর্মসমন্বয়ের মতো উদার ধর্মীয় চিন্তাধারার প্রসার ঘটেছিল।
  • আধুনিক চেতনার উন্মেষ: যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার ঘটেছিল, যা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে।

সীমাবদ্ধতা:

  • শহরকেন্দ্রিকতা ও গণবিচ্ছিন্নতা: সংস্কার আন্দোলনগুলি মূলত শহরকেন্দ্রিক এবং শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, গ্রামীণ জনজীবনে এর প্রভাব ছিল কম।
  • হিন্দু সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা: এই সংস্কারগুলির অধিকাংশই ছিল হিন্দু সমাজকেন্দ্রিক। মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ সংস্কার বা সমস্যা নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এই পর্বে দেখা যায়নি।
  • আংশিক সাফল্য: আইন প্রণয়ন সত্ত্বেও অনেক সামাজিক কুপ্রথা (যেমন – বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ) সমাজের গভীর থেকে পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি এবং সংস্কারগুলি সমাজে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
  • ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপট: এই সংস্কারগুলি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে পরিচালিত হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের নিজেদের স্বার্থ ও প্রশাসনিক সুবিধার কথা মাথায় রেখেই সংস্কারগুলিকে সমর্থন বা উপেক্ষা করত।

উপসংহার: উনিশ শতকের বাংলায় সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনগুলি তার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এই আন্দোলনগুলি বাঙালির চিন্তা ও মনন জগতে এক নতুন আলো ফেলেছিল এবং আধুনিক বাংলা তথা ভারত গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল।

সাহিত্য, সংবাদপত্র ও শিক্ষা সংস্কার: তৈরি তো পরীক্ষার জন্য?

উনিশ শতকের বাংলার সাহিত্য, পত্রপত্রিকা ও শিক্ষাক্ষেত্রের সংস্কার নিয়ে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর এক জায়গায়। সেরা প্রস্তুতির জন্য এখনই দেখো!

Bengal Renaissance: বিতর্ক ও বিশ্লেষণ – সম্পূর্ণ প্রশ্নোত্তর!

বাংলার নবজাগরণের চরিত্র, সাফল্য, সীমাবদ্ধতা ও ঐতিহাসিক বিতর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা। পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন ও উত্তর দেখে নাও।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি যাচাই! মক টেস্ট দাও এখনই!

মাধ্যমিক ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১ নম্বরের বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্ন (MCQ) এবং সত্য/মিথ্যা (ঠিক/ভুল) প্রশ্ন দিয়ে সাজানো এই মক টেস্ট। নিজের প্রস্তুতি যাচাই করে নাও!

error: Content is protected !!
Scroll to Top