
Bengal Renaissance| Madhyamik History Chapter 2 Notes in Bengali. উনিশ শতকের বাংলা সাক্ষী ছিল এক অসাধারণ বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়নের। এই সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাঙালির সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলা ও চিন্তার জগতে যে এক গভীর ও ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তাকেই সাধারণভাবে ‘বাংলার নবজাগরণ’ বা Bengal Renaissance বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এই নবজাগরণের প্রকৃত চরিত্র, এর সাফল্য, সীমাবদ্ধতা এবং ‘নবজাগরণ’ শব্দটির যথাযথ ব্যবহার নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা বিতর্ক রয়েছে।
মাধ্যমিক ইতিহাসের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কিছুটা জটিল বিষয়টি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে বুঝতে ও সঠিক প্রস্তুতি নিতে, এই পৃষ্ঠায় তোমাদের জন্য Bengal Renaissance সম্পর্কিত বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও তার আদর্শ উত্তর (সংক্ষিপ্ত, বিশ্লেষণধর্মী ও ব্যাখ্যামূলক) বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
- 📜 ক) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (SAQ – প্রতিটি ২ নম্বর) Bengal Renaissance
- ✒️ খ) বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical – প্রতিটি ৪ নম্বর) Bengal Renaissance
- 📚 গ) ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory – প্রতিটি ৮ নম্বর) Bengal Renaissance
- সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের খুঁটিনাটি জানো? প্রশ্নোত্তর পর্ব
- সাহিত্য, সংবাদপত্র ও শিক্ষা সংস্কার: তৈরি তো পরীক্ষার জন্য?
- দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি যাচাই! মক টেস্ট দাও এখনই!
📜 ক) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (SAQ – প্রতিটি ২ নম্বর) Bengal Renaissance
প্রশ্ন ১: ‘নবজাগরণ’ বা ‘রেনেসাঁস’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ কী? উনিশ শতকের বাংলার প্রেক্ষাপটে এটি কী বোঝায়? ✨
উত্তর: ‘রেনেসাঁস’ (Renaissance) একটি ফরাসি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘পুনর্জন্ম’ বা ‘নবজন্ম’ । উনিশ শতকের বাংলার প্রেক্ষাপটে এটি বলতে বোঝায় পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালি জাতির মন ও মননে এক নতুন অনুসন্ধিৎসা ও বৌদ্ধিক জাগরণ, যার ফলে সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল ।
প্রশ্ন ২: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে কোন্ ঐতিহাসিক ‘ইউরোপীয় নবজাগরণের থেকে গভীর ও ব্যাপক’ বলে অভিহিত করেছেন?
উত্তর: প্রখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে প্রকৃত নবজাগরণ বলে অভিহিত করে বলেছেন যে, এটি ইউরোপীয় নবজাগরণের থেকেও গভীর ও ব্যাপক ছিল ।
প্রশ্ন ৩: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ ( অভিজাতদের আন্দোলন) বলে কে অভিহিত করেছেন? 🧐
উত্তর: ঐতিহাসিক অধ্যাপক অনিল শীল উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে মূলত শহরকেন্দ্রিক, ইংরেজি শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত হিন্দুদের (‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি) আন্দোলন বলে বর্ণনা করে একে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বলে অভিহিত করেছেন ।
প্রশ্ন ৪: কোন ঐতিহাসিক উনিশ শতকের বাংলার জাগরণকে একটি ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ বা ‘অতিকথা’ বলে মনে করেন? 🤨
উত্তর: ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে একটি ‘অতিকথা’ মাত্র এবং ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন । তাঁর মতে, এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা ততটা ছিল না যতটা দাবি করা হয়।
প্রশ্ন ৫: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের দুটি প্রধান সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো। 😟
উত্তর: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের দুটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো:
১. এটি মূলত কলকাতা শহরকেন্দ্রিক এবং ইংরেজি শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; গ্রামীণ জনজীবন বা সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রভাব প্রায় ছিলই না । ২. এই নবজাগরণ ছিল প্রধানত হিন্দুদের আন্দোলন; বাংলার মুসলিম সমাজ এই আন্দোলনের বাইরেই থেকে গিয়েছিল, যার ফলে এটি একটি সার্বজনীন রূপ নিতে পারেনি ।
✒️ খ) বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical – প্রতিটি ৪ নম্বর) Bengal Renaissance
প্রশ্ন ১: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল? ✨📜🎨
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাংলার সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য ও শিল্পকলায় যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, তার কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি:
- যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের প্রসার: এই সময়ের চিন্তাবিদরা ধর্ম ও সমাজকে যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করতে শুরু করেন এবং মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন ।
- অতীত ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও সমন্বয়: একদিকে যেমন প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির গৌরব পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়, তেমনই অন্যদিকে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস দেখা যায় ।
- সাহিত্য ও শিল্পের বিকাশ: এই সময়ে বাংলা সাহিত্য (গদ্য, পদ্য, নাটক) ও শিল্পকলার (চিত্রকলা, সংগীত) ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় উন্নতি ঘটে, যা বাঙালির মননের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটায় ।
- শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার প্রসার: বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার, বিতর্কসভা ও পত্রপত্রিকা স্থাপিত হয়, যা জ্ঞানচর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করে ।
- সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন: সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, পৌত্তলিকতার বিরোধিতা, একেশ্বরবাদের প্রচার ইত্যাদি বিভিন্ন সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন এই নবজাগরণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
উপসংহার: এই বৈশিষ্ট্যগুলির সমন্বয়ে উনিশ শতকের বাংলা এক নতুন বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়নের সাক্ষী হয়েছিল, যা ইতিহাসে নবজাগরণ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন ২: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে কেন ‘কলকাতা-কেন্দ্রিক’ ও ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাগরণ’ বলা হয়? 🏙️🧑💼
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ তার ব্যাপ্তি ও গভীরতার জন্য প্রশংসিত হলেও, এর কিছু চারিত্রিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। এই নবজাগরণকে মূলত ‘কলকাতা-কেন্দ্রিক’ ও ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাগরণ’ বলার পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান।
কলকাতা-কেন্দ্রিক বলার কারণ:
- কেন্দ্রস্থল: নবজাগরণের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ, যেমন – নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন (হিন্দু কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ), পত্রপত্রিকা প্রকাশ, সভা-সমিতি গঠন, সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা – সবই প্রধানত কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ।
- গ্রামীণ বিচ্ছিন্নতা: এই জাগরণের ঢেউ কলকাতার বাইরে বাংলার বিস্তীর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে সেভাবে পৌঁছায়নি। গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি এই বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়ন থেকে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল ।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির জাগরণ বলার কারণ:
- শিক্ষিত শ্রেণির ভূমিকা: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিই (‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি) ছিল এই নবজাগরণের প্রধান উদ্যোক্তা ও ধারক-বাহক ।
- সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের অভাব: সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ বা দরিদ্র কৃষক-শ্রমিকদের সমস্যা এই নবজাগরণের আলোচনায় তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি এবং তাঁরাও এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেননি । ঐতিহাসিক অনিল শীল তাই এই আন্দোলনকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বা অভিজাত গোষ্ঠীর আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছেন ।
উপসংহার: এই সীমাবদ্ধতাগুলির কারণেই অনেক ঐতিহাসিক উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণকে একটি অসম্পূর্ণ বা খণ্ডিত জাগরণ বলে মনে করেন, যা সমাজের সকল স্তরের মানুষকে স্পর্শ করতে পারেনি।
প্রশ্ন ৩: “উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল মূলত হিন্দু জাতীয়তাবাদ দ্বারা প্রভাবিত” – এই বক্তব্যের যথার্থতা বিচার করো। 🕉️🤔
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ নিঃসন্দেহে এক বিরাট বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবে এর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, এই জাগরণ অনেকাংশে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি কেন্দ্রিক ছিল এবং এর মধ্যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের একটি প্রচ্ছন্ন বা কখনও কখনও সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি:
- হিন্দুধর্মের সংস্কার: নবজাগরণের প্রধান পুরুষরা (যেমন – রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ) মূলত হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ কুসংস্কার দূর করে তাকে যুক্তিনিষ্ঠ ও আধুনিক করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন ।
- প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যের গৌরব পুনরুদ্ধার: এই সময়ে প্রাচীন ভারতের গৌরবময় ঐতিহ্য, শাস্ত্র ও দর্শনের প্রতি এক নতুন আগ্রহ সৃষ্টি হয়। অনেকেই মনে করতেন, হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিই ভারতের জাতীয় পরিচয়ের মূল ভিত্তি।
- মুসলিম সমাজের থেকে দূরত্ব: বাংলার মুসলিম সমাজ এই নবজাগরণের ধারা থেকে বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন ছিল। সংস্কার আন্দোলনগুলি মূলত হিন্দু সমাজের সমস্যা নিয়েই আবর্তিত হওয়ায় এবং কিছু ক্ষেত্রে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী চিন্তাধারার প্রভাব থাকায়, মুসলিমরা এর সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারেনি ।
- ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের অভাব: অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ, কিন্তু বাংলার নবজাগরণে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব ছিল এবং এটি অনেক সময় ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকেছে ।
উপসংহার: যদিও এই নবজাগরণে যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের মতো আধুনিক চিন্তাধারার প্রভাব ছিল, তবুও এর একটি শক্তিশালী ধারা হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়েছিল। এর ফলে, এটি একটি সার্বজনীন ভারতীয় নবজাগরণে রূপান্তরিত না হয়ে অনেকাংশে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল, যা পরবর্তীকালে ভারতের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে।
প্রশ্ন ৪: বাংলার নবজাগরণের চরিত্র সম্পর্কে স্যার যদুনাথ সরকার ও অশোক মিত্রের মতামতের তুলনামূলক আলোচনা করো। 🌟🆚🤨
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণকে ‘নবজাগরণ’ বা ‘রেনেসাঁস’ অভিধায় অভিহিত করা যায় কিনা এবং এর প্রকৃত চরিত্র কী ছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে গভীর মতপার্থক্য রয়েছে। এই প্রসঙ্গে স্যার যদুনাথ সরকার ও অশোক মিত্রের মতামত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্যার যদুনাথ সরকারের মতামত:
- তিনি উনিশ শতকের বাংলার এই জাগরণকে প্রকৃত নবজাগরণ বলেই মনে করতেন ।
- তাঁর মতে, এই নবজাগরণ ছিল ইউরোপীয় নবজাগরণের থেকেও গভীর ও ব্যাপক ।
- তিনি মনে করতেন, ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার হলো এই নবজাগরণ এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠাকে তিনি ‘গৌরবময় ভোর’ বলে অভিহিত করেছেন।
অশোক মিত্রের মতামত:
- জনগণনার কাজের সঙ্গে যুক্ত সিভিলিয়ান অশোক মিত্র বাংলার এই জাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ বলে বর্ণনা করেছেন ।
- তাঁর মতে, এটি ছিল প্রধানত কলকাতা শহরকেন্দ্রিক এবং জমিদার শ্রেণির বিপুল অর্থের বিনিময়ে গড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান মাত্র ।
- তিনি মনে করতেন, এই জাগরণের সঙ্গে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং এটি সমাজের গভীরে তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেনি।
তুলনা: স্যার যদুনাথ সরকার যেখানে এই জাগরণকে অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং এর গভীরতা ও ব্যাপকতাকে স্বীকার করেছেন, সেখানে অশোক মিত্র এর সীমাবদ্ধতা, শহরকেন্দ্রিকতা এবং উচ্চবিত্তের প্রাধান্যকে তুলে ধরে এর ‘নবজাগরণ’ অভিধাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। যদুনাথ সরকার এর ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও, অশোক মিত্রের বক্তব্যে এর সীমাবদ্ধ চরিত্র ফুটে ওঠে।
উপসংহার: এই দুই বিপরীতধর্মী মতামত থেকে বোঝা যায় যে, উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ছিল অত্যন্ত জটিল এবং এর মূল্যায়ন ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও বিতর্কের বিষয়।
প্রশ্ন ৫: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের প্রধান ধারাগুলি কী কী ছিল? সংক্ষেপে আলোচনা করো। 🌊➡️
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় যে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল, তার মধ্যে বিভিন্ন চিন্তাধারার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহাসিকরা এই জাগরণের প্রধানত তিনটি ধারা চিহ্নিত করেছেন।
প্রধান ধারাগুলি:
- প্রাচ্য-পুনরুজ্জীবনবাদী ধারা (Oriental Revivalist Stream):
- এই ধারার প্রবক্তারা বাংলার সুপ্রাচীন ও গৌরবময় ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার এবং তাকে ভিত্তি করে আধুনিকতার পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন ।
- তাঁরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়েছিলেন।
- এই ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ।
- পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী ধারা (Western Rationalist Stream):
- এই ধারার অনুসারীরা প্রাচ্যের ঐতিহ্যকে অনেক সময় পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে দেখতেন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা, যুক্তিবাদ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির উন্নতি ঘটাতে চেয়েছিলেন ।
- হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী ছিল এই ধারার প্রধান মুখপত্র ।
- সমন্বয়বাদী ধারা (Synthesist Stream):
- এই ধারার প্রবক্তারা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ বা বর্জন কোনোটিকেই সমর্থন করেননি। তাঁরা প্রাচ্যের মহৎ বিষয়গুলির সঙ্গে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও মানবতাবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন ও উন্নত সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ।
- রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা ছিলেন এই সমন্বয়বাদী ধারার প্রধান প্রতিনিধি ।
উপসংহার: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এই বিভিন্ন ধারাগুলি তাদের নিজস্ব পথে বাংলার চিন্তা ও সংস্কৃতির জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তবে, এই সমস্ত ধারার মধ্যেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব কমবেশি লক্ষ্য করা যায়।

📚 গ) ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory – প্রতিটি ৮ নম্বর) Bengal Renaissance
প্রশ্ন ১: উনিশ শতকের বাংলার ‘নবজাগরণ’ বলতে কী বোঝায়? এই নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে বিতর্ক রয়েছে, তা বিভিন্ন মতামতের ভিত্তিতে আলোচনা করো। (৩+৫) 🌟🤔💬
উত্তর: ভূমিকা: ‘নবজাগরণ’ বা ‘রেনেসাঁস’ একটি ফরাসি শব্দ, যার অর্থ ‘পুনর্জন্ম’ বা ‘নবজন্ম’ । উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাঙালির সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্পকলা ও চিন্তার জগতে যে এক গভীর ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার ফলে যে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিল, তাকেই সাধারণভাবে ‘বাংলার নবজাগরণ’ বলে অভিহিত করা হয় । এই সময়ে ভারতীয় মনীষীরা তাঁদের অতীত ঐতিহ্যকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে তা পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন ।
বাংলার নবজাগরণের চরিত্র বা প্রকৃতি বিষয়ক বিতর্ক: উনিশ শতকের বাংলার এই জাগরণকে প্রকৃত অর্থে ‘নবজাগরণ’ বলা যায় কিনা এবং এর চরিত্র কী ছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে।
- ‘নবজাগরণ’-এর সপক্ষে মত:
- স্যার যদুনাথ সরকার: তিনি এই জাগরণকে প্রকৃত নবজাগরণ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি ছিল ইউরোপীয় নবজাগরণের থেকেও গভীর ও ব্যাপক । তাঁর মতে, ইংরেজদের দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার হলো এই নবজাগরণ।
- রমেশচন্দ্র মজুমদার: তিনি উনিশ শতকে বাংলা ও বাঙালির ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক চেতনা প্রভৃতির ক্ষেত্রে চরম উন্নতির মাধ্যমে বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল বলে মনে করেন ।
- অধ্যাপক সুশোভন সরকার: তিনিও বাংলার এই জাগরণকে ‘রেনেসাঁস’ বলে অভিহিত করেছেন এবং মনে করেন যে, ইউরোপীয় নবজাগরণে ইতালির যে ভূমিকা ছিল, ভারতের নবজাগরণে বাংলার সেই ভূমিকা ছিল ।
- ‘নবজাগরণ’ অভিধার বিপক্ষে ও সীমাবদ্ধতা বিষয়ক মত:
- অশোক মিত্র: সিভিলিয়ান অশোক মিত্র বাংলার নবজাগরণকে ‘তথাকথিত নবজাগরণ’ বলে বর্ণনা করে বলেছেন, এটি ছিল প্রধানত কলকাতা শহরকেন্দ্রিক এবং জমিদার শ্রেণির বিপুল অর্থের বিনিময়ে গড়ে ওঠা এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান মাত্র ।
- বিনয় ঘোষ: তিনি বাংলার নবজাগরণকে একটি ‘অতিকথা’ বা ‘ঐতিহাসিক প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন ।
- অধ্যাপক সুমিত সরকার: তিনি এই জাগরণকে অনেকাংশে ‘নকলনবিশি’ বা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ বলে মনে করেন ।
- অনিল শীল: অধ্যাপক অনিল শীল এই আন্দোলনকে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বা অভিজাত গোষ্ঠীর আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ এটি মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, হিন্দু, শহরবাসী, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । সাধারণ কৃষক, শ্রমিক বা মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে এর বিশেষ যোগ ছিল না ।
- সাম্প্রদায়িক সীমাবদ্ধতা: অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই নবজাগরণে হিন্দুধর্মের সংস্কার ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাব বেশি থাকায়, বাংলার মুসলিম সমাজ এই আন্দোলন থেকে দূরে সরে গিয়েছিল । ফলে এটি ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের সার্বজনীন রূপ নিতে পারেনি ।
- ব্রিটিশ নির্ভরতা: এই জাগরণের নেতৃবৃন্দ অনেক ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সংস্কারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভর করতেন ।
উপসংহার: উনিশ শতকের বাংলার জাগরণ নিঃসন্দেহে এক বিরাট বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনেছিল। তবে এর সীমাবদ্ধতা, শহরকেন্দ্রিকতা, গণবিচ্ছিন্নতা এবং হিন্দুধর্ম কেন্দ্রিকতার কারণে একে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে সরাসরি তুলনা করা বা একটি সর্বাঙ্গীণ ‘নবজাগরণ’ বলা যায় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। তা সত্ত্বেও, এই জাগরণের ফলেই বাংলায় আধুনিক চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল এবং পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল।
প্রশ্ন ২: উনিশ শতকের বাংলায় নবজাগরণের সীমাবদ্ধতাগুলি বিস্তারিত আলোচনা করো। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এর গুরুত্বকে কি অস্বীকার করা যায়? (৫+৩) 😟🏙️👥➡️🌟
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় যে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ দেখা দিয়েছিল, যা ‘নবজাগরণ’ নামে পরিচিত, তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে এর ব্যাপ্তি ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এর অন্তর্নিহিত সীমাবদ্ধতাগুলিও বিচার করা প্রয়োজন।
নবজাগরণের প্রধান সীমাবদ্ধতা:
- শহরকেন্দ্রিকতা ও গণবিচ্ছিন্নতা: এই নবজাগরণের প্রভাব প্রধানত কলকাতা ও কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । বাংলার বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষ এই বৌদ্ধিক আলোড়ন থেকে বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন ছিল । ফলে, এটি একটি সর্বজনীন গণজাগরণে পরিণত হতে পারেনি।
- শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের আন্দোলন: নবজাগরণের প্রধান উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, হিন্দু, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি । অধ্যাপক অনিল শীল তাই একে ‘এলিটিস্ট আন্দোলন’ বা অভিজাতদের আন্দোলন বলেছেন । সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বা সমস্যা এতে সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
- হিন্দুধর্ম কেন্দ্রিকতা ও মুসলিম সমাজের বিচ্ছিন্নতা: এই নবজাগরণের একটি বড় অংশ হিন্দুধর্মের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল । এর ফলে বাংলার মুসলিম সমাজ এই জাগরণ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করে এবং এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়নি । এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও সার্বজনীন ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
- পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ: কিছু ক্ষেত্রে এই জাগরণ পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণে পর্যবসিত হয়েছিল বলে অধ্যাপক সুমিত সরকার মনে করেন । মৌলিক চিন্তার অভাব এবং শুধুমাত্র ইউরোপীয় ভাবধারা গ্রহণ করার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
- ব্রিটিশ শাসনের প্রতি নির্ভরশীলতা: নবজাগরণের অনেক নেতাই ব্রিটিশ শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভর করতেন । এর ফলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও স্বাধীন চেতনা সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
- সামাজিক কাঠামোর অপরিবর্তনশীলতা: বাহ্যিক কিছু পরিবর্তন এলেও, বাংলার সমাজের মূল কাঠামো, যেমন – জাতিভেদ প্রথা, গ্রামীণ অর্থনীতির শোষণমূলক দিকগুলি, তেমনভাবে পরিবর্তিত হয়নি ।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গুরুত্ব: এই সমস্ত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের গুরুত্বকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা যায় না:
- বৌদ্ধিক মানসিকতার উন্নতি: এই জাগরণের ফলে বাংলার মানুষের চিন্তার জগতে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, যুক্তিবাদ ও জিজ্ঞাসার প্রসার ঘটেছিল ।
- সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল; নতুন নতুন পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল এবং জ্ঞানচর্চার প্রসার হয়েছিল ।
- সমাজ সংস্কারের সূচনা: সতীদাহ প্রথা রদ, বিধবাবিবাহ প্রচলন, নারীশিক্ষার প্রসারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কারগুলি এই সময়েই শুরু হয়েছিল।
- জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধারণা পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল।
উপসংহার: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণ ছিল একটি জটিল ও বহুমাত্রিক ঘটনা। এর সীমাবদ্ধতাগুলি অনস্বীকার্য, তবে এটি বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে যে আধুনিকতার সূচনা করেছিল এবং বাঙালির মনন জগতে যে পরিবর্তন এনেছিল, তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রশ্ন ৩: “উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলি সামাজিক সংস্কার আন্দোলনগুলির পথ প্রশস্ত করেছিল” – তুমি কি এই বক্তব্যের সাথে একমত? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও। 🙏➡️🤝
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় যে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, তার দুটি প্রধান দিক ছিল ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার। এই দুটি ক্ষেত্র আপাতদৃষ্টিতে পৃথক মনে হলেও, গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় যে, এগুলি একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলি সামাজিক সংস্কারের পথকে প্রশস্ত করেছিল। আমি এই বক্তব্যের সাথে বহুলাংশে একমত।
বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি:
- ধর্মীয় অচলায়তন ভাঙা: তৎকালীন হিন্দু সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি, আচারসর্বস্বতা, পৌত্তলিকতা এবং পুরোহিততন্ত্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল, যা বহু সামাজিক কুপ্রথার জন্ম দিয়েছিল বা সেগুলিকে টিকিয়ে রেখেছিল। ব্রাহ্মসমাজ (রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেনের নেতৃত্বে) একেশ্বরবাদের প্রচার, মূর্তিপূজার বিরোধিতা এবং শাস্ত্রের যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই ধর্মীয় অচলায়তন ভাঙার চেষ্টা করে । ধর্মের এই সংস্কারবাদী ব্যাখ্যা সামাজিক কুপ্রথাগুলির (যেমন – সতীদাহ, জাতিভেদ) ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
- শাস্ত্রকে হাতিয়ার করে সমাজ সংস্কার: অনেক সমাজ সংস্কারকই ধর্মীয় শাস্ত্রকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে তাঁদের সংস্কারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাজা রামমোহন রায় শাস্ত্র থেকেই প্রমাণ দেখান যে সতীদাহ প্রথা ধর্মসম্মত নয় । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বিধবাবিবাহকে শাস্ত্রীয় বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন । এর ফলে ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের কাছে সংস্কারগুলি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
- মানবতাবাদী ধর্মীয় আদর্শের প্রচার: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ‘যত মত, তত পথ’ এবং ‘জীবসেবাই শিবসেবা’র আদর্শ এবং স্বামী বিবেকানন্দের ‘নব্য বেদান্ত’ ও ‘মানুষ গড়ার ধর্ম’-এর ধারণা ধর্মকে শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠানের গণ্ডি থেকে বের করে এনে মানবকল্যাণ ও সামাজিক সেবার সঙ্গে যুক্ত করে। এই মানবতাবাদী ধর্মীয় আদর্শগুলি জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতা এবং অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে।
- ব্রাহ্মসমাজের সামাজিক কর্মসূচি: ব্রাহ্মসমাজ শুধুমাত্র ধর্মীয় আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ, অসবর্ণ বিবাহের প্রচলন, নারীশিক্ষার প্রসার এবং জাতিভেদ প্রথার বিলোপের মতো প্রত্যক্ষ সামাজিক সংস্কারমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল । ১৮৭২ সালের ‘তিন আইন’ এর একটি বড় উদাহরণ ।
- যুক্তিবাদ ও উদারনীতির প্রসার: ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলি শাস্ত্রের অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে যুক্তিবাদ ও উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার ওপর জোর দিয়েছিল। এই মানসিকতা সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রগতিশীল সংস্কারের অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করে।
কিছু ভিন্ন দিক (যেখানে সরাসরি ধর্মীয় সংস্কার প্রধান ছিল না): তবে, এটাও উল্লেখ্য যে, নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর মতো কিছু সংস্কার আন্দোলন ছিল যারা ধর্মীয় শাস্ত্রের চেয়ে পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল । বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের পেছনে শাস্ত্রীয় যুক্তির পাশাপাশি তাঁর গভীর মানবতাবোধও প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, উনিশ শতকের বাংলায় ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং সমাজ সংস্কার আন্দোলন ছিল একে অপরের পরিপূরক। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের ভিত্তি দুর্বল না করে অনেক সামাজিক পরিবর্তন আনা কঠিন ছিল। তাই, ধর্মকে যুক্তিসম্মত, মানবতাবাদী ও উদারনৈতিক রূপে সংস্কার করার প্রচেষ্টাগুলি বহুলাংশে সামাজিক অচলায়তন ভাঙতে এবং প্রগতিশীল সমাজ গঠনের পথকে সুগম করেছিল।