
Class 10 History Chapter 8 Notes in Bengali: দীর্ঘ ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন জওহরলাল নেহরু। কিন্তু এই স্বাধীনতা এসেছিল দেশভাগের মর্মান্তিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, যা নবগঠিত রাষ্ট্রকে একাধিক কঠিন সমস্যার সম্মুখীন করে। এই অধ্যায়ে আমরা জানব স্বাধীন ভারতের সেই সংকটময় পর্বের কথা – কীভাবে দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, দেশভাগের ফলে সৃষ্ট লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং ভাষার ভিত্তিতে কীভাবে রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্নির্ধারিত হয়েছিল। এই সমস্যাগুলির মোকাবিলা করে ভারত কীভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার পথচলা শুরু করেছিল, সেই বিশ্লেষণই এই অধ্যায়ের মূল বিষয়।
🇮🇳 প্রথম ভাগ: দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তির উদ্যোগ ও বিতর্ক 🇮🇳

উপশিরোনাম: 🗺️ একত্রিত ভারত: দেশীয় রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তির জটিল অধ্যায় 🗺️
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় ব্রিটিশ ভারতের বাইরেও প্রায় ৬০১টি ছোট-বড় দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল, যাদের মোট আয়তন ছিল সমগ্র ভারতের প্রায় ৪৮ শতাংশ। এই রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি স্বাধীন ভারতের ঐক্য, সংহতি এবং আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল।
পটভূমি ও নীতি:
- ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর আর কোনো দেশীয় রাজ্য অধিকার না করার নীতি নিলেও, ১৯৪৭ সালের ‘ভারতীয় স্বাধীনতা আইন’-এ দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান অথবা স্বাধীন থাকার অধিকার দেয়। এটি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
- জাতীয় কংগ্রেস স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের পর কোনো দেশীয় রাজ্যের স্বাধীন অস্তিত্ব তারা স্বীকার করবে না।
- এই পরিস্থিতিতে, ১৯৪৭ সালের ২৭ জুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগে ‘দেশীয় রাজ্য বিভাগ’ গঠিত হয়। এই দপ্তরের সচিব ছিলেন ভি. পি. মেনন।
বল্লভভাই প্যাটেল ও ভি. পি. মেননের ভূমিকা:
- প্যাটেল ও মেনন উপলব্ধি করেন যে দেশীয় রাজ্যগুলির স্বাধীন অস্তিত্ব ভারতের ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক। প্যাটেল তাঁর দৃঢ় মনোভাব, কূটনীতি এবং প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়ে বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্যকে ভারতভুক্তিতে রাজি করান।
- রাজাদের জন্য রাজন্যভাতা, খেতাব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দানের মাধ্যমে তিনি তাদের ‘ভারতভুক্তির দলিলে’ (Instrument of Accession) স্বাক্ষর করাতে সমর্থ হন।
- তাঁর এই অনমনীয় দৃঢ়তার জন্য তিনি ‘ভারতের লৌহমানব’ এবং ‘ভারতের বিসমার্ক’ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী ও সুমিত সরকারের মতো অনেকেই তাঁর এই কৃতিত্বকে ভারতের ঐক্যসাধনে সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বলে মনে করেন।
প্রধান সমস্যাসঙ্কুল রাজ্যগুলির অন্তর্ভুক্তি: বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগ দিলেও, জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ ও কাশ্মীর স্বাধীন থাকার চেষ্টা করে, যা সমস্যা বৃদ্ধি করে।
- জুনাগড়:
- এখানকার নবাব মুসলিম হলেও অধিকাংশ প্রজা ছিল হিন্দু। নবাব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে রাজ্যে প্রবল গণবিক্ষোভ শুরু হয় এবং নবাব পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
- ভারত সরকার হস্তক্ষেপ করে এবং ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত গণভোটে প্রায় ৯৯% মানুষ ভারতে যোগদানের পক্ষে মত দেয়। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে জুনাগড় ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
- কাশ্মীর:
- এখানকার মহারাজা ছিলেন হরি সিং এবং অধিকাংশ প্রজা মুসলিম। মহারাজা স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
- ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান-সমর্থিত হানাদার বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করলে মহারাজা হরি সিং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্য চান।
- ২৬ অক্টোবর তিনি ‘ভারতভুক্তির দলিলে’ স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে হানাদারদের বিতাড়িত করে। বিষয়টি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে উত্থাপিত হয় এবং ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়।
- হায়দ্রাবাদ:
- এটি ছিল ভারতের বৃহত্তম দেশীয় রাজ্য। নিজাম ওসমান আলি খান স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন।
- নিজাম কাশিম রিজভির নেতৃত্বে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক ‘রাজাকার বাহিনী’ গড়ে তোলেন, যারা সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করত।
- কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে তেলেঙ্গানা অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬ থেকে) এবং হায়দ্রাবাদ রাজ্য কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলন (১৯৪৭) পরিস্থিতি জটিল করে তোলে।
- ভারত সরকার ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদে সামরিক অভিযান চালায়, যা ‘অপারেশন পোলো’ নামে পরিচিত।
- ১৮ সেপ্টেম্বর নিজাম আত্মসমর্পণ করেন এবং ১৯৪৯ সালের প্রথমে ‘ভারতভুক্তির দলিলে’ স্বাক্ষর করেন। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি হায়দ্রাবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
ফরাসি ও পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলির সংযুক্তি:
- ফরাসি উপনিবেশগুলি (চন্দননগর, পন্ডিচেরি, মাহে ইত্যাদি) গণভোট ও চুক্তির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ভারতের হাতে হস্তান্তরিত হয় (১৯৪৯-১৯৫৪)। চন্দননগর ১৯৪৯ সালে গণভোটের মাধ্যমে ভারতে যোগ দেয়।
- পোর্তুগিজ উপনিবেশগুলি (গোয়া, দমন ও দিউ, দাদরা ও নগর হাভেলি) ছাড়তে পোর্তুগাল রাজি ছিল না। গণ-আন্দোলনের পর দাদরা ও নগর হাভেলি ১৯৫৪ সালে মুক্ত হয়। অবশেষে ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী সামরিক অভিযানের মাধ্যমে গোয়া, দমন ও দিউ মুক্ত করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে।


🚶♂️🚶♀️ দ্বিতীয় ভাগ: ১৯৪৭ পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ ও বিতর্ক 🚶♂️🚶♀️

উপশিরোনাম: 💔 দেশভাগ ও ছিন্নমূল মানুষ: উদ্বাস্তু সমস্যার যন্ত্রণা ও সমাধান প্রচেষ্টা 💔
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক হিংসা ও ব্যাপক জন-অভিপ্রয়াণ স্বাধীন ভারতের সামনে এক ভয়াবহ উদ্বাস্তু সমস্যা তৈরি করে। প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায় এবং অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হয়। এই ছিন্নমূল মানুষজনের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্দশা।

উদ্বাস্তু সমস্যার প্রকৃতি ও ভারত সরকারের উদ্যোগ:
- তীব্রতা ও ব্যাপকতা: মূলত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে এবং পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববঙ্গ) থেকে পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক হারে উদ্বাস্তু আগমন ঘটে। এছাড়া আসাম ও ত্রিপুরাতেও বহু উদ্বাস্তু আশ্রয় নেয়।
- প্রাথমিক পদক্ষেপ: স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সরকার এই সমস্যাকে গভীর গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করে।
- উদ্বাস্তুদের জন্য অস্থায়ী শরণার্থী শিবির স্থাপন, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা হয়।
- মানসিক অবসাদ দূর করতে শিবিরে বিভিন্ন গঠনমূলক কাজের (রান্না, খেলাধুলা, হাতের কাজ) ব্যবস্থা করা হয়।
- স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচ বছরকে (১৯৪৭-১৯৫২) ‘পুনর্বাসনের যুগ’ বলা হয়।
- নেহরু-লিয়াকত চুক্তি (১৯৫০):
- উদ্বাস্তু সমস্যা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের মধ্যে ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল (কিছু সূত্রে ১৭ এপ্রিল) দিল্লি চুক্তি বা নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
- এই চুক্তিতে উভয় দেশে সংখ্যালঘুদের পূর্ণ নিরাপত্তা, সমানাধিকার ও ধর্মের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। উভয় দেশে সংখ্যালঘু কমিশন গঠন এবং দেশত্যাগী মানুষ ফিরে এলে তাদের সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার কথাও বলা হয়।
- তবে এই চুক্তি অনেককে হতাশ করে এবং এর প্রতিবাদে নেহরুর মন্ত্রিসভা থেকে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী পদত্যাগ করেন। পূর্ববঙ্গ থেকে শরণার্থী স্রোত অব্যাহত থাকে।
- পুনর্বাসনের তারতম্য:
- পশ্চিম রণাঙ্গন (পাঞ্জাব): পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত শিখ ও হিন্দু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন তুলনামূলকভাবে দ্রুত ও সফল হয়েছিল। এর কারণ ছিল প্রায় সম্পূর্ণ জনবিনিময় (ভারত থেকে মুসলিমদের পশ্চিম পাকিস্তানে গমন), ফলে পরিত্যক্ত সম্পত্তি আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যে বণ্টন করা সহজ হয়। ভাষাগত সমস্যাও কম ছিল।
- পূর্ব রণাঙ্গন (পশ্চিমবঙ্গ): পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু ও বৌদ্ধ উদ্বাস্তুদের সমস্যা ছিল অনেক বেশি জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী। এখানে সেভাবে জনবিনিময় হয়নি, উদ্বাস্তু আগমন ১৯৭১ পর্যন্ত দফায় দফায় চলতে থাকে, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যও অপ্রতুল ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। বহু বাঙালি উদ্বাস্তুকে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দণ্ডকারণ্য (মধ্যপ্রদেশ-ওড়িশা) ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো হয়, যা তাদের সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
- সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে দেশভাগের প্রতিফলন:
- দেশভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু জীবনের কষ্ট ও স্মৃতি বহু লেখকের আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও উপন্যাসে এবং চলচ্চিত্রে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মণিকুন্তলা সেনের ‘সেদিনের কথা’, দক্ষিণারঞ্জন বসুর ‘ছেড়ে আসা গ্রাম’, খুশবন্ত সিং-এর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উদ্বাস্তু’। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’।

⚖️ দুই প্রান্তের উদ্বাস্তু: দেশভাগের ভিন্ন অভিজ্ঞতা (পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাব) ⚖️
তুলনার বিষয় (Comparison Points) | 🌾 পশ্চিমবঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত) | 🦁 পাঞ্জাব (পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত) |
---|---|---|
১. আগমনের প্রকৃতি ও সময়কাল | – উদ্বাস্তু আগমন ছিল দীর্ঘমেয়াদী ও ধারাবাহিক (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং তার পরেও)। – মূলত ধর্মীয় নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দফায় দফায় আগমন। | – উদ্বাস্তু আগমন ছিল মূলত এককালীন ও ব্যাপক (১৯৪৭-৪৮ সালের মধ্যে)। – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিংসার কারণে আকস্মিক ও দ্রুত দেশত্যাগ। |
২. জনবিনিময় | – পশ্চিমবঙ্গে সেভাবে জনবিনিময় হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমদের পাকিস্তানে গমনের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। | – পাঞ্জাবে প্রায় সম্পূর্ণ জনবিনিময় ঘটেছিল। পূর্ব পাঞ্জাব থেকে মুসলিমরা পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে হিন্দু ও শিখরা পূর্ব পাঞ্জাবে চলে আসে। |
৩. সরকারি নীতি ও উদ্যোগ | – কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য ও মনোযোগ তুলনামূলকভাবে কম ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। – পুনর্বাসনের জন্য প্রধানত দণ্ডকারণ্য ও আন্দামানের মতো দূরবর্তী স্থানে পাঠানোর উপর জোর দেওয়া হয়। – ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে স্বীকৃতি ও সাহায্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা। | – কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ ও পর্যাপ্ত সাহায্য পাওয়া গিয়েছিল। – শরণার্থীদের জন্য দ্রুত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। – সামরিক বাহিনীকেও পুনর্বাসন কাজে লাগানো হয়। |
৪. পুনর্বাসনের ধরণ ও সাফল্য | – পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ছিল জটিল, দীর্ঘস্থায়ী ও বহুলাংশে অসম্পূর্ণ। – শহরের বাইরে কলোনি স্থাপন এবং কৃষিজমি বিতরণের চেষ্টা হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। – বহু মানুষ দীর্ঘকাল ধরে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। | – পুনর্বাসন প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে দ্রুত ও সফল হয়েছিল। – পরিত্যক্ত মুসলিম সম্পত্তি (জমি, বাড়ি, দোকান) আগত শিখ ও হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। – সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে কৃষিতে স্বনির্ভরতা আনা হয়। |
৫. দীর্ঘমেয়াদী আর্থ-সামাজিক প্রভাব | – পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির উপর সুদূরপ্রসারী ও জটিল প্রভাব ফেলে। – শহরের উপর জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি, বেকারত্ব, সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেয়। – ‘বাঙাল’ ও ‘ঘটি’ বিতর্ক সামাজিক বিভাজন তৈরি করে। | – প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে পাঞ্জাব দ্রুত অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। – উদ্বাস্তুদের কঠোর পরিশ্রম ও উদ্যোগ পাঞ্জাবের কৃষি ও শিল্পের বিকাশে সাহায্য করে। – শরণার্থীদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও পরিচিতি বজায় থাকে। |
🗣️ তৃতীয় ভাগ: ভাষার ভিত্তিতে ভারতে রাজ্য পুনর্গঠন: উদ্যোগ ও বিতর্ক 🗣️
উপশিরোনাম: 🗺️ ভাষার টানে নতুন সীমানা: রাজ্য পুনর্গঠনের পথ 🗺️
স্বাধীনতার পর ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজ্যগুলির সীমানা পুনর্নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত বিষয় ছিল। বহু ভাষা ও সংস্কৃতির এই দেশে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে।
প্রেক্ষাপট ও প্রাথমিক উদ্যোগ:
- স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই জাতীয় কংগ্রেস ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের নীতিকে সমর্থন জানিয়েছিল।
- তবে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতীয় নেতৃবৃন্দ (বিশেষত নেহরু ও প্যাটেল) আশঙ্কা করেন যে, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন করলে তা ভারতের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
- দার কমিশন (১৯৪৮):
- ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে ভারত সরকার ১৯৪৮ সালের জুন মাসে বিচারপতি এস. কে. দরের সভাপতিত্বে ‘ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন’ বা দার কমিশন গঠন করে।
- এই কমিশন তার প্রতিবেদনে (ডিসেম্বর, ১৯৪৮) ভাষার পরিবর্তে প্রশাসনিক সুবিধার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের সুপারিশ করে এবং ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। এই সুপারিশ ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
- জে.ভি.পি. কমিটি (১৯৪৮):
- দার কমিশনের রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়াকে নিয়ে একটি কমিটি (জে.ভি.পি. কমিটি) গঠন করে।
- এই কমিটিও ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে তাদের রিপোর্টে প্রাথমিকভাবে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের বিরোধিতা করে, তবে জানায় যে, যদি কোনো অঞ্চলে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের জন্য তীব্র গণ-আন্দোলন হয়, তবে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
অন্ধ্র আন্দোলন ও প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন:
- মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তেলুগুভাষী মানুষেরা পৃথক অন্ধ্র রাজ্যের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন।
- এই দাবিতে গান্ধিবাদী নেতা পট্টি শ্রীরামালু ১৯৫২ সালের ১৯ অক্টোবর আমরণ অনশন শুরু করেন এবং ৫৮ দিন পর ১৫ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
- তাঁর মৃত্যুর পর সমগ্র তেলুগুভাষী অঞ্চলে তীব্র গণবিক্ষোভ ও হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
- বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫২ সালের ১৮ ডিসেম্বর পৃথক অন্ধ্র রাজ্য গঠনের দাবি মেনে নেন।
- এর ফলস্বরূপ, ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর ভাষার ভিত্তিতে ভারতের প্রথম রাজ্য হিসেবে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হয়।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন (SRC) ও রাজ্য পুনর্গঠন আইন, ১৯৫৬:
- অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হওয়ার পর অন্যান্য অঞ্চলেও ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের দাবি তীব্রতর হয়।
- এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার ১৯৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ফজল আলির সভাপতিত্বে তিন সদস্যের ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ (SRC) গঠন করে। কমিশনের অপর দুই সদস্য ছিলেন কে. এম. পানিক্কর ও হৃদয়নাথ কুঞ্জরু।
- কমিশন ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠনের সুপারিশ করা হয়, তবে জাতীয় ঐক্য, প্রশাসনিক ও আর্থিক সঙ্গতির কথাও মাথায় রাখা হয়। কমিশন ভারতকে ১৬টি রাজ্য ও ৩টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করার প্রস্তাব দেয়।
- কমিশনের সুপারিশগুলি কিছু পরিমার্জন করে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর ‘রাজ্য পুনর্গঠন আইন’ পাস হয়। এই আইন অনুসারে ভারতকে ১৪টি রাজ্য এবং ৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করা হয়।
- উদাহরণস্বরূপ, হায়দ্রাবাদ রাজ্যের তেলেঙ্গানা অংশ অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে, বিহারের পুরুলিয়া ও পূর্ণিয়ার কিছু অংশ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে, কচ্ছ ও সৌরাষ্ট্র বোম্বাইয়ের সঙ্গে এবং ত্রিবাঙ্কুর-কোচিন ও মালাবার নিয়ে কেরালা রাজ্য গঠিত হয়।
পরবর্তী পুনর্গঠন (১৯৬৪ পর্যন্ত):
- বোম্বাই রাজ্যের বিভাজন (১৯৬০): রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন বোম্বাইকে অখণ্ড রাখার সুপারিশ করলেও, সেখানে মারাঠিভাষী (সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি) ও গুজরাটিভাষী (মহাগুজরাট জনতা পরিষদ) জনগণের তীব্র আন্দোলনের ফলে ১৯৬০ সালের মে মাসে বোম্বাই রাজ্য ভেঙে মহারাষ্ট্র ও গুজরাট নামে দুটি পৃথক রাজ্য গঠিত হয়।
- নাগাল্যান্ড (১৯৬৩): ১৯৬৩ সালের ১ ডিসেম্বর পৃথক নাগাল্যান্ড রাজ্য গঠিত হয়।
- পাঞ্জাবের বিভাজন (১৯৬৬, যদিও এটি ১৯৬৪-এর সামান্য পরে): সন্ত ফতে সিং ও মাস্টার তারা সিং-এর নেতৃত্বে আন্দোলনের ফলে পাঞ্জাব ভেঙে পাঞ্জাবিভাষী পাঞ্জাব, হিন্দিভাষী হরিয়ানা এবং পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে হিমাচল প্রদেশ গঠিত হয়।
সরকারি ভাষা বিতর্ক:
- ভারতের সংবিধানে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও (১৯৫০), ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজিকেও সহযোগী ভাষা হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হয়।
- অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলি, বিশেষত দক্ষিণ ভারত, হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার তীব্র বিরোধিতা করে।
- এই পরিস্থিতিতে ১৯৬৩ সালে ‘সরকারি ভাষা আইন’ পাস করে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিকেও অনির্দিষ্টকালের জন্য সরকারি কাজে ব্যবহারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৬৪ পর্যন্ত সংবিধানে ১৪টি ভাষা (অসমিয়া, বাংলা, গুজরাটি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মীরি, মালয়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত, তামিল, তেলুগু ও উর্দু) স্বীকৃত ছিল।

Political map of India, 1956, after the States Reorganisation Act, 1956
Political map of India, 1964

এই ছিল অষ্টম অধ্যায়ের সম্পূর্ণ নোটস এবং প্রাসঙ্গিক ইনফোগ্রাফিক আইডিয়া। আশা করি, এই বিস্তারিত আলোচনা তোমার পরীক্ষার প্রস্তুতিতে অনেক সাহায্য করবে! Sources