পঞ্চম অধ্যায়: বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ | Free history class 10 chapter 5 question answer

history class 10 chapter 5 question answer

🚀 ‘বিকল্প চিন্তা ও উদ্যোগ’ অধ্যায়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নাও এই পেজ থেকে! ছাপাখানার রোমাঞ্চকর ইতিহাস, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার অভাবনীয় অগ্রগতি থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর যুগান্তকারী ভাবনা – সবকিছুর উপর সম্ভাব্য সেরা class 10 history chapter 5 questions and answers পাবে এখানেই। পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় history class 10 chapter 5 question answer গুলি তোমাদের বোঝার সুবিধার জন্য সহজ ভাষায়, পয়েন্ট করে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত, বিশ্লেষণধর্মী বা ব্যাখ্যামূলক – যেমন প্রশ্নই আসুক না কেন, প্রস্তুতিতে কোনো ফাঁক থাকবে না। এখনই পড়া শুরু করো!


১. প্রশ্ন: জেমস অগাস্টাস হিকি বিখ্যাত কেন?

উত্তর: জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন একজন আইরিশ মুদ্রণ ব্যবসায়ী। তিনি:

  • ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রথম বেসরকারি ছাপাখানা স্থাপন করেন।
  • ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারত তথা এশিয়ার প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ (যা ‘হিকির গেজেট’ নামেও পরিচিত) প্রকাশ করেন।

২. প্রশ্ন: ছাপাখানার বিকাশে পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: বাংলা মুদ্রণশিল্পের বিকাশে হুগলির পঞ্চানন কর্মকারের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:

  • তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ স্বর্ণশিল্পী ও হরফ খোদাইকারী।
  • চার্লস উইলকিনসের তত্ত্বাবধানে ও সহযোগিতায় তিনি প্রথম উন্নতমানের বাংলা অক্ষরের ছাঁচ বা টাইপ তৈরি করেন, যা বাংলা মুদ্রণকে সচল করে তোলে এবং তাকে ‘বাংলা টাইপের জনক’ হিসেবে পরিচিতি দেয়।

৩. প্রশ্ন: শ্রীরামপুর ত্রয়ী কাদের বলা হয়?

উত্তর: শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের তিনজন প্রধান মিশনারি, যারা উনিশ শতকের শুরুতে বাংলায় আধুনিক শিক্ষা ও মুদ্রণ শিল্পের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের একত্রে ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ বলা হয়। এঁরা হলেন:

  • উইলিয়াম কেরি (William Carey)
  • জোশুয়া মার্শম্যান (Joshua Marshman)
  • উইলিয়াম ওয়ার্ড (William Ward)

৪. প্রশ্ন: মুদ্রণশিল্পে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদান কী ছিল?

উত্তর: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫) বাংলার মুদ্রণশিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও শৈল্পিক উৎকর্ষের সমন্বয় ঘটান:

  • তিনি উন্নতমানের ‘হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং’ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং ছবি ছাপার মানোন্নয়ন ঘটান।
  • রঙিন ছবি মুদ্রণের কৌশল (যেমন – ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন, ডায়াফ্রাম পদ্ধতি, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র) ব্যবহার করে শিশুসাহিত্য ও ‘সন্দেশ’ পত্রিকাকে আকর্ষণীয় করে তোলেন।
  • তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ (১৮৯৫) ছাপাখানাটি তৎকালীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

৫. প্রশ্ন: বাংলায় লাইনোটাইপ প্রবর্তনের গুরুত্ব কী?

উত্তর: বাংলা মুদ্রণশিল্পে লাইনোটাইপ প্রবর্তনের গুরুত্ব:

  • আনন্দবাজার পত্রিকার সুরেশচন্দ্র মজুমদার এই উন্নত বাংলা টাইপসেটিং প্রযুক্তি প্রবর্তন করেন।
  • এর ফলে হাতে অক্ষর সাজানোর পরিবর্তে মেশিনের সাহায্যে অত্যন্ত দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ধাতব হরফে কম্পোজ করা সম্ভব হয়।
  • এটি সংবাদপত্র ও বই মুদ্রণের গতি ও মানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে (১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ব্যবহৃত)।

৬. প্রশ্ন: গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য কে ছিলেন?

উত্তর: গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ছিলেন উনিশ শতকের প্রথম দিকের একজন বাঙালি:

  • যিনি শ্রীরামপুর প্রেসে কাজ করার পর কলকাতায় এসে মুদ্রণ, প্রকাশনা ও পুস্তক বিক্রয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
  • তিনি ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ নামে নিজস্ব ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।
  • তাঁর প্রেস থেকেই প্রথম সচিত্র বাংলা গ্রন্থ ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৮১৬) প্রকাশিত হয়।

৭. প্রশ্ন: বাংলার মুদ্রণের ইতিহাসে বটতলা প্রকাশনার গুরুত্ব কী?

উত্তর: উনিশ শতকে কলকাতার বটতলা অঞ্চলের প্রকাশনাগুলির গুরুত্ব ছিল:

  • এখান থেকে খুব কম দামে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে প্রচুর বই (যেমন – ধর্মীয় বই, লোকসাহিত্য, পুঁথি, পাঁচালি, সচিত্র বই) ছাপা হতো, যা পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  • এই প্রকাশনাগুলি বাংলা মুদ্রণকে একটি জনপ্রিয় ব্যবসায় পরিণত করতে এবং স্থানীয় হরফ নির্মাতা ও চিত্রকরদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করেছিল।

৮. প্রশ্ন: ছাপা বই শিক্ষা প্রসারে কী ভূমিকা নিয়েছিল?

উত্তর: ছাপা বই শিক্ষা প্রসারে বৈপ্লবিক ভূমিকা পালন করে:

  • বইয়ের দাম কমে যাওয়ায় ও সহজলভ্য হওয়ায় শিক্ষা সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়(গণশিক্ষা)।
  • বিপুল পরিমাণে পাঠ্যপুস্তক (যেমন – বর্ণপরিচয়, শিশুশিক্ষা) ছাপা হওয়ায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে।
  • মাতৃভাষায় বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশিত হওয়ায় জ্ঞানচর্চার সুযোগ বৃদ্ধি পায়।

৯. প্রশ্ন: ‘বিদ্যাসাগর সাট’ বলতে কী বোঝায়?

উত্তর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার বিন্যাস এবং কিছু বর্ণের রূপে পরিবর্তন এনেছিলেন যাতে তা শিশুদের ও নতুন শিক্ষার্থীদের পক্ষে শেখা সহজ হয়। তিনি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা নির্দিষ্ট করেন এবং কিছু যুক্তাক্ষর সরল করেন। বাংলা মুদ্রণের জন্য তাঁর এই সংস্কার করা অক্ষরবিন্যাস পদ্ধতিই ‘বিদ্যাসাগর সাট’ নামে পরিচিত।

১০. প্রশ্ন: শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত দুটি সংবাদপত্রের নাম লেখো।

উত্তর: শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত দুটি উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র হল:

  • ‘দিগদর্শন’ (মাসিক, ১৮১৮) – এটি ছিল বাংলা ভাষার প্রথম সাময়িকপত্র।
  • ‘সমাচার দর্পণ’ (সাপ্তাহিক, ১৮১৮) – এটি ছিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্রগুলির মধ্যে অন্যতম।

১. প্রশ্ন: হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ কেন? বাংলার ছাপাখানার বিকাশে চার্লস উইলকিনস-এর ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর গুরুত্ব: নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড রচিত ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৭৭৮) গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ:

  • এটি আধুনিক বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ বই।
  • এই গ্রন্থেই বাংলা হরফের (যা চার্লস উইলকিনস ও পঞ্চানন কর্মকার তৈরি করেন) সার্থক ব্যবহার প্রথম দেখা যায়, যা বাংলা মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
  • এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শিখতে সাহায্য করেছিল, যা প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কাজে প্রয়োজনীয় ছিল।
  • বাংলা গদ্যের একটি প্রাথমিক নিদর্শন ও মান রূপ এতে পাওয়া যায়।

বাংলা ছাপাখানার বিকাশে চার্লস উইলকিনস-এর ভূমিকা: চার্লস উইলকিনসকে যথার্থই ‘বাংলা মুদ্রণশিল্পের জনক’ বলা হয়। তাঁর প্রধান ভূমিকা:

  • বাংলা হরফ নির্মাণ: তিনিই প্রথম বাংলা অক্ষরের ব্যবহারিক ও মুদ্রণযোগ্য নকশা বা টাইপ তৈরি করেন।
  • ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা: হুগলির চুঁচুড়ায় (১৭৭৮) এবং পরে কলকাতায় কোম্পানির প্রেস (‘অনারেবল কোম্পানিজ প্রেস’, ১৭৭৯) প্রতিষ্ঠায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
  • প্রথম বই মুদ্রণ: তাঁর তৈরি হরফ এবং হুগলিতে অ্যান্ড্রুজের ছাপাখানাতেই হ্যালহেডের বইটি ছাপা সম্ভব হয়েছিল।
  • সহযোগী তৈরি: তিনি পঞ্চানন কর্মকারের মতো দেশীয় কারিগরকে হরফ তৈরির কৌশল শিখিয়ে এই শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন।

২. প্রশ্ন: বাংলায় গণশিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানার কী ভূমিকা ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড (‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’) কর্তৃক ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস বাংলায় গণশিক্ষার প্রসারে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে।

  • সুলভে ও বিনামূল্যে বই বিতরণ: এই প্রেসে বিপুল পরিমাণে বই ছাপা হওয়ায় এবং ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭) ও ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি (১৮১৮) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা সস্তায় বা বিনামূল্যে বিতরণ করার ফলে শিক্ষা সাধারণ মানুষের নাগালে আসে।
  • মাতৃভাষায় শিক্ষা: বাংলা সহ প্রায় ৪০টি ভারতীয় ভাষায় পাঠ্যপুস্তক, ব্যাকরণ, অভিধান ইত্যাদি প্রকাশিত হওয়ায় মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার পথ সুগম হয়।
  • জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার: বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, হিতোপদেশ প্রভৃতির অনুবাদ এবং বিভিন্ন মৌলিক গ্রন্থ (যেমন – রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’) প্রকাশিত হওয়ায় জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়।
  • সংবাদপত্র প্রকাশ: প্রথম বাংলা সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’ (মাসিক) ও অন্যতম প্রথম সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ (সাপ্তাহিক) এখান থেকে প্রকাশিত হয়ে গণচেতনা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
  • বিদ্যালয় স্থাপন: মিশনের উদ্যোগে বাংলায় বহু প্রাথমিক বিদ্যালয় ও প্রথম মহিলা বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ায় শিক্ষার প্রসার ঘটে।

উপসংহার: শ্রীরামপুর প্রেস মুদ্রণ ও প্রকাশনার মাধ্যমে শিক্ষাকে মুষ্টিমেয়র গণ্ডি থেকে মুক্ত করে গণশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

৩. প্রশ্ন: ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করো।

উত্তর: ছাপা বই ও শিক্ষাবিস্তারের মধ্যে একটি গভীর ও পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান:

  • শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি: ছাপাখানার পূর্বে হাতে লেখা পুঁথি দুষ্প্রাপ্য ও দামি হওয়ায় শিক্ষা ছিল সীমিত। ছাপা বই সুলভ ও সহজলভ্য হওয়ায় সমাজের সকল স্তরের মানুষের কাছে শিক্ষার সুযোগ প্রসারিত হয়।
  • পাঠ্যপুস্তকের জোগান: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাঠ্যপুস্তকের চাহিদা বাড়ে। ছাপাখানা বিপুল পরিমাণে পাঠ্যবই সরবরাহ করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখে।
  • মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা: ছাপা বইয়ের মাধ্যমে মাতৃভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন সহজ হয়, যা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করে ও বোধগম্যতা বাড়ায়।
  • জ্ঞান ও তথ্যের প্রসার: পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে বই ও পত্রপত্রিকা ছাপা হওয়ায় জ্ঞানচর্চার পরিধি گسترده হয় এবং আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে।
  • মানসিক বিকাশ: সহজলভ্য বই পড়ার অভ্যাসের মাধ্যমে মানুষের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে। জ্ঞান সংরক্ষণের জন্য শুধুমাত্র স্মৃতির উপর নির্ভরতা কমে।

উপসংহার: ছাপা বই জ্ঞানকে democratize করে, শিক্ষাকে সর্বজনীন করার পথ খুলে দেয় এবং একটি আধুনিক, শিক্ষিত সমাজ গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

৪. প্রশ্ন: বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা আলোচনা করো। অথবা, মুদ্রণশিল্পে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কীভাবে বিপ্লব এনেছিলেন? অথবা, বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকার মূল্যায়ন করো।

উত্তর: ভূমিকা: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫) ছিলেন একাধারে শিশুসাহিত্যিক, চিত্রকর, সংগীতজ্ঞ এবং একজন যুগান্তকারী মুদ্রণ প্রযুক্তিবিদ, যিনি বাংলার মুদ্রণশিল্পকে বিশ্বমানে উন্নীত করেছিলেন।

  • ইউ রায় অ্যান্ড সন্স: তিনি উন্নত মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও ব্যবসার জন্য প্রথমে ব্লক তৈরির কাজ শুরু করেন এবং ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯১৩ সালে গড়পার রোডে নিজস্ব আধুনিক ছাপাখানা স্থাপন করেন।
  • হাফটোন ব্লক ও রঙিন মুদ্রণ: তিনিই ভারতে উন্নতমানের ‘হাফটোন ব্লক প্রিন্টিং’ পদ্ধতির যথার্থ প্রবর্তক। তিনি আলো ও রঙের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করে ছবি ছাপার বিভিন্ন কৌশল (ষাট ডিগ্রি স্ক্রিন, ডায়াফ্রাম পদ্ধতি, স্ক্রিন অ্যাডজাস্টার যন্ত্র, রিপ্রিন্ট ইত্যাদি) উদ্ভাবন বা উন্নত করেন, যার ফলে তাঁর প্রেস থেকে নিখুঁত ও আকর্ষণীয় রঙিন ছবি ছাপা সম্ভব হয়।
  • আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও গবেষণা: মুদ্রণ প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ বিদেশের বিখ্যাত ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’-এ প্রকাশিত হয়। তিনি পুত্র সুকুমার রায়কে এই বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠান।
  • উচ্চমানের প্রকাশনা: তিনি নিজের লেখা ও আঁকা বইগুলি (‘ছেলেদের রামায়ণ’, ‘টুনটুনির বই’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ইত্যাদি) এবং ছোটদের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সন্দেশ’ (১৯১৩) তাঁর প্রেস থেকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে ও উন্নত মুদ্রণে প্রকাশ করেন, যা প্রকাশনা জগতে এক নতুন معیار স্থাপন করে।

উপসংহার: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মুদ্রণকে শুধুমাত্র একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে দেখেননি, তিনি একে একটি শিল্প ও বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। তাঁর উদ্ভাবনী প্রতিভা ও শৈল্পিক রুচি বাংলার মুদ্রণশিল্পে এক প্রকৃত বিপ্লব এনেছিল।


১. প্রশ্ন: বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব ও প্রসারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর: ভূমিকা: আধুনিক ছাপাখানার উদ্ভব ইউরোপে ঘটলেও, এর প্রযুক্তি বাংলায় পৌঁছাতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। তবে একবার শুরু হওয়ার পর, বিশেষত উনিশ শতকে, বাংলায় মুদ্রণশিল্পের অভাবনীয় প্রসার ঘটে, যা রাজ্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে।

  • প্রথম উদ্যোগ (ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক):
    • ভারতে প্রথম ছাপাখানা স্থাপিত হয় গোয়ায়, পোর্তুগিজদের দ্বারা (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ)।
    • বাংলায় আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের আগমন ঘটে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে। কলকাতায় জেমস অগাস্টাস হিকি (১৭৭৭) এবং হুগলির চুঁচুড়ায় চার্লস উইলকিনস (১৭৭৮) প্রথম দিকের বেসরকারি প্রেস স্থাপন করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস সরকারি প্রেসও স্থাপন করেন (১৭৭৯)।
  • বাংলা হরফের উদ্ভব:
    • প্রাথমিকভাবে পোর্তুগিজরা রোমান হরফে বাংলা বই ছাপাত।
    • চার্লস উইলকিনস প্রথম বাংলা মুদ্রণের উপযোগী অক্ষরের নকশা তৈরি করেন।
    • হুগলির পঞ্চানন কর্মকার উইলকিনসের তত্ত্বাবধানে উন্নতমানের বাংলা হরফের ছাঁচ (টাইপ) তৈরি করে এই কাজে বিপ্লব আনেন। তাঁকে ‘বাংলা টাইপের জনক’ বলা হয়।
    • পরবর্তীকালে পঞ্চাননের জামাতা মনোহর কর্মকার এবং আরও পরে সুরেশচন্দ্র মজুমদার (লাইনোটাইপ) বাংলা হরফকে আরও উন্নত করেন।
  • প্রথম বাংলা মুদ্রণ:
    • ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ‘এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৭৭৮) হল বাংলা হরফে ছাপা প্রথম বই।
    • গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য প্রকাশিত ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ (১৮১৬) প্রথম সচিত্র বাংলা বই।
  • শ্রীরামপুর মিশনের যুগান্তকারী ভূমিকা (১৮০০ পরবর্তী):
    • উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর মিশন প্রেস (১৮০০) বাংলা মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে স্বর্ণযুগের সূচনা করে।
    • এখান থেকে বাংলা সহ বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারতের অনুবাদ, প্রচুর পাঠ্যপুস্তক, রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’-এর মতো মৌলিক গ্রন্থ এবং ‘সমাচার দর্পণ’ ও ‘দিগদর্শন’-এর মতো প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়।
    • সুলভ মূল্যের কারণে এখান থেকে মুদ্রিত বই গণশিক্ষার প্রসারে বিরাট ভূমিকা নেয়।
  • বাঙালিদের উদ্যোগ ও ব্যবসায়িক প্রসার (উনিশ শতক):
    • গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য (‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (‘সংস্কৃত যন্ত্র’), বটতলার বিভিন্ন প্রকাশক, দুর্গাচরণ গুপ্ত (‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’), বরদাপ্রসাদ মজুমদার (‘দেব সাহিত্য কুটির’), পি. এম. বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’) প্রমুখের উদ্যোগে মুদ্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পরিণত হয়।
    • পাঠ্যপুস্তক, ধর্মীয় গ্রন্থ, পঞ্জিকা, সাহিত্য, সংবাদপত্র ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের মুদ্রণের চাহিদা বাড়ে।
  • প্রযুক্তিগত উন্নতি:
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী হাফটোন ব্লক, রঙিন মুদ্রণ ইত্যাদি উন্নত করেন।
    • সুরেশচন্দ্র মজুমদার লাইনোটাইপ প্রবর্তন করে মুদ্রণে গতি আনেন।

উপসংহার: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে উনিশ শতক জুড়ে বিদেশি মিশনারি ও পরে বাঙালি উদ্যোক্তাদের হাত ধরে বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব ও প্রসার ঘটে। এই প্রসার শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত ছিল না, এটি বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতিতে এক নবজাগরণের সূচনা করেছিল।

২. প্রশ্ন: ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষাবিস্তারের সম্পর্ক সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ছাপা বইয়ের আবির্ভাব শিক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে মুক্তি দিয়ে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পথ খুলে দেয়। উনিশ শতকের বাংলায় এই সম্পর্কটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

  • শিক্ষার গণতন্ত্রীকরণ ও সহজলভ্যতা: ছাপাখানার আগে জ্ঞান মূলত হাতে লেখা পুঁথির মাধ্যমে সংরক্ষিত ও বিতরিত হতো, যা ছিল সময়সাপেক্ষ, শ্রমসাধ্য এবং মহার্ঘ্য। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে পুঁথি সংগ্রহ করে বা অনুলিপি তৈরি করে শিক্ষালাভ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ছাপাখানা অল্প সময়ে, কম খরচে বই তৈরি করতে সক্ষম হয়। এর ফলে বইয়ের দাম কমে যায় এবং তা দরিদ্র শিক্ষার্থীসহ সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসে। এভাবেই শিক্ষা মুষ্টিমেয়র অধিকার থেকে সাধারণের অধিকারে পরিণত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করে।
  • পাঠ্যপুস্তকের জোগান ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রচুর পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন হয়। ছাপাখানাগুলি দ্রুত ও সুলভে সেই চাহিদা পূরণ করে। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’ থেকে শুরু করে গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের বই লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হয়ে গ্রামবাংলার ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে যায়, যা আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিতকে শক্তিশালী করে।
  • মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ: ছাপাখানার মাধ্যমেই প্রথম বাংলা ভাষায় (বা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায়) প্রচুর পরিমাণে বইপত্র লেখা ও প্রকাশ করা সম্ভব হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিদেশি ভাষার পরিবর্তে নিজেদের পরিচিত মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জন করার সুযোগ পায়। এটি শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ায় এবং জ্ঞানকে সহজবোধ্য করে তোলে।
  • জ্ঞানচর্চার পরিধি বৃদ্ধি: ছাপা বই শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসারে সাহায্য করেনি, এটি জ্ঞানচর্চার সার্বিক পরিধিকেও বিস্তৃত করেছে। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি, সাম্প্রতিক ঘটনা ইত্যাদি নানা বিষয়ের বই ও পত্রপত্রিকা সুলভে উপলব্ধ হওয়ায় সাধারণ পাঠকের জানার সুযোগ বাড়ে। বিভিন্ন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিতি ঘটে, যা মানুষের মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়তা করে।
  • নবজাগরণে ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণে ছাপা বইয়ের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। নতুন জ্ঞান, যুক্তিবাদী চিন্তা, সমাজ সংস্কারের ধারণা, জাতীয়তাবাদী ভাবনা ইত্যাদি ছাপা বই ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমেই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ক্রমশ সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

উপসংহার: ছাপা বই ছিল উনিশ শতকের বাংলায় (তথা ভারতে) শিক্ষাবিস্তার ও নবজাগরণের প্রধান চালিকাশক্তি। এটি জ্ঞানকে democratize করেছে, শিক্ষার সুযোগকে প্রসারিত করেছে এবং আধুনিক মনন গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে।

৩. প্রশ্ন: বাংলার ছাপাখানা ও মুদ্রণের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: ভূমিকা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক স্তম্ভস্বরূপ ব্যক্তিত্ব। সমাজ সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার, নারী মুক্তি, বাংলা গদ্যের বিকাশ – প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। এর পাশাপাশি, বাংলা মুদ্রণশিল্পের উন্নতি ও প্রসারেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

  • ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা (‘সংস্কৃত যন্ত্র’): বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার প্রসারের জন্য বিশেষত শিশুপাঠ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বাংলা বই সুলভে ও উন্নত মানের মুদ্রণে প্রকাশ করা জরুরি। এই উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সাথে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে তিনি এই প্রেসের একক মালিক হন।
  • বাংলা হরফের সংস্কার (‘বিদ্যাসাগর সাট’): তৎকালীন বাংলা হরফে কিছু জটিলতা ও অস্পষ্টতা ছিল। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালাকে সুশৃঙ্খল ও মুদ্রণের উপযোগী করে তোলার জন্য এর সংস্কার করেন। তিনি স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা নির্দিষ্ট করেন (১২টি স্বর, ৪০টি ব্যঞ্জন), কিছু বর্ণের আকৃতি পরিবর্তন করেন, অপ্রয়োজনীয় বর্ণ বাদ দেন এবং বিশেষত য-ফলা, র-ফলা, রেফ, উ/ঊ-কার, ঋ-কার প্রভৃতির ব্যবহার এবং ‘ড়’, ‘ঢ়’ বর্ণের স্বতন্ত্র রূপদান করে বাংলা লিপিকে সহজবোধ্য ও আধুনিক করে তোলেন। তাঁর এই সংস্কার ‘বিদ্যাসাগর সাট’ নামে পরিচিত।
  • উন্নত ও নির্ভুল মুদ্রণ: বিদ্যাসাগর তাঁর প্রেস থেকে প্রকাশিত বইগুলির মুদ্রণ পারিপাট্য, নির্ভুলতা ও গুণমানের উপর অত্যন্ত জোর দিতেন। তিনি নিজে প্রুফ দেখতেন এবং বইগুলিকে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করতেন। তাঁর সম্পাদিত ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
  • যুগান্তকারী পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ: বাংলা শিক্ষাজগতে বিপ্লব সৃষ্টিকারী তাঁর নিজের লেখা বইগুলি (যেমন – ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, ‘বোধোদয়’, ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’ ইত্যাদি) তিনি মূলত তাঁর ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ প্রেস থেকেই প্রকাশ করেন। এর মধ্যে ‘বর্ণপরিচয়’ লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে বাংলা প্রাথমিক শিক্ষায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
  • পুস্তক ব্যবসা ও বিপণন: বিদ্যাসাগর বই ছাপার পাশাপাশি সেগুলির বিক্রির জন্যও উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’ (১৮৪৭) নামে একটি বইয়ের দোকান খোলেন, যা ছিল সম্ভবত বাঙালি পরিচালিত প্রথম বইয়ের দোকানগুলির অন্যতম। এটি বইয়ের ব্যবসা ও বিপণনে একটি নতুন ধারার সূচনা করে।

উপসংহার: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা, হরফ সংস্কার, মানসম্পন্ন মুদ্রণ এবং যুগোপযোগী পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের মাধ্যমে উনিশ শতকে বাংলা মুদ্রণশিল্পকে যেমন উন্নত করেছিলেন, তেমনই শিক্ষাবিস্তারের পথকেও বহুলাংশে সুগম করেছিলেন। তাঁর অবদান বাংলা ভাষা ও সমাজকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।


১. প্রশ্ন: ব্রিটিশ শাসনকালে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।

উত্তর: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হল:

  • ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স (IACS) (১৮৭৬)
  • কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (১৯১৪)
  • বসু বিজ্ঞান মন্দির (বোস ইন্সটিটিউট) (১৯১৭)
  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬) (বিজ্ঞান ও কারিগরি উভয়ই)
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI) (১৯০৬)

২. প্রশ্ন: ব্রিটিশ শাসনকালে কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।

উত্তর: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল:

  • ক্যালকাটা কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (১৮৫৬) (পরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিবপুর)
  • অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন (১৯০৪)
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI) (১৯০৬) (পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ)

৩. প্রশ্ন: কে, কবে, কোথায় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন? অথবা, IACS কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন?

উত্তর:

  • কে: বিখ্যাত চিকিৎসক ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার।
  • কবে: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই।
  • কোথায়: কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে (পরে যাদবপুরে স্থানান্তরিত)। (বিশিষ্ট বিজ্ঞান অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো তাঁকে এই কাজে সহায়তা করেন)।

৪. প্রশ্ন: ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?

উত্তর: আই এ সি এস (IACS) প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল:

  • ভারতে বিজ্ঞান, বিশেষত পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিষয়ে মৌলিক গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার উন্নতি ঘটানো।
  • বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতা ও আলোচনার আয়োজন করে বিজ্ঞান চেতনা প্রসারিত করা।
  • ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করা।

৫. প্রশ্ন: উনিশ শতকে বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর ভূমিকা কী ছিল? অথবা, বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে IACS-এর ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে IACS-এর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ:

  • এটি ছিল ভারতে বিজ্ঞানচর্চার প্রথম এবং অন্যতম প্রধান দেশীয় উদ্যোগ।
  • এখানে জগদীশচন্দ্র বসু, সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃষ্ণান প্রমুখ খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করার সুযোগ পান।
  • এখানকার গবেষণার ফলেই সি ভি রমন ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পান (১৯৩০)।
  • এই প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল (‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’) প্রকাশ করে গবেষণার প্রসারে সাহায্য করে।

৬. প্রশ্ন: মহেন্দ্রলাল সরকার কে ছিলেন? অথবা, ড. মহেন্দ্রলাল সরকার স্মরণীয় কেন?

উত্তর: ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৪) ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক (অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি উভয়ক্ষেত্রেই পারদর্শী) এবং বিজ্ঞান আন্দোলনের পুরোধা। তিনি মূলত স্মরণীয়:

  • ভারতে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার প্রসারের লক্ষ্যে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (IACS) প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
  • ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদ প্রসারের চেষ্টার জন্য।

৭. প্রশ্ন: কে, কোথায় গবেষণা করে ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করেন?

উত্তর: বিজ্ঞানী স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন (সি ভি রমন) কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (IACS)-এ গবেষণা করে তাঁর বিখ্যাত ‘রমন এফেক্ট’ (আলোর বিক্ষেপণ সংক্রান্ত তত্ত্ব) আবিষ্কার করেন (১৯২৮)।

৮. প্রশ্ন: কারা, কবে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন?

উত্তর:

  • কারা: মূলত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য)-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের বিপুল অর্থদানে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • কবে: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মার্চ।

৯. প্রশ্ন: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষকের নাম লেখো।

উত্তর: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের প্রথমদিকের কয়েকজন খ্যাতনামা শিক্ষক ছিলেন:

  • আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (রসায়ন)
  • স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন (পদার্থবিদ্যা)
  • শিশির কুমার মিত্র (পদার্থবিদ্যা)
  • গণেশ প্রসাদ (গণিত)

১০. প্রশ্ন: কে, কবে বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন? বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর:

  • কে ও কবে: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • উদ্দেশ্য: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োফিজিক্স ইত্যাদি) মৌলিক গবেষণা চালানো এবং বিজ্ঞানের সত্যকে উন্মোচিত করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য।

১১. প্রশ্ন: বসু বিজ্ঞান মন্দিরকে মন্দির বলা হয় কেন?

উত্তর: প্রতিষ্ঠাতা জগদীশচন্দ্র বসু মনে করতেন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ও পদ্ধতির মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা করা গেলেও, এমন কিছু গভীর সত্য থাকে যা উপলব্ধির জন্য বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়। এই বিশ্বাস প্রভাবিত সত্য উপলব্ধি করার পবিত্র স্থান হিসেবে তিনি তাঁর বিজ্ঞান গবেষণাগারকে ‘মন্দির’ রূপে কল্পনা করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী নামকরণ করেন।

১২. প্রশ্ন: কারিগরি শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত দুটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের নাম লেখো।

উত্তর: কারিগরি শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত দুটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হল:

  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI) (১৯০৬)
  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education) (১৯০৬) (এটি সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার উপরও জোর দিয়েছিল)।

১৩. প্রশ্ন: বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর প্রথম অধ্যক্ষ কে ছিলেন?

উত্তর: বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI)-এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন প্রমথনাথ বসু।


১. প্রশ্ন: ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বাংলায় পাশ্চাত্য ধাঁচের আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার অস্তিত্ব ছিল না। উনিশ শতক থেকে বাংলার আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ শুরু হয়।

  • বিজ্ঞান শিক্ষার প্রেক্ষাপট: এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪), শ্রীরামপুর কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিষয়ক চর্চা শুরু হয়। উইলিয়াম ইয়েটস, জন ম্যাক, ফেলিক্স কেরি প্রমুখ বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু বই বাংলায় লেখেন বা অনুবাদ করেন।
  • বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান:
    • IACS (১৮৭৬): ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার পথিকৃৎ। সি ভি রমন এখানেই নোবেলজয়ী গবেষণা করেন।
    • কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (১৯১৪): আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, তারকনাথ পালিত, রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
    • বসু বিজ্ঞান মন্দির (১৯১৭): জগদীশচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় মৌলিক গবেষণার জন্য বিখ্যাত।
  • কারিগরি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান:
    • বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (শিবপুর): ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পরে এই নামে পরিচিত হয়।
    • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬): স্বদেশি যুগে প্রতিষ্ঠিত এই পরিষদ কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়।
    • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI) (১৯০৬): তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করে।
  • ব্যক্তিগত অবদান: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যালস প্রতিষ্ঠা করেন। জগদীশচন্দ্র বসু ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করেন। গোলকচন্দ্র নন্দী বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করেন।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার যে সূত্রপাত ঘটেছিল তা কিছুকালের মধ্যেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্বাধীন ভারতের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ভিত্তি স্থাপন করে।

২. প্রশ্ন: ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (আই এ সি এস)-এর প্রতিষ্ঠা এবং বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS)-এর অবদান লেখো।

উত্তর: ভূমিকা: ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS) হল ভারতের প্রথম এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা উনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

  • প্রতিষ্ঠা: খ্যাতনামা চিকিৎসক ড. মহেন্দ্রলাল সরকার অধ্যাপক ফাদার ইউজিন লাঁফো-র সহযোগিতায় ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বৌবাজার স্ট্রিটে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স বা আই এ সি এস প্রতিষ্ঠা করেন।
  • গবেষণা: এই প্রতিষ্ঠানে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নিয়মিত মৌলিক গবেষণা এবং বিজ্ঞান-বিষয়ক বক্তৃতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। দেশবিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এতে অংশ নিয়েছেন।
  • গবেষণাপত্র প্রকাশ: এখানকার বিজ্ঞানীদের গবেষণামূলক কাজগুলি প্রকাশের জন্য আই এ সি এস ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে।
  • খ্যাতনামা বিজ্ঞানী: আই এ সি এস-এর বিজ্ঞান গবেষণার কাজের সঙ্গে বিভিন্ন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী যুক্ত ছিলেন, যেমন – জগদীশচন্দ্র বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, চুনিলাল বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, মেঘনাদ সাহা, কে এস কৃষ্ণান প্রমুখ।
  • নোবেল জয়: এখানেই গবেষণা করে বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন তাঁর বিখ্যাত ‘রমন ক্রিয়া’ (রমন এফেক্ট) আবিষ্কার করেন, যার জন্য তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।

উপসংহার: ‘আই এ সি এস’-এর প্রতিষ্ঠা বাংলায় আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে এবং ভারতীয়দের দ্বারা বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

৩. প্রশ্ন: বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ড. মহেন্দ্রলাল সরকারের কীরূপ অবদান ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার বিকাশে ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের (১৮৩৩-১৯০৪) অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ সংস্কারক।

  • যুক্তিবাদের প্রচার: পেশায় চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার মানুষের অন্ধবিশ্বাস দূর করে তাদের যুক্তিবাদের সমর্থক হতে বলেন। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞান চেতনার বিকাশই সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করবে।
  • আই এ সি এস-এর প্রতিষ্ঠা: তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভা’ বা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (IACS) প্রতিষ্ঠা। সম্পূর্ণ দেশীয় উদ্যোগে এবং জনসাধারণের অর্থে এটি গড়ে ওঠে।
  • বিজ্ঞান গবেষণার পরিবেশ তৈরি: তিনি IACS-কে পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণা, বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতা ইত্যাদির একটি उत्कृष्ट কেন্দ্রে পরিণত করেন।
  • বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ: তাঁর উদ্যোগে IACS থেকে নিজস্ব বিজ্ঞান পত্রিকা ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্স’ প্রকাশিত হত।
  • প্রতিভা पोषण: জগদীশচন্দ্র বসু, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিখ্যাত বিজ্ঞানী তাঁর প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন এবং তাঁর উৎসাহ লাভ করেছেন।

উপসংহার: ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চার ভিত্তি স্থাপন করেন, যা আজও অব্যাহত।

৪. প্রশ্ন: আধুনিক বিজ্ঞানচর্চায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের কী ভূমিকা ছিল? অথবা, বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের উৎকর্ষ আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (University College of Science and Technology) আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে।

  • মৌলিক গবেষণা: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সক্রিয় সহযোগিতা পেয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মৌলিক গবেষণার সুযোগ পান, যা বিজ্ঞানচর্চার মানোন্নয়ন ঘটায়।
  • খ্যাতনামা শিক্ষার্থী: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে পড়াশোনা এবং বিজ্ঞানসাধনা করে বহু শিক্ষার্থী পরবর্তীকালে বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
  • খ্যাতনামা শিক্ষক: সেই যুগের বহু স্বনামধন্য শিক্ষক ও বিজ্ঞানী (যেমন – আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন, শিশিরকুমার মিত্র) কলকাতা বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষাদান করেন। তাঁদের পরিশ্রমে এখানে বিশ্বমানের শিক্ষাদানব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
  • শিক্ষকদের উদ্যোগ: এখানকার শিক্ষকরা দেশ ও সমাজ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা করে দেশকে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখান। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা স্বাধীন ভারতে জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনে যুক্ত থেকে দেশ গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

উপসংহার: উপনিবেশিক আমলে ‘কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ’ দেশীয় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এক আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে এবং ভারতের বিজ্ঞান গবেষণাকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে।

৫. প্রশ্ন: বিজ্ঞানের গবেষণায় ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’-এর অবদান সংক্ষেপে লেখো। অথবা, বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের উৎকর্ষ সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞান শিক্ষার বিকাশের উদ্দেশ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দির বা বোস ইন্সটিটিউট (১৯১৭)।

  • বিভিন্ন শাখায় গবেষণা: বসু বিজ্ঞান মন্দির-এ পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, বায়োফিজিক্স, পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশ্বমানের চর্চা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়।
  • উন্নত গবেষণা: জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে বিশ্বমানের উন্নত গবেষণার ব্যবস্থা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তিও ব্যয় করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁকে অর্থ সাহায্য করেন।
  • যুগান্তকারী আবিষ্কার: বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দীর্ঘ গবেষণার পর জগদীশচন্দ্র বসু ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি প্রমাণ করেন, প্রাণীদের মতো উদ্ভিদেরও প্রাণ এবং অনুভূতি শক্তি আছে। তাঁর বেতার তরঙ্গ সংক্রান্ত গবেষণাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে এখানেই শম্ভুনাথ দে কলেরার টক্সিন আবিষ্কার করেন।
  • আন্তর্জাতিক খ্যাতি: বাংলা তথা ভারতের বিজ্ঞান-বিষয়ক গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।

উপসংহার: ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হয়। আধুনিক গবেষণাগারে জগদীশচন্দ্র বসুর যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলি এই প্রতিষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেছে।

৬. প্রশ্ন: বাংলার কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট-এর অবদান লেখো। অথবা, কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বাংলায় ‘বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট’-এর কী ভূমিকা ছিল? অথবা, টীকা লেখো: বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলন শুরু হলে তারকনাথ পালিত প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউট (BTI) প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯০৬)। বাংলার কারিগরি শিক্ষার প্রসারে এর অবদান অনস্বীকার্য।

  • জাতীয় শিক্ষার উদ্যোগ: স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর একটি অন্যতম উদ্যোগ ছিল বাংলায় স্বদেশি ধাঁচে কারিগরি শিক্ষার প্রসার।
  • প্রতিষ্ঠা: আইনজীবী তারকনাথ পালিতের প্রচেষ্টায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে জুলাই কলকাতায় BTI স্থাপিত হয়।
  • সমন্বয় ও কার্যক্রম: দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে BTI এবং ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ’ একত্রে মিশে যায়। এরপর এখানে কলাবিভাগের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা, রসায়ন প্রযুক্তি, শিল্পপ্রযুক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়, যা বাংলার বহু শিক্ষিত যুবককে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে।
  • রূপান্তর: এই সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান পরে ‘কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’ (CET) নাম নেয় (১৯২৮) এবং অবশেষে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’-এ পরিণত হয়।
  • জার্নাল: এখানকার ছাত্ররা ‘টেক’ (Tech) নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করত, যা স্বদেশি আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিল।

উপসংহার: বেঙ্গল টেকনিকাল ইন্সটিটিউটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় শিক্ষার দ্বারা বাংলার যুবকদের কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে তোলা এবং এই প্রতিষ্ঠান তার উদ্দেশ্যপূরণে অত্যন্ত সফল হয়েছিল, যার ফলস্বরূপ আজকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।


১. প্রশ্ন: ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: ব্রিটিশ শাসনকালে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি বাংলায় বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষারও ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটে। সরকারি উদ্যোগ সীমিত থাকলেও বেসরকারি ও বিশেষত দেশীয় উদ্যোগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যা এই শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে।

  • ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS, ১৮৭৬):
    • প্রতিষ্ঠাতা: ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার।
    • ভূমিকা: এটি ছিল ভারতে বিজ্ঞান গবেষণার প্রথম উল্লেখযোগ্য জাতীয় উদ্যোগ। পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে মৌলিক গবেষণার পথ খুলে দেয়। সি ভি রমন এখানেই তাঁর যুগান্তকারী ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পান। এটি বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল প্রকাশ করে এবং বহু খ্যাতনামা বিজ্ঞানীকে গবেষণায় আকৃষ্ট করে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার একটি ধারা তৈরি করে।
  • কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (University College of Science and Technology, ১৯১৪):
    • প্রতিষ্ঠাতা: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (প্রধান উদ্যোক্তা), স্যার তারকনাথ পালিত, স্যার রাসবিহারী ঘোষ (প্রধান অর্থদাতা)।
    • ভূমিকা: এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতকোত্তর স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিশ্বমানের বিজ্ঞানীরা এখানে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেন। এখান থেকে বহু কৃতি ছাত্র (সাহা, বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) তৈরি হন যারা পরবর্তীকালে দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।
  • বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute, ১৯১৭):
    • প্রতিষ্ঠাতা: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু।
    • ভূমিকা: সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পদার্থবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যায় মৌলিক ও আন্তঃশাস্ত্রীয় (interdisciplinary) গবেষণার এক उत्कृष्ट কেন্দ্র ছিল। জগদীশচন্দ্রের যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলি (উদ্ভিদের প্রাণ, ক্রেসকোগ্রাফ, বেতার তরঙ্গ) এখানেই হয়। পরবর্তীকালে শম্ভুনাথ দে-র কলেরা টক্সিন আবিষ্কার এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি করে। এটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে।
  • জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education, ১৯০৬):
    • প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট: স্বদেশি আন্দোলন।
    • ভূমিকা: ব্রিটিশ শিক্ষার বিকল্প হিসেবে জাতীয় আদর্শে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে এটি গঠিত হয়। এর অধীনে বহু জাতীয় বিদ্যালয় ও ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ স্থাপিত হয়। এটি বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম সংগঠিত প্রয়াস চালায়।
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI, ১৯০৬):
    • প্রতিষ্ঠাতা: তারকনাথ পালিত ও সংশ্লিষ্ট সোসাইটি।
    • ভূমিকা: বাংলায় স্বদেশি উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে প্রধান ভূমিকা পালন করে। পরে এটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং কালক্রমে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এটি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন শাখায় (যেমন – কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং) শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে বহু প্রযুক্তিবিদ তৈরি করে।

উপসংহার: এই প্রতিষ্ঠানগুলি শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারই ঘটায়নি, এগুলি ভারতীয়দের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়েছিল এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিগত ও শিল্পোন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ঔপনিবেশিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এদের অবদান অনস্বীকার্য।

২. প্রশ্ন: বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: প্রাক্-ব্রিটিশ যুগে বাংলায় কারিগরি জ্ঞান মূলত বংশপরম্পরায় বা গুরু-শিষ্য ধারায় হস্তান্তরিত হতো। আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক কারিগরি শিক্ষার সূচনা ও বিকাশ ঘটে মূলত ব্রিটিশ শাসনকালে, যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় ধীর ও সীমিত, কিন্তু পরবর্তী অগ্রগতির ভিত্তি স্থাপনকারী।

  • সরকারি উদ্যোগ ও তার সীমাবদ্ধতা:
    • ব্রিটিশ সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের প্রশাসনিক ও পরিকাঠামোগত প্রয়োজন (যেমন – রেল, রাস্তা, টেলিগ্রাফ, পূর্ত দপ্তর) মেটানোর জন্য কিছু নিম্ন ও মধ্য স্তরের কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী তৈরি করা।
    • এই উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ সালে কলকাতায় ‘ক্যালকাটা কলেজ অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং’ স্থাপিত হয়, যা পরে শিবপুরে স্থানান্তরিত হয়ে ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ (বর্তমানে IIEST) নামে পরিচিত হয়। এটি ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রয়াস। তবে উচ্চতর প্রযুক্তি গবেষণা বা ব্যাপক শিল্পায়নের উপযোগী শিক্ষা এখানে অবহেলিত ছিল।
  • ব্যক্তিগত কারিগরি দক্ষতা:
    • প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরেও কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগ দেখা যায়। গোলকচন্দ্র নন্দী নামে কামার পরিবারের এক ব্যক্তি বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরি করেছিলেন। শিবচন্দ্র নন্দী টেলিগ্রাফ ব্যবস্থায় দক্ষতার পরিচয় দেন। এগুলি বিক্ষিপ্ত উদাহরণ হলেও দেশীয় প্রতিভার পরিচায়ক।
  • জাতীয়তাবাদী উদ্যোগ ও স্বদেশি আন্দোলন:
    • উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদী নেতারা উপলব্ধি করেন যে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও আত্মনির্ভরতার জন্য কারিগরি শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য।
    • বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫) সময় এই ভাবনা আরও জোরদার হয়। ব্রিটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কটের পাশাপাশি জাতীয় কারিগরি শিক্ষার দাবি ওঠে।
    • এই প্রেক্ষাপটে কলকাতায় ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন’ (১৯০৪) এবং ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ (১৯০৬) স্থাপিত হয়, যারা কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়।
  • বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট (BTI) ও তার প্রভাব:
    • কারিগরি শিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল আইনজীবী তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’ (BTI) প্রতিষ্ঠা (১৯০৬)।
    • এটি সম্পূর্ণ স্বদেশি ভাবধারায় কারিগরি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।
    • পরবর্তীকালে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সাথে যুক্ত হয়ে এবং বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এটি অবশেষে আজকের ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’-এ (১৯৫৫) রূপান্তরিত হয়।
    • BTI ও তার উত্তরসূরি প্রতিষ্ঠানগুলি মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সহ বিভিন্ন শাখায় বহু দক্ষ প্রযুক্তিবিদ তৈরি করে বাংলার তথা ভারতের শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক সরকারের উদাসীনতা সত্ত্বেও, ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণায় বাংলায় আধুনিক কারিগরি শিক্ষার একটি ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। স্বদেশি যুগের প্রতিষ্ঠানগুলি, বিশেষত BTI বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি, এই ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।



১. প্রশ্ন: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল কেন?

উত্তর: ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ছিল কারণ:

  • এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য কেরানি তৈরি করা, শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ মানসিক বা চারিত্রিক বিকাশ নয়।
  • এটি ছিল মূলত শহরকেন্দ্রিক ও উচ্চবিত্ত-নির্ভর, ফলে দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজ এর সুফল পায়নি।
  • ইংরেজি মাধ্যম হওয়ায় এবং ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবহেলা করায় এটি গণশিক্ষার প্রসারে ব্যর্থ হয়।
  • পাঠ্যক্রম ছিল মূলত পুঁথিগত, মুখস্থ-নির্ভর এবং দেশ ও জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন।

২. প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষা কী?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে শিক্ষা হল:

  • শুধুমাত্র তথ্য আহরণ বা ডিগ্রি লাভ নয়, বরং শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ।
  • প্রকৃতির সাথে, পারিপার্শ্বিক জীবনের সাথে এবং বিশ্বমানবতার সাথে শিক্ষার্থীর আত্মিক সংযোগ স্থাপন।
  • আনন্দের মাধ্যমে, স্বাধীনতার পরিবেশে এবং সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে জ্ঞানার্জন ও চরিত্র গঠন।

৩. প্রশ্ন: শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম (বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল:

  • ঔপনিবেশিক শিক্ষার যান্ত্রিকতা থেকে দূরে, প্রকৃতির মুক্ত পরিবেশে প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে আনন্দময় শিক্ষাদান।
  • পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সৃজনশীল সত্তার বিকাশ ঘটানো।
  • শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সহজ, আত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করা।

৪. প্রশ্ন: কে, কবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন্ কোন্ বিষয় পড়ানো হত?

উত্তর:

  • কে ও কবে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন।
  • বিষয়: এখানে প্রচলিত কলা ও মানববিদ্যা বিষয়গুলির পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কৃষি, পল্লি উন্নয়ন, স্বাস্থ্যবিদ্যা এবং বিভিন্ন ব্যাবহারিক ও কারিগরি বিষয়েও পঠনপাঠন ও গবেষণার ব্যবস্থা ছিল।

৫. প্রশ্ন: বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষকের নাম লেখো।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীতে শিক্ষাদানকারী কয়েকজন খ্যাতনামা বিদেশি শিক্ষক ছিলেন:

  • সিলভা লেভি (ফরাসি ভারততত্ত্ববিদ)
  • উইনটারনিৎস (জার্মান ভারততত্ত্ববিদ)
  • স্টেল্লা ক্রামরিশ (শিল্প ঐতিহাসিক)
  • লেনার্ড এলমহার্স্ট (ব্রিটিশ কৃষি অর্থনীতিবিদ)
  • সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ, ডব্লিউ. ডব্লিউ. পিয়ার্সন (ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ)

৬. প্রশ্ন: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন ‘গোলদিঘির গোলামখানা’ বলে ব্যঙ্গ করা হত?

উত্তর: বিশ শতকের শুরুতে জাতীয়তাবাদী নেতারা মনে করতেন যে, গোলদিঘির (কলেজ স্কোয়ার) কাছে অবস্থিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ শাসকদের প্রয়োজন অনুযায়ী শুধুমাত্র কেরানি বা ‘গোলাম’ তৈরি করছে, প্রকৃত মানুষ বা দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি করছে না। তাই তাঁরা ব্যঙ্গ করে একে ‘গোলদিঘির গোলামখানা’ বলতেন।

৭. প্রশ্ন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ কেন প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (১৯০৬) প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ ছিল:

  • বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার বিকল্প হিসেবে স্বদেশি বা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।
  • জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে শিক্ষাদান করা এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

৮. প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক গঠিত ‘হিতৈষী তহবিল’ কী?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ-পতিসর অঞ্চলের জমিদারির প্রজাদের কল্যাণে ‘হিতৈষী তহবিল’ গঠন করেন। প্রজাদের খাজনার সাথে একটি অতিরিক্ত ক্ষুদ্র অংশ এবং জমিদারি থেকে সমপরিমাণ অর্থ मिलाकर এই তহবিল গঠিত হতো। এই অর্থ গ্রামের রাস্তাঘাট, পানীয় জল, চিকিৎসা, শিক্ষা, সমবায় ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হতো।

৯. প্রশ্ন: শিক্ষা সত্র কী?

উত্তর: ‘শিক্ষা সত্র’ হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয়, যা পরে শ্রীনিকেতনে স্থানান্তরিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের ছেলেমেয়েদের জীবনমুখী ও ব্যাবহারিক শিক্ষাদান করা, যা শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের ধারণার উপর ভিত্তি করে কিন্তু গ্রামীণ জীবনের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছিল।

১০. প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী উদ্দেশ্যে ‘শ্রীনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের অদূরে শ্রীনিকেতন (১৯২২) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মূলত:

  • গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে।
  • কৃষি, গোপালন, কুটিরশিল্প ইত্যাদির উন্নতি সাধন এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে সমবায় প্রথা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য।
  • গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য ব্যাবহারিক ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে।

১১. প্রশ্ন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে গড়ে ওঠা অন্যতম কলেজটির নাম লেখো।

উত্তর: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠা অন্যতম কলেজটির নাম ছিল বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (পরে যা কারিগরি শিক্ষার সাথে যুক্ত হয়)।


১. প্রশ্ন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (NCE) প্রতিষ্ঠা ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষার বিরুদ্ধে বাঙালির এক গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প উদ্যোগ। এর প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ছিল নিম্নরূপ:

  • ঔপনিবেশিক শিক্ষার সীমাবদ্ধতা: কেরানি তৈরি, মাতৃভাষার অবহেলা, জাতীয় সংস্কৃতিকে উপেক্ষা ইত্যাদি কারণে ব্রিটিশ প্রবর্তিত শিক্ষার প্রতি অসন্তোষ ছিল।
  • স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব: ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন জাতীয় চেতনাকে তীব্র করে তোলে। ব্রিটিশ পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্রিটিশ শিক্ষা বয়কটের ডাক দেওয়া হয় (‘গোলদিঘির গোলামখানা’ বর্জন)।
  • বিকল্প শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: বিদেশি শিক্ষা বর্জন করলে তার জায়গায় দেশীয় আদর্শে, মাতৃভাষায় এবং দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি বিকল্প জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার চাহিদা তৈরি হয়।
  • ডন সোসাইটির উদ্যোগ: সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ডন সোসাইটি’ জাতীয় চরিত্র গঠন ও শিক্ষাদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিল। এই সোসাইটির উদ্যোগেই জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব প্রথম গৃহীত হয় (অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটির সভা, নভেম্বর ১৯০৫)।
  • নেতৃবৃন্দের প্রয়াস: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাসবিহারী ঘোষ, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রমুখের চিন্তা, উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয় (১১ই মার্চ, ১৯০৬)।

উপসংহার: জাতীয় শিক্ষা পরিষদ ছিল ঔপনিবেশিক শিক্ষার ব্যর্থতা এবং স্বদেশি আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার মিলিত ফল।

২. প্রশ্ন: ‘জাতীয় শিক্ষার প্রসারে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা কেমন ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: ১৯০৬ সালে গঠিত জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বাংলায় জাতীয় শিক্ষার প্রসারে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু স্বল্পস্থায়ী ভূমিকা পালন করে।

  • উদ্দেশ্য ও আদর্শ: পরিষদ জাতীয় আদর্শ অনুসারে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রদানের লক্ষ্য স্থির করে। নৈতিক শিক্ষা ও দেশপ্রেম জাগানোও এর উদ্দেশ্য ছিল।
  • প্রতিষ্ঠান স্থাপন: পরিষদের অধীনে কলকাতায় ‘বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ (অধ্যক্ষ: অরবিন্দ ঘোষ) স্থাপিত হয়। বাংলার বিভিন্ন জেলায় প্রায় ২৫টি জাতীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
  • কারিগরি শিক্ষার উদ্যোগ: পরিষদ কারিগরি শিক্ষাকেও গুরুত্ব দেয় এবং পরে ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট’ এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
  • আর্থিক সমর্থন: সুবোধচন্দ্র মল্লিক, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী প্রমুখের অর্থদানে এর কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে গতি পায়।
  • ব্যর্থতা: সরকারি স্বীকৃতি ও চাকরির সুযোগ না থাকা, আর্থিক সংকট এবং স্বদেশি আন্দোলনের গতি হ্রাসের ফলে এই উদ্যোগ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ব্যর্থ হয়।

উপসংহার: পূর্ণ সাফল্য না পেলেও, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ বাংলায় বিকল্প শিক্ষার একটি মডেল তৈরি করেছিল এবং জাতীয় চেতনাবোধ সম্পন্ন এক প্রজন্ম তৈরিতে সাহায্য করেছিল।

৩. প্রশ্ন: বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তার পরিচয় দাও।

উত্তর: ভূমিকা: বিশ্বভারতী (১৯২১) ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা সম্পর্কিত দীর্ঘদিনের ভাবনা ও পরীক্ষানিরীক্ষার মূর্ত প্রকাশ। এর প্রতিষ্ঠার পেছনে তাঁর শিক্ষাচিন্তার কয়েকটি মূল দিক প্রতিফলিত হয়েছে:

  • প্রকৃতি-কেন্দ্রিক শিক্ষা: প্রচলিত চার দেওয়ালের শিক্ষার পরিবর্তে তিনি শান্তিনিকেতনের মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে শিক্ষাদানের উপর জোর দেন, যাতে শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে।
  • আনন্দময় শিক্ষা: শিক্ষা যাতে শিক্ষার্থীর কাছে বোঝা না হয়ে ওঠে, তাই তিনি সঙ্গীত, নৃত্য, কলা, নাটক, ঋতু-উৎসব ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলার পক্ষপাতী ছিলেন।
  • প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সমন্বয়: তিনি বিশ্বভারতীকে বিশ্বজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র (‘যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেকনীড়ম্’) হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সংস্কৃতির মিলন ঘটবে।
  • সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব: পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তা, সৃজনশীলতা ও আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
  • পূর্ণাঙ্গ মানব বিকাশ: তাঁর লক্ষ্য ছিল শুধুমাত্র জ্ঞানার্জন নয়, শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক – এই সামগ্রিক সত্তার বিকাশ ঘটিয়ে তাকে ‘পরিপূর্ণ মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলা।

উপসংহার: বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ এক গতানুগতিকতাহীন, জীবনমুখী, বিশ্বজনীন ও মানবতাবাদী শিক্ষাদর্শকে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন।

৪. প্রশ্ন: মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাদর্শনে মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার মধ্যে এক গভীর সমন্বয় সাধনের চেষ্টা দেখা যায়:

  • প্রকৃতির ভূমিকা: তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি হলো শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিশুর ইন্দ্রিয়গুলি সজাগ হয়, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে এবং তার মধ্যে এক স্বাভাবিক শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যবোধ জন্মায়। তাই শান্তিনিকেতনে তিনি প্রকৃতির কোলে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।
  • মানুষের স্থান: তাঁর কাছে শিক্ষা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জ্ঞানার্জন নয়, তা মানুষকে বৃহত্তর মানবসমাজের সঙ্গে যুক্ত করে। শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিক্ষাকে গ্রামীণ মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি জাতিভেদহীন, সম্প্রীতিপূর্ণ মানবসমাজ গঠনের কথা বলেন, যেখানে শিক্ষা মানুষকে মেলাতে সাহায্য করবে।
  • শিক্ষার লক্ষ্য: শিক্ষার লক্ষ্য হবে এই প্রকৃতি ও মানুষের জগৎ থেকে জ্ঞান আহরণ করে শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো। শিক্ষা যান্ত্রিক বা জীবনবিচ্ছিন্ন হবে না, বরং তা হবে আনন্দময়, সৃজনশীল এবং জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
  • সমন্বয়ের ফলাফল: যখন প্রকৃতি, মানুষ ও বৌদ্ধিক শিক্ষা—এই তিনের মধ্যে সমন্বয় ঘটে, তখনই শিক্ষার্থীর যথার্থ ও সামগ্রিক বিকাশ সম্ভব হয়, সে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথের এই সমন্বয়ধর্মী শিক্ষাচিন্তা এক অখণ্ড জীবনবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আধুনিক শিক্ষার যান্ত্রিকতা ও বিচ্ছিন্নতার একটি সার্থক বিকল্প।

৫. প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার স্বরূপ কী ছিল?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন লেখায় (যেমন – ‘শিক্ষার হেরফের’, ‘তোতাকাহিনী’) ভারতে প্রচলিত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এর স্বরূপ ছিল:

  • যান্ত্রিক ও প্রাণহীন: তিনি এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘কল’ বা কারখানার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে কেরানি তৈরি করা হয়, কিন্তু শিক্ষার্থীর মনের বিকাশ হয় না (“ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল”)।
  • প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন: এই শিক্ষা ব্যবস্থা চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ এবং প্রকৃতি ও জীবনের বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
  • আনন্দহীন: মুখস্থবিদ্যা ও পরীক্ষার উপর অত্যাধিক জোর দেওয়ায় শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে আনন্দদায়ক না হয়ে ভীতিপ্রদ ও নীরস বিষয়ে পরিণত হয় (‘তোতাকাহিনী’র খাঁচাবন্দী পাখির মতো)।
  • মাতৃভাষা অবহেলিত: শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় তা বহু শিক্ষার্থীর কাছে দুর্বোধ্য ছিল এবং মাতৃভাষায় স্বাভাবিক জ্ঞানচর্চা ও চিন্তার বিকাশ ব্যাহত হতো।
  • উদ্দেশ্যমূলক: এর মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য অনুগত কর্মচারী তৈরি করা, ভারতীয়দের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা বা তাদের জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল করা নয়। এটিকে তিনি ‘জ্ঞানভিক্ষার কেন্দ্র’ বলেছেন।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ, যান্ত্রিক, হৃদয়হীন এবং ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিহীন বলে মনে করতেন এবং এর বিকল্প হিসেবেই তিনি শান্তিনিকেতনের ভাবনা ভেবেছিলেন।

৬. প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনার সমালোচনামূলক আলোচনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাভাবনা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রগতিশীল, মানবতাবাদী এবং আধুনিক শিক্ষার বহু সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। তা সত্ত্বেও, এর কিছু দিক নিয়ে সমালোচকরা প্রশ্ন তুলেছেন:

  • বাস্তবায়নের অসুবিধা: শান্তিনিকেতনের মতো প্রকৃতির সান্নিধ্যে, ছাত্র-শিক্ষকের নিবিড় সম্পর্কযুক্ত, ব্যয়বহুল আশ্রমিক শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র বা বৃহত্তর জনসমাজের জন্য বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন ও প্রায় অসম্ভব।
  • ব্যাবহারিক বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভাব: সমালোচকদের মতে, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনায় কলা, সাহিত্য, সঙ্গীত ও সৃজনশীলতার উপর যতটা জোর দেওয়া হয়েছে, আধুনিক যুগের উপযোগী ব্যাবহারিক বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে এখান থেকে উত্তীর্ণ ছাত্রদের অনেকেরই গতানুগতিক কর্মসংস্থানে অসুবিধা হতে পারে। (যদিও শ্রীনিকেতন এই অভাব পূরণের একটি চেষ্টা ছিল)।
  • শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ধারণা: শিক্ষার্থীদের উপর শৃঙ্খলা চাপিয়ে না দিয়ে তাদের স্বাধীনতার মাধ্যমে আত্মশৃঙ্খলা অর্জনের যে ধারণা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন, তা বর্তমান যুগে বা বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা কঠিন হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
  • অভিজাত বা উচ্চবিত্ত নির্ভরতা: শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, তা মূলত উচ্চবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণির দান বা সরকারি অনুদানের উপর নির্ভরশীল, যা একে কিছুটা elitist প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে।
  • অতিমাত্রায় আদর্শবাদ: কেউ কেউ মনে করেন, তাঁর শিক্ষাভাবনা কিছুটা অতিমাত্রায় আদর্শবাদী, যা কঠোর বাস্তব পৃথিবীর প্রতিযোগিতার সঙ্গে সবসময় সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে।

উপসংহার: এই সমালোচনাগুলি সত্ত্বেও স্বীকার করতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা প্রচলিত শিক্ষার বহু ত্রুটি নির্দেশ করেছে এবং এক বিকল্প, জীবনমুখী, আনন্দময় ও পরিপূর্ণ শিক্ষার পথ দেখিয়েছে, যার প্রাসঙ্গিকতা আজও অনস্বীকার্য।


১. প্রশ্ন: বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ ও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের ভূমিকা ব্যাখ্যা করো।

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ ও বিশ শতকে বাংলায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ও গবেষণার ক্ষেত্রে কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ এবং বসু বিজ্ঞান মন্দির দুটি স্তম্ভস্বরূপ প্রতিষ্ঠান। দেশীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানগুলি ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ (University College of Science and Technology, ১৯১৪):

  • প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও উদ্যোগ: স্বদেশি আন্দোলনের আবহে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং দেশে উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই কলেজ স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নেন। স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের বিপুল অর্থদান ও জমি দান এর প্রতিষ্ঠাকে সম্ভব করে তোলে।
  • লক্ষ্য: এর মূল লক্ষ্য ছিল স্নাতকোত্তর স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষা ও মৌলিক গবেষণার একটি বিশ্বমানের কেন্দ্র স্থাপন করা এবং দেশকে বিজ্ঞানে আত্মনির্ভর করে তোলা।
  • শিক্ষক ও গবেষণা: প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শিশির কুমার মিত্রের মতো বিশ্বমানের বিজ্ঞানীরা এখানে অধ্যাপক ও গবেষক হিসেবে যোগ দেন। তাঁদের অবদানে এখানে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত মানের পঠনপাঠন ও যুগান্তকারী গবেষণা শুরু হয়। মেঘনাদ সাহার তাপীয় আয়নায়ন তত্ত্ব বা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান সংক্রান্ত কাজের সূচনা এখানেই হয়।
  • কৃতি ছাত্র: এই কলেজ থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী তৈরি হন যারা পরবর্তীকালে ভারতের বিজ্ঞান গবেষণায় নেতৃত্ব দেন।
  • জাতীয় জীবনে প্রভাব: এখানকার শিক্ষকরা শুধুমাত্র গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। প্রফুল্লচন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা করেন, মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু পরবর্তীকালে দেশের পরিকল্পনা কমিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বসু বিজ্ঞান মন্দির (Bose Institute, ১৯১৭):

  • প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ও উদ্যোগ: আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতে বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামোর অভাব অনুভব করে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এবং কিছু ব্যক্তিগত দানের সাহায্যে এই গবেষণা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এটিকে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।
  • লক্ষ্য: কোনো রকম সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ ছাড়াই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় (পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি, বায়োফিজিক্স ইত্যাদি) মৌলিক ও আন্তঃশাস্ত্রীয় (interdisciplinary) গবেষণা চালানোই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
  • জগদীশচন্দ্রের গবেষণা: জগদীশচন্দ্র বসু নিজেই এখানে তাঁর বিখ্যাত গবেষণাগুলি করেন। বিশেষত, তাঁর আবিষ্কৃত ‘ক্রেসকোগ্রাফ’ যন্ত্রের সাহায্যে উদ্ভিদের প্রাণ ও সংবেদনশীলতা প্রমাণ এবং বেতার তরঙ্গ (রেডিও ওয়েভ) বিষয়ে তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
  • পরবর্তী গবেষণা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি: এই প্রতিষ্ঠানে পরবর্তীকালে বহু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে, যেমন – শম্ভুনাথ দে-র কলেরা টক্সিন আবিষ্কার। বসু বিজ্ঞান মন্দির খুব দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

উপসংহার: কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ এবং বসু বিজ্ঞান মন্দির – এই দুটি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এগুলি প্রমাণ করেছিল যে, ভারতীয়রাও বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণায় বিশ্বের সঙ্গে সমান তালে চলতে সক্ষম এবং এগুলি আজও দেশের অগ্রগণ্য বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যমান।

২. প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা ও শান্তিনিকেতন ভাবনার পরিচয় দাও।

উত্তর: ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) শুধুমাত্র একজন বিশ্বকবি বা সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মৌলিক শিক্ষাচিন্তাবিদ ও সংগঠক। প্রচলিত ঔপনিবেশিক শিক্ষার যান্ত্রিকতা, সংকীর্ণতা ও জীবনবিচ্ছিন্নতার তীব্র সমালোচক হিসেবে তিনি এক বিকল্প, জীবনমুখী, প্রকৃতি-কেন্দ্রিক ও মানবতাবাদী শিক্ষাভাবনার জন্ম দেন, যার মূর্ত রূপ হল শান্তিনিকেতন।

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার মূল সূত্র:

  • প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয়: তিনি মনে করতেন, শিক্ষা চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে প্রকৃতির মুক্ত অঙ্গনে হওয়া উচিত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিশুর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ঘটে। খোলা আকাশ, গাছপালা, ঋতু পরিবর্তন – এ সবই শিক্ষার অঙ্গ।
  • আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষা: তাঁর কাছে শিক্ষা ছিল এক আনন্দময় প্রক্রিয়া। জোর করে বা ভয়ের মাধ্যমে শেখানো নয়, বরং সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, কলাচর্চা, বিভিন্ন উৎসব (পৌষ উৎসব, বসন্ত উৎসব) ইত্যাদির মাধ্যমে আনন্দের সঙ্গে জ্ঞানার্জনই ছিল তাঁর লক্ষ্য।
  • সৃজনশীলতা ও libertàর বিকাশ: তিনি মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তা, কল্পনা ও সৃজনশীলতার বিকাশের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। শিক্ষার পরিবেশে থাকবে পূর্ণ স্বাধীনতা, যেখানে শিশুরা প্রশ্ন করতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভয় পাবে না।
  • সমগ্র মানুষের শিক্ষা: শিক্ষা শুধুমাত্র তথ্য বা জ্ঞানের ভাণ্ডার বৃদ্ধি নয়, তা শিক্ষার্থীর শারীরিক (খেলাধুলা, ব্যায়াম), মানসিক (সাহিত্য, কলা, সঙ্গীত), নৈতিক (চরিত্র গঠন), আধ্যাত্মিক (প্রকৃতি ও সত্তার উপলব্ধি) ও সামাজিক (সেবা, সহযোগিতা) – এই পূর্ণাঙ্গ সত্তার বিকাশ ঘটাবে। তাঁর লক্ষ্য ছিল ‘পরিপূর্ণ মানুষ’ তৈরি করা।
  • জীবনের সঙ্গে শিক্ষার যোগ: শিক্ষা যাতে বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়, সেজন্য তিনি ব্যবহারিক শিক্ষার উপর জোর দেন। শান্তিনিকেতনের কাছে শ্রীনিকেতন (১৯২২) প্রতিষ্ঠা করে তিনি পল্লি উন্নয়ন, কৃষি, সমবায় ও বিভিন্ন কুটিরশিল্পের শিক্ষা ও গবেষণার ব্যবস্থা করেন, যাতে শিক্ষা গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সাহায্য করতে পারে।
  • বিশ্ববোধ ও আন্তর্জাতিকতা: শিক্ষা মানুষকে সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা বা জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে তুলে বিশ্বনাগরিকে পরিণত করবে। বিশ্বভারতী (১৯২১) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ভাবধারার মিলনক্ষেত্র তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যার মূলমন্ত্র ছিল ‘যত্র বিশ্বম্ ভবত্যেকনীড়ম্’ (যেখানে সমগ্র বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হয়)।

শান্তিনিকেতন ভাবনার রূপায়ণ:

  • ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা (১৯০১): পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে এই বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
  • আশ্রমিক জীবন ও পরিবেশ: এখানে শিক্ষক ও ছাত্ররা প্রকৃতির কোলে একসঙ্গে সরল জীবনযাপন করতেন, যা উভয়ের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলত। ক্লাস হতো গাছের তলায় বা খোলা আকাশের নিচে।
  • কলা ও সঙ্গীতের প্রাধান্য: কলাভবন (১৯১৯) ও সঙ্গীতভবন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শিল্পকলা ও সঙ্গীতকে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তোলেন, যা শিক্ষার্থীর নান্দনিক চেতনার বিকাশ ঘটায়।
  • উৎসব ও অনুষ্ঠান: বিভিন্ন ঋতু উৎসব, নাটক অভিনয়, সাহিত্য সভা ইত্যাদি আশ্রমিক জীবন ও শিক্ষাকে আনন্দময় ও প্রাণবন্ত করে তোলে।
  • বিশ্বভারতী ও শ্রীনিকেতন: ব্রহ্মচর্যাশ্রমই পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং তার পরিপূরক হিসেবে শ্রীনিকেতন পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্রে পরিণত হয়ে রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক শিক্ষাভাবনাকে মূর্ত করে তোলে।

উপসংহার: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষাচিন্তা ও শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর উদ্যোগ ছিল প্রচলিত শিক্ষার এক বলিষ্ঠ ও সৃষ্টিশীল বিকল্প। প্রকৃতি, মানুষ, শিল্পকলা ও বিশ্বমানবতার সমন্বয়ে এক অখণ্ড ও জীবনমুখী শিক্ষা প্রদানই ছিল এর মূল লক্ষ্য, যা আজও শিক্ষাজগতে প্রাসঙ্গিক ও প্রেরণাদায়ক।

error: Content is protected !!
Scroll to Top