Madhyamik History Chapter 2 Question Answer: দ্বিতীয় অধ্যায়: সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা | Free Exam Guide

Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

Madhyamik History Chapter 2 Question Answer! মাধ্যমিক ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায় – ‘সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা’ – পরীক্ষার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, আর এর প্রশ্ন উত্তরগুলি ভালোভাবে তৈরি করা তোমাদের সাফল্যের জন্য Absolutely Crucial! 💯

এই পৃষ্ঠায় তুমি পাবে দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম দুটি টপিকের (Topic 1 & 2) ওপর একটি Comprehensive প্রশ্নোত্তর: ১. উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন 📰 ২. উনিশ শতকের বাংলা শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা 🎓

এখানে থাকা সংক্ষিপ্ত (SAQ), বিশ্লেষণধর্মী এবং ব্যাখ্যামূলক সব ধরনের প্রশ্ন ও উত্তরগুলি পরীক্ষার latest trend অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে, যাতে তুমি প্রতিটি বিষয় Crystal Clear ভাবে বুঝতে পারো এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারো। 💪

অধ্যায়ের বাকি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক: ৩. উনিশ শতকের বাংলা সমাজ সংস্কার ৪. উনিশ শতকের বাংলা ধর্মসংস্কার ৫. বাংলার নবজাগরণের চরিত্র ও বিতর্ক – এই বিষয়গুলির বিস্তারিত প্রশ্নোত্তরের লিঙ্কও তুমি এই পৃষ্ঠা থেকেই পেয়ে যাবে, যাতে তোমার সম্পূর্ণ প্রস্তুতিতে কোনো খামতি না থাকে।

Table Of Contents
  1. 📰 উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন
  2. 🎓 উনিশ শতকের বাংলা শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা 📚
  3. সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের খুঁটিনাটি জানো? প্রশ্নোত্তর পর্ব
  4. Bengal Renaissance: বিতর্ক ও বিশ্লেষণ – সম্পূর্ণ প্রশ্নোত্তর!
  5. দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি যাচাই! মক টেস্ট দাও এখনই!

📰 উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র ও সাহিত্যে সমাজের প্রতিফলন

Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

এই বিভাগে তুমি জানবে কীভাবে উনিশ শতকের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যকর্ম তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবস্থার দর্পণ হয়ে উঠেছিল।


📜 ক) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (SAQ – প্রতিটি ২ নম্বর) Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

প্রশ্ন ১: ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল? 👩‍🎓

উত্তর: ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নারী সমাজের সামগ্রিক উন্নতি, বিশেষ করে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো, তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা । নারীদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার প্রতিকারের উপায় নিয়ে আলোচনা করাও এই পত্রিকার অন্যতম লক্ষ্য ছিল।

প্রশ্ন ২: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা নীল চাষিদের সমর্থনে কী ভূমিকা পালন করেছিল? 💙

উত্তর: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা, বিশেষত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, নীল চাষিদের ওপর নীলকর সাহেবদের অকথ্য অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল । এই পত্রিকা নিয়মিতভাবে নীল চাষিদের দুর্দশার কথা প্রকাশ করত, এমনকি ‘নীল জেলা’ (Indigo District) নামে একটি নতুন বিভাগও চালু করেছিল । এর ফলে জনমত তৈরি হয় এবং সরকার নীল কমিশন গঠনে বাধ্য হয়েছিল ।

প্রশ্ন ৩: ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্তু কী ছিল? 🦉

উত্তর: কালীপ্রসন্ন সিংহের (ছদ্মনাম: হুতোম প্যাঁচা) লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ গ্রন্থটির মূল বিষয়বস্তু ছিল উনিশ শতকের কলকাতার নব্য ধনী ও মধ্যবিত্ত ‘বাবু’ সমাজের উচ্ছৃঙ্খলতা, ভণ্ডামি, কপটতা ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের ব্যঙ্গাত্মক চিত্র তুলে ধরা । এই গ্রন্থে কথ্য ভাষায় বিভিন্ন নকশার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ।

প্রশ্ন ৪: ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল? 🎭

উত্তর: দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি (১৮৬০) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা নীলকরদের দ্বারা নীল চাষিদের ওপর নির্মম অত্যাচার ও শোষণের বাস্তব চিত্র সাহসিকতার সঙ্গে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিল । এই নাটকটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং নীল বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত সমাজের সহানুভূতি আকর্ষণ করতে সাহায্য করেছিল । এর ইংরেজি অনুবাদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টেও প্রভাব ফেলেছিল ।

প্রশ্ন ৫: ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক কে ছিলেন এবং এটির বিশেষত্ব কী ছিল? 🌾

উত্তর: ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র (১৮৬৩) সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার, যিনি ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামে বেশি পরিচিত ছিলেন । এই পত্রিকাটির প্রধান বিশেষত্ব হলো, এটিই ছিল বাংলার প্রথম গ্রামীণ সংবাদপত্র, যা মূলত গ্রামের সাধারণ মানুষ, কৃষক, কারিগরদের দুঃখ-দুর্দশা, জমিদার-মহাজন-নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের কথা নির্ভীকভাবে প্রকাশ করত ।


✒️ খ) বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical – প্রতিটি ৪ নম্বর) Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

প্রশ্ন ১: উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল? 📰✨

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের সাথে সাথে সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের জগতে এক নতুন জোয়ার আসে। এই সময়ের পত্রপত্রিকাগুলি শুধুমাত্র সংবাদ পরিবেশন নয়, সমাজ সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি:

  • সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি: এই পত্রপত্রিকাগুলি তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন কুপ্রথা, যেমন – সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সাহায্য করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ নারী সমাজের সমস্যা ও নারীশিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নেয়।
  • ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা: কিছু সংবাদপত্র নির্ভীকভাবে ব্রিটিশ সরকারের শোষণমূলক নীতি, প্রশাসনিক ত্রুটি এবং অত্যাচারের সমালোচনা করত। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং সাঁওতাল বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিল।
  • জাতীয়তাবাদের প্রসার: এই সময়ের পত্রপত্রিকাগুলি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। এগুলি ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটায়।
  • সাহিত্যের বিকাশ: বিভিন্ন সাময়িকপত্র নবীন লেখকদের সাহিত্যচর্চার সুযোগ করে দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে সাহায্য করেছিল। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় লালন ফকিরের গান প্রথম প্রকাশিত হয়।
  • গ্রামীণ জীবনের প্রতিফলন: ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র মতো পত্রিকাগুলি বিশেষভাবে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা, সমস্যা ও শোষণের চিত্র তুলে ধরেছিল, যা তৎকালীন অন্যান্য পত্রিকায় কম দেখা যেত।

উপসংহার: উনিশ শতকের বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রগুলি শুধুমাত্র তথ্যের আধার ছিল না, বরং সেগুলি ছিল সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার এবং বাঙালির আত্মসচেতনতা ও নবজাগরণের অন্যতম চালিকাশক্তি।

প্রশ্ন ২: ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ কীভাবে নারী সমাজের উন্নতিতে অবদান রেখেছিল? 👩‍🏫💪

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় নারী সমাজের অগ্রগতিতে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই মাসিক পত্রিকাটি প্রায় ৬০ বছর ধরে নারীমুক্তি ও নারী প্রগতির দিশারী ছিল।

অবদান:

  • নারীশিক্ষার প্রসার: পত্রিকার প্রধান লক্ষ্য ছিল নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা এবং শিক্ষার প্রসারে উৎসাহ দেওয়া। এতে নিয়মিতভাবে নারীদের কী ধরনের শিক্ষা দেওয়া উচিত, নারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হতো।
  • সামাজিক কুপ্রথার বিরোধিতা: তৎকালীন সমাজে প্রচলিত নারীদের শিক্ষার অভাব, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা এবং বিধবাদের দুরবস্থা নিয়ে পত্রিকাটি সরব ছিল।
  • নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: ‘বামাবোধিনী’ নারীদের সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সওয়াল করত। পারিবারিক জীবনে নারীর ভূমিকা, আদর্শ মায়ের গুণাবলি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাজে নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টা করা হতো।
  • নারীদের সাহিত্যচর্চায় উৎসাহদান: এই পত্রিকায় বহু নারী স্বনামে বা বেনামে তাঁদের লেখা প্রকাশ করার সুযোগ পেতেন, যা নারী লেখিকা তৈরিতে সাহায্য করেছিল।

উপসংহার: ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ শুধুমাত্র একটি পত্রিকা ছিল না, এটি ছিল উনিশ শতকের নারী জাগরণের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, যা নারী সমাজের অন্ধকার দূর করে তাদের আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথ দেখিয়েছিল।

প্রশ্ন ৩: কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ কীভাবে তৎকালীন কলকাতার সমাজকে ব্যঙ্গ করেছিল? 🎭😂

উত্তর: ভূমিকা: কালীপ্রসন্ন সিংহের (ছদ্মনাম: হুতোম প্যাঁচা) ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (প্রথম ভাগ ১৮৬২, সম্পূর্ণ ১৮৬৪) উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য ব্যঙ্গরচনা, যা তৎকালীন কলকাতার বাবু সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভণ্ডামি ও অবক্ষয়কে রসিকতার সাথে তুলে ধরেছিল।

ব্যঙ্গের দিকগুলি:

  • বাবু সংস্কৃতির সমালোচনা: এই গ্রন্থে কলকাতার নব্য ধনী ‘বাবু’ শ্রেণির বিলাসবহুল, অর্থহীন ও নীতিভ্রষ্ট জীবনযাত্রাকে (যেমন – বুলবুলির লড়াই, খেমটা নাচ, মদ্যপান) তীব্রভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে।
  • সামাজিক ভণ্ডামির উন্মোচন: সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের (যেমন – কেরানি, পুরোহিত, হঠাৎ অবতার, জমিদার) আচার-আচরণ, কপটতা, দ্বিচারিতা ও শঠতাকে কালীপ্রসন্ন সিংহ ব্যঙ্গের কশাঘাতে জর্জরিত করেছেন।
  • ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিকৃতি: চড়ক, গাজন, রথের মতো জনপ্রিয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলিতে যে সমস্ত অসংগতি ও বাড়াবাড়ি ঢুকে পড়েছিল, সেগুলিকেও হাস্যরসের মাধ্যমে সমালোচনা করা হয়েছে।
  • ভাষার ব্যবহার: এই গ্রন্থের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর ভাষা। কলকাতার তৎকালীন কথ্য বা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও ‘হুতোমি’ বাংলা (চলিত ভাষা) ব্যবহার করে তিনি ব্যঙ্গকে আরও তীক্ষ্ণ ও জীবন্ত করে তুলেছিলেন।

উপসংহার: ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ শুধুমাত্র একটি হাস্যরসাত্মক গ্রন্থ নয়, এটি উনিশ শতকের কলকাতার বাবু সংস্কৃতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের এক নির্ভেজাল দলিল। কালীপ্রসন্ন সিংহ নিজে জমিদার সন্তান হয়েও সমাজের এই কদর্য দিকগুলো সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছিলেন।

প্রশ্ন ৪: দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করো। 🌐✊

উত্তর: ভূমিকা: দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক (১৮৬০) শুধুমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম ছিল না, এটি ছিল উনিশ শতকের বাংলার নীল চাষিদের ওপর ব্রিটিশ নীলকরদের অমানবিক শোষণ ও অত্যাচারের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি এবং নীল বিদ্রোহের এক শক্তিশালী অনুঘটক।

সামাজিক গুরুত্ব:

  • অত্যাচারের বাস্তব চিত্র: নাটকটি গোলক বসুর পরিবারের মাধ্যমে নীল চাষিদের অসহায়তা, নীলকর সাহেব উডের নির্মমতা, নারী নির্যাতন এবং চাষিদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছিল।
  • জনমত গঠন: এই নাটক শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে নীল চাষিদের দুরবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন করে তোলে এবং তাদের মধ্যে সহানুভূতির সঞ্চার করে।
  • নারীর দুর্দশা: নাটকটিতে ক্ষেত্রমণি, সাবিত্রী, সরলা প্রমুখ নারী চরিত্রের মাধ্যমে নীলকরদের অত্যাচারে নারীদের অসহায়ত্ব ও সামাজিক সংকট ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। রাজনৈতিক গুরুত্ব:
  • ব্রিটিশ শাসনের স্বরূপ উন্মোচন: নাটকটি ব্রিটিশ নীলকরদের শোষণ ও স্থানীয় প্রশাসনের তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের দিকটি উন্মোচন করে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিল।
  • নীল বিদ্রোহে প্রেরণা: এই নাটক নীল বিদ্রোহের আগুনকে আরও প্রজ্বলিত করতে সাহায্য করেছিল এবং বিদ্রোহীদের মনোবল জুগিয়েছিল।
  • আন্তর্জাতিক প্রভাব: মাইকেল মধুসূদন দত্তের করা ইংরেজি অনুবাদ (প্রকাশক: রেভারেন্ড জেমস লঙ) ইংল্যান্ডে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নীল চাষিদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এর ফলে নীলকরদের অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা হলেও কমে।

উপসংহার: ‘নীলদর্পণ’ নাটক তার শিল্পগুণ এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাবের জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একে হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র ‘আঙ্কল টমস্‌ কেবিন’-এর সাথে তুলনা করেছেন।


📚 গ) ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory – প্রতিটি ৮ নম্বর) Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

প্রশ্ন ১: উনিশ শতকের বাংলায় প্রকাশিত সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র এবং সাহিত্য কীভাবে সমকালীন সমাজের প্রতিফলন ঘটিয়েছিল, তা বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে বিস্তারিত আলোচনা করো। 📖🖋️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। এই সময়ে প্রকাশিত সাময়িকপত্র, সংবাদপত্র এবং সাহিত্যকর্মগুলি শুধুমাত্র সৃজনশীলতার পরিচয় বহন করে না, বরং সেগুলি তৎকালীন সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সমস্যা-সংকট, এবং পরিবর্তনগুলিকে বিশ্বস্তভাবে প্রতিফলিত করেছিল।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের প্রতিফলন:

  1. ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ (১৮৬৩) ও নারী সমাজ: 👩‍🎓 উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত এই পত্রিকাটি নারী সমাজের প্রতি বিশেষভাবে আলোকপাত করেছিল। তৎকালীন সমাজে নারীদের শিক্ষার অভাব, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, বিধবাদের দুরবস্থা, পণপ্রথা ইত্যাদি বিষয়গুলি এই পত্রিকায় নিয়মিত আলোচিত হতো। নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি, আদর্শ নারীর গুণাবলী, পারিবারিক জীবনে নারীর ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে পত্রিকাটি নারী জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষাণীয়াতি যত্নতঃ” (কন্যাকেও পুত্রের মতো যত্ন করে পালন ও শিক্ষা দেবে) – এই মন্ত্র ছিল পত্রিকার আদর্শ।
  2. ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ (১৮৫৩) ও সমকালীন সমস্যা: 🇮🇳 গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং পরবর্তীকালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এই ইংরেজি পত্রিকাটি সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্ভীক মতামত প্রকাশ করত।
    • কৃষক ও আদিবাসী বিদ্রোহের প্রতি সমর্থন: পত্রিকাটি সাঁওতাল বিদ্রোহে (১৮৫৫-৫৬) বিদ্রোহীদের সমর্থন জানিয়েছিল এবং সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, নীল বিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) সময় এটি নীল চাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবেদন প্রকাশ করে জনমত গঠন করে এবং সরকারকে নীল কমিশন গঠনে বাধ্য করে।
    • সমাজ সংস্কারে ভূমিকা: বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সমর্থনে এবং নারীশিক্ষার প্রসারেও এই পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
  3. ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২-৬৪) ও কলকাতার বাবু সংস্কৃতি: 🦉 কালীপ্রসন্ন সিংহের এই ব্যঙ্গাত্মক রচনাটি উনিশ শতকের কলকাতার নব্য ধনী ‘বাবু’ সমাজের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা, ভণ্ডামি, অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তা এবং নৈতিক অবক্ষয়কে তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছিল। চড়ক, বারোয়ারি পূজা, ইংরেজদের তোষামোদ ইত্যাদি বিষয়গুলি হাস্যরসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে তিনি সমাজের কদর্য দিকগুলো উন্মোচন করেন। এটি তৎকালীন কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল।
  4. ‘নীলদর্পণ’ নাটক (১৮৬০) ও কৃষক শোষণ: 🎭 দীনবন্ধু মিত্রের এই কালজয়ী নাটকটি নীলকর সাহেবদের দ্বারা বাংলার নিরীহ নীল চাষিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছিল। তোরাপ, গোলক বসু, ক্ষেত্রমণি, সাবিত্রীর মতো চরিত্রের মাধ্যমে চাষিদের অসহায়ত্ব ও ক্ষোভ ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। এই নাটক নীল বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত সমাজের সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করতে এবং ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়াতে বিশেষ সাহায্য করেছিল।
  5. ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ (১৮৬৩) ও গ্রামীণ বাংলা: 🌾 হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) সম্পাদিত এই পত্রিকাটি প্রথম বাংলা গ্রামীণ সংবাদপত্র হিসেবে পরিচিত। এটি গ্রামীণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, জমিদার-মহাজন-নীলকরদের শোষণ-অত্যাচার এবং সরকারি উদাসীনতার কথা নির্ভীকভাবে প্রকাশ করত। পুলিশি জুলুম, শিক্ষার অভাব, গ্রামীণ অর্থনীতির সমস্যা ইত্যাদি বিষয়গুলিও এই পত্রিকায় স্থান পেত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, উনিশ শতকের এই সকল পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যকর্মগুলি ছিল সমকালীন বাংলার সমাজের এক বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবি। এগুলি একদিকে যেমন সামাজিক অন্যায় ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল, তেমনই অন্যদিকে জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ ও দেশপ্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে বাঙালির মনন গঠনে ও নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করতে সাহায্য করেছিল।

🎓 উনিশ শতকের বাংলা শিক্ষা সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা 📚


📜 ক) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (SAQ – প্রতিটি ২ নম্বর) Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

প্রাথমিক উদ্যোগ ও বিতর্ক

১. প্রশ্ন: কোম্পানির শাসনে ভারতে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রথম সরকারি আর্থিক পদক্ষেপ কোনটি ছিল? এর পরিমাণ কত ছিল? 💰

উত্তর: কোম্পানির শাসনে ভারতে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রথম সরকারি আর্থিক পদক্ষেপ ছিল ১৮১৩ সালের সনদ আইন (Charter Act) । এই আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বছরে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ।

২. প্রশ্ন: ভারতে জনশিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কোন কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং কবে? 🏛️

উত্তর: ভারতে জনশিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ‘সাধারণ জনশিক্ষা কমিটি’ (General Committee of Public Instruction বা GCPI) গঠিত হয়েছিল ।

৩. প্রশ্ন: প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক বিতর্ক বলতে কী বোঝো? 🌏🆚

উত্তর: ভারতে সরকারি উদ্যোগে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সময়, শিক্ষার মাধ্যম ও বিষয়বস্তু কী হবে—প্রাচ্যদেশীয় (সংস্কৃত, আরবি, ফারসি) নাকি পাশ্চাত্য (ইংরেজি, আধুনিক বিজ্ঞান)—এই নিয়ে যে মতপার্থক্য ও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তাকেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক বিতর্ক বলে।

৪. প্রশ্ন: দুজন প্রাচ্যবাদী শিক্ষাবিদের নাম লেখো। 🇮🇳

উত্তর: প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক বিতর্কে দুজন উল্লেখযোগ্য প্রাচ্যবাদী শিক্ষাবিদ ছিলেন এইচ. টি. প্রিন্সেপ এবং এইচ. এইচ. উইলসন

৫. প্রশ্ন: দুজন পাশ্চাত্যবাদী শিক্ষাবিদের নাম লেখো।

উত্তর: প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক বিতর্কে দুজন উল্লেখযোগ্য পাশ্চাত্যবাদী শিক্ষাবিদ ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে এবং আলেকজান্ডার ডাফ

৬. প্রশ্ন: লর্ড আমহার্স্টকে লেখা রাজা রামমোহন রায়ের চিঠির (১৮২৩) মূল বিষয়বস্তু কী ছিল? ✉️

উত্তর: ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে রাজা রামমোহন রায় ভারতে সরকারি অর্থে সংস্কৃত বা আরবি-ফারসির মতো প্রাচ্য শিক্ষার পরিবর্তে আধুনিক বিজ্ঞান, গণিত, দর্শনসহ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য জোরালো সওয়াল করেছিলেন ।

৭. প্রশ্ন: টমাস ব্যাবিংটন মেকলে কে ছিলেন? তিনি কোন বিখ্যাত প্রস্তাবের জন্য পরিচিত? 📜

উত্তর: টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব এবং সাধারণ জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি । তিনি ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ জানিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেন, তা ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত ।

৮. প্রশ্ন: ‘মেকলে মিনিট’ কবে প্রকাশিত হয়? এর একটি প্রধান সুপারিশ কী ছিল? 🗓️

উত্তর: ‘মেকলে মিনিট’ ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় । এর প্রধান সুপারিশ ছিল ভারতে সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটানো ।

৯. প্রশ্ন: মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ বা ‘ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) কী ছিল? 👇💧

উত্তর: মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ অনুযায়ী, ভারতে প্রথমে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে । তাঁর মতে, এই শিক্ষিত শ্রেণির মাধ্যমে ধীরে ধীরে সেই শিক্ষা সমাজের নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে ।

১০. প্রশ্ন: কোন বড়লাট এবং কবে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সরকারি নীতি ঘোষণা করেন? 📣

উত্তর: বড়লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ টমাস ব্যাবিংটন মেকলের সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সরকারি নীতি ঘোষণা করেন ।

১১. প্রশ্ন: ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে চার্লস গ্রান্টের ‘অবজারভেশন’ (Observations) পুস্তিকাটির বক্তব্য কী ছিল? 🧐

উত্তর: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী চার্লস গ্রান্ট ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে রচিত তাঁর ‘অবজারভেশন’ পুস্তিকায় মত প্রকাশ করেন যে, ভারতের পশ্চাৎপদ সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতার উন্নয়নের জন্য এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানো দরকার

১৩. প্রশ্ন: মেকলের মতে, কাদের মধ্যে প্রথমে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো উচিত ছিল? 🎓

উত্তর: মেকলের মতে, প্রথমে ভারতীয় সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো উচিত ছিল ।

১৪. প্রশ্ন: লর্ড বেন্টিঙ্কের আইন সচিব হিসেবে কে ভারতে আসেন? 👨‍⚖️

উত্তর: লর্ড টমাস ব্যাবিংটন মেকলে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব হিসেবে ভারতে আসেন ।

১৫. প্রশ্ন: “একটি ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক ভারত ও আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ” – এই উক্তিটি কার? 💬

উত্তর: এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, তাঁর ‘মিনিট’-এ প্রাচ্য সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে ।

মিশনারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ

১৬. প্রশ্ন: ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে কারা পরিচিত ছিলেন? তাঁরা কোন মিশন প্রতিষ্ঠা করেন? ✝️

উত্তর: উইলিয়াম কেরি, উইলিয়াম ওয়ার্ড এবং জোশুয়া মার্শম্যান একত্রে ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে পরিচিত ছিলেন । তাঁরা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

১৭. প্রশ্ন: শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন শিক্ষাবিস্তারে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল? (দুটি উল্লেখ করো) ⛪📚

উত্তর: শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন শিক্ষাবিস্তারে যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার মধ্যে দুটি হলো: ১) নিজেদের অধীনে প্রায় ১২৬টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং ২) ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করা ।

১৮. প্রশ্ন: শ্রীরামপুর কলেজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়? 🗓️

উত্তর: শ্রীরামপুর কলেজ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

১৯. প্রশ্ন: আলেকজান্ডার ডাফ কে ছিলেন? তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম লেখো। 🏴󠁧󠁢󠁳󠁣󠁴󠁿

উত্তর: আলেকজান্ডার ডাফ ছিলেন একজন স্কটিশ ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষাবিদ । তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (১৮৩০) ।

২০. প্রশ্ন: জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন বর্তমানে কী নামে পরিচিত? 🏢

উত্তর: জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত ।

২১. প্রশ্ন: কলকাতায় হিন্দু কলেজ কবে এবং কাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? 🏛️

উত্তর: কলকাতায় হিন্দু কলেজ ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি ডেভিড হেয়ার, রাজা রামমোহন রায় (পরোক্ষভাবে), রাজা রাধাকান্ত দেব, সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হাইড ইস্ট, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সম্মিলিত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

২২. প্রশ্ন: হিন্দু কলেজের (১৮১৭) বর্তমান নাম কী? 🔄

উত্তর: হিন্দু কলেজ প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ (১৮৫৫) এবং পরবর্তীকালে (২০১০ সালে) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়েছে ।

২৩. প্রশ্ন: ডেভিড হেয়ারের শিক্ষাবিস্তারের দুটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ উল্লেখ করো। 🕰️📖

উত্তর: ডেভিড হেয়ারের শিক্ষাবিস্তারের দুটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো: ১) কলকাতায় হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা এবং ২) পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি (বর্তমান হেয়ার স্কুল) ও ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭) প্রতিষ্ঠা করা ।

২৪. প্রশ্ন: ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ (১৮১৭) কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? 📚

উত্তর: ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভে পাঠ্যপুস্তক ছাপানো ও বিতরণের উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

২৫. প্রশ্ন: ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ (১৮১৮) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল? 🏫

উত্তর: কলকাতায় ও তার আশেপাশে নতুন নতুন বিদ্যালয় স্থাপন এবং ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলির মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

২৬. প্রশ্ন: রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম লেখো। 🎓

উত্তর: রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল (১৮২২ বা ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং বেদান্ত কলেজ (১৮২৫ বা ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ) ।

২৭. প্রশ্ন: বেদান্ত কলেজ (১৮২৬) প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল? 💡

উত্তর: বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের মন থেকে কুসংস্কার ও মূর্তিপূজার ধারণা দূর করে প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক চিন্তাধারার সমন্বয় ঘটানো ।

২৮. প্রশ্ন: রাজা রাধাকান্ত দেব শিক্ষাবিস্তারে কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছিলেন? (দুটি লেখো) 👨‍🏫

উত্তর: রাজা রাধাকান্ত দেব শিক্ষাবিস্তারে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তার দুটি হলো: ১) হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির সদস্য হিসেবে দীর্ঘ ৩২ বছর যুক্ত থেকে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই অনুবাদে ছাত্রদের উৎসাহিত করা এবং ২) ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ও ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির ভারতীয় সম্পাদক হিসেবে অবদান রাখা ।

২৯. প্রশ্ন: ‘শব্দকল্পদ্রুম’ কী? এটি কার রচনা? 📖

উত্তর: ‘শব্দকল্পদ্রুম’ হলো আট খণ্ডের একটি বিখ্যাত সংস্কৃত অভিধান । এটি রচনা করেছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব

৩০. প্রশ্ন: গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার নারীশিক্ষা বিষয়ে যে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছিলেন, তার নাম কী? 📕

উত্তর: গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার নারীশিক্ষা বিষয়ে যে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছিলেন তার নাম ছিল ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ । (রাধাকান্ত দেবের সহযোগিতায় প্রকাশিত) ।

৩১. প্রশ্ন: পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমির বর্তমান নাম কী? এটি কে প্রতিষ্ঠা করেন? 🏫

উত্তর: পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমির বর্তমান নাম হেয়ার স্কুল । এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডেভিড হেয়ার (১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ) ।

৩২. প্রশ্ন: লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে শিক্ষাবিস্তারে কোথায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন? ⛪

উত্তর: লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে চুঁচুড়ায় ৩৬টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাবিস্তারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন ।

৩৩. প্রশ্ন: কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়? ✝️

উত্তর: কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে জেসুইট মিশনারিদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ।

৩৪. প্রশ্ন: বিশপ মিডলটন প্রতিষ্ঠিত কলেজটির নাম কী? ⛪

উত্তর: বিশপ মিডলটন শিবপুরে বিশপস্ কলেজ (১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন ।

৩৬. প্রশ্ন: ওরিয়েন্টাল সেমিনারি কে প্রতিষ্ঠা করেন? 🏢

উত্তর: ওরিয়েন্টাল সেমিনারি (১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন গৌরমোহন আঢ্য

৩৭. প্রশ্ন: ওয়ারেন হেস্টিংস কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন? 🏛️

উত্তর: ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা (১৭৮১ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন ।

৩৮. প্রশ্ন: এশিয়াটিক সোসাইটি কে প্রতিষ্ঠা করেন এবং কবে? 🌏

উত্তর: এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন স্যার উইলিয়াম জোন্স, ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ।

৩৯. প্রশ্ন: জোনাথান ডানকান কোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন? 🎓

উত্তর: জোনাথান ডানকান বারাণসী সংস্কৃত কলেজ (১৭৯২ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন ।

৪০. প্রশ্ন: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০) প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল? 🇬🇧

উত্তর: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০) প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ বেসামরিক কর্মচারীদের (সিভিলিয়ানদের) ভারতীয় ভাষা, আইন, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি সম্পর্কে অবহিত করা ।

সরকারি নীতি ও তার পরবর্তী বিকাশ

৪১. প্রশ্ন: লর্ড হার্ডিঞ্জ কবে এবং কেন ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন? 💼

উত্তর: বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে । এর প্রধান কারণ ছিল প্রশাসনের কাজের সুবিধার্থে ইংরেজি জানা কর্মচারী তৈরি করা এবং ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করা ।

৪২. প্রশ্ন: ‘উডের ডেসপ্যাচ’ বা ‘উডের নির্দেশনামা’ (১৮৫৪) কে প্রকাশ করেন? 📄

উত্তর: ‘উডের ডেসপ্যাচ’ বা ‘উডের নির্দেশনামা’ (১৮৫৪) প্রকাশ করেন বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড

৪৩. প্রশ্ন: উডের ডেসপ্যাচের দুটি প্রধান সুপারিশ উল্লেখ করো। 📝

উত্তর: উডের ডেসপ্যাচের দুটি প্রধান সুপারিশ হলো: ১) প্রতিটি প্রদেশে একটি পৃথক শিক্ষা দপ্তর গঠন করা এবং ২) কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ।

৪৪. প্রশ্ন: কোন প্রতিবেদনকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা ‘মহাসনদ’ বলা হয়? 🌟

উত্তর: উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪)-কে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা ‘মহাসনদ’ বলা হয় ।

৪৫. প্রশ্ন: উডের ডেসপ্যাচের ভিত্তিতে কোন্ তিনটি শহরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং কবে? 🏛️🗓️

উত্তর: উডের ডেসপ্যাচের ভিত্তিতে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ।

৪৬. প্রশ্ন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবে প্রতিষ্ঠিত হয়? এর প্রথম আচার্য কে ছিলেন? 🎓

উত্তর: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় । এর প্রথম আচার্য (Chancellor) ছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং

৪৭. প্রশ্ন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য (Vice-Chancellor) কে ছিলেন? 👨‍⚖️

উত্তর: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার জেমস উইলিয়াম কোলভিল

৪৮. প্রশ্ন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য কে ছিলেন? 🇮🇳

উত্তর: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য ছিলেন স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

৪৯. প্রশ্ন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বি.এ. পাস করা দুজন কৃতি ছাত্রের নাম লেখো। 🥇

উত্তর: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বি.এ. পাস করা (১৮৫৮) দুজন কৃতি ছাত্র ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়যদুনাথ বসু

৫০. প্রশ্ন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম স্নাতকের নাম কী? ☪️

উত্তর: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম স্নাতক ছিলেন দেলওয়ার হোসেন আহমেদ

৫১. প্রশ্ন: হান্টার কমিশন (১৮৮২) কার সময়ে এবং কেন গঠিত হয়েছিল? 🧐

উত্তর: গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপনের আমলে উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে হান্টার কমিশন (১৮৮২) গঠিত হয়েছিল । ভারতে উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশগুলি কতটা কার্যকর হয়েছে তা পর্যালোচনা করা এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অগ্রগতি মূল্যায়ন ও সুপারিশ করাই ছিল এই কমিশন গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ।

৫২. প্রশ্ন: হান্টার কমিশনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ লেখো। ✍️

উত্তর: হান্টার কমিশনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো: ১) প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের দায়িত্ব জেলা ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের হাতে দেওয়া এবং ২) স্কুল ও কলেজগুলিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে এনে সাধারণভাবে সরকারি অনুদান দেওয়া ।

৫৩. প্রশ্ন: উনিশ শতকে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার দুটি প্রধান ত্রুটি উল্লেখ করো। 😟

উত্তর: উনিশ শতকে ব্রিটিশদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার দুটি প্রধান ত্রুটি ছিল: ১) শিক্ষার মাধ্যম প্রধানত ইংরেজি হওয়ায় মাতৃভাষায় শিক্ষা অবহেলিত হয় এবং সাধারণ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে এবং ২) শিক্ষা মূলত শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এর সুবিধা পায়নি ।

৫৪. প্রশ্ন: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি কে পেয়েছিলেন? 🏆

উত্তর: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পেয়েছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

৫৫. প্রশ্ন: ‘র‍্যালে কমিশন’ (১৯০২) কার উদ্যোগে গঠিত হয়? এই কমিশনের দুজন ভারতীয় সদস্যের নাম লেখো। 📝

উত্তর: ‘র‍্যালে কমিশন’ (১৯০২) বড়লাট লর্ড কার্জনের উদ্যোগে স্যার টমাস র‍্যালের নেতৃত্বে গঠিত হয় । এই কমিশনের দুজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন সৈয়দ হুসেন বিলগ্রামীস্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়

৫৬. প্রশ্ন: ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন কবে পাস হয়? ⚖️

উত্তর: ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে পাস হয় ।

নারীশিক্ষা ও বিশেষ ব্যক্তিত্ব

৫৭. প্রশ্ন: নারীশিক্ষা প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান লেখো। 👩‍🎓

উত্তর: নারীশিক্ষা প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন জেলায় (যেমন – হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদিয়া) ১৮৫৭-৫৮ সালের মধ্যে প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা

৫৮. প্রশ্ন: ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল (বেথুন স্কুল) কে প্রতিষ্ঠা করেন? বিদ্যাসাগর কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? 🏫

উত্তর: ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল (বর্তমানে বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন সাহেব), ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বেথুন সাহেবকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক পদেও অধিষ্ঠিত ছিলেন ।

৫৯. প্রশ্ন: বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের স্মৃতিতে কোন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন? 👩‍👧‍👦

উত্তর: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর মা ভগবতী দেবীর স্মৃতিতে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।

৬০. প্রশ্ন: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন) কে ছিলেন? নারীশিক্ষায় তাঁর একটি অবদান উল্লেখ করো। 👨‍🏫

উত্তর: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন (বেথুন) ছিলেন গভর্নর জেনারেলের আইন সচিব এবং শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি । নারীশিক্ষায় তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ (বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করা

✒️ খ) বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (Analytical – প্রতিটি ৪ নম্বর) Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

প্রশ্ন ১: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক বিতর্ক কেন তৈরি হয়েছিল? এই বিতর্কে অংশগ্রহণকারী প্রধান পক্ষ কারা ছিলেন? 🌏🆚🇪🇺

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ সরকার শিক্ষাখাতে অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিলে, সেই অর্থ কোন শিক্ষাব্যবস্থার প্রসারে ব্যয় করা হবে—এই নিয়ে এক তীব্র বিতর্ক দেখা দেয়, যা ‘প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব’ নামে পরিচিত।

বিতর্ক তৈরির কারণ ও পক্ষসমূহ:

  • ১৮১৩ সালের সনদ আইন: এই আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু সেই টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষায় ব্যয় হবে, তা নির্দিষ্ট না থাকায় বিতর্কের সূচনা হয়।
  • সাধারণ জনশিক্ষা কমিটি (GCPI): ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি গঠিত হলে, এর সদস্যরা শিক্ষানীতি নিয়ে দুটি প্রধান শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন:
    • প্রাচ্যবাদী (Orientalists): এঁরা ভারতে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে প্রাচ্যদেশীয় ঐতিহ্যপূর্ণ সাহিত্য, দর্শন ও আইন চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন এইচ. টি. প্রিন্সেপ, এইচ. এইচ. উইলসন, কোলব্রুক প্রমুখ।
    • পাশ্চাত্যবাদী (Anglicists): এঁরা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা শিক্ষার সপক্ষে মত দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ।
  • রামমোহন রায়ের ভূমিকা: ভারতীয়দের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবল সমর্থক ছিলেন এবং এই মর্মে লর্ড আমহার্স্টকে চিঠিও লিখেছিলেন।

উপসংহার: এই বিতর্ক শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যবাদীদের অনুকূলে যায়, যখন লর্ড বেন্টিঙ্ক মেকলের সুপারিশ গ্রহণ করে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সরকারি নীতি ঘোষণা করেন।

প্রশ্ন ২: টমাস ব্যাবিংটন মেকলের ‘মিনিট’ (১৮৩৫) কীভাবে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পথ প্রশস্ত করেছিল, তা আলোচনা করো। 🇬🇧✍️

উত্তর: ভূমিকা: টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ছিলেন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব এবং সাধারণ জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি তিনি ভারতে শিক্ষানীতি বিষয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব (Minutes) পেশ করেন, তা ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত এবং এটি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।

পাশ্চাত্য শিক্ষার পথ প্রশস্তকরণে মেকলের মিনিটের ভূমিকা:

  • প্রাচ্য শিক্ষার সমালোচনা: মেকলে তাঁর প্রস্তাবে প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞানচর্চাকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে তাকে ‘নিকৃষ্ট’ ও ‘অবৈজ্ঞানিক’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, “একটি ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক ভারত ও আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ”।
  • ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সুপারিশ: তিনি ভারতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে গ্রহণ করার এবং ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন।
  • ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র অবতারণা: মেকলে মনে করতেন, প্রথমে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তার করলে, তা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
  • সরকারি নীতি নির্ধারণে প্রভাব: মেকলের জোরালো যুক্তির প্রভাবে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালের ৭ই মার্চ ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারকে সরকারি নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।

উপসংহার: মেকলে মিনিটের সুপারিশগুলি ভারতে ব্রিটিশ শিক্ষানীতির অভিমুখ সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য শিক্ষার দিকে ঘুরিয়ে দেয়, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে পড়েছিল।

প্রশ্ন ৩: মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ (Downward Filtration Theory) বলতে কী বোঝায়? এই নীতির মূল উদ্দেশ্য ও সীমাবদ্ধতা কী ছিল? 👇💧

উত্তর: ভূমিকা: টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের প্রেক্ষাপটে যে নীতি সুপারিশ করেছিলেন, তা ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ বা ‘ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি’ নামে পরিচিত। চুঁইয়ে পড়া নীতির ধারণা: এই নীতির মূল কথা হলো, ভারতে সরকারি শিক্ষা প্রথমে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। আশা করা হয়েছিল যে, এই শিক্ষিত শ্রেণি পরবর্তীকালে তাদের অর্জিত জ্ঞান ও ভাবধারা ধীরে ধীরে সমাজের নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে, ঠিক যেমন জল ফিল্টারের ওপর থেকে চুঁইয়ে নিচে পড়ে।

মূল উদ্দেশ্য:

  • সীমিত সম্পদে অধিক প্রভাব: ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত সীমিত অর্থ ব্যয় করে সমাজের প্রভাবশালী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অংশকে শিক্ষিত করে তোলা, যাতে তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
  • শাসক ও শাসিতের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী তৈরি: এমন এক ভারতীয় শ্রেণি তৈরি করা যারা “রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ” এবং ব্রিটিশ শাসক ও সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।
  • পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রসার: এই শিক্ষিত শ্রেণির মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রসার ঘটানো।

সীমাবদ্ধতা:

  • সাধারণ শিক্ষার অবহেলা: এই নীতির ফলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ব্যাপকভাবে অবহেলিত হয়েছিল, কারণ সরকারের মনোযোগ ছিল মূলত উচ্চশিক্ষার দিকে।
  • শিক্ষার বিস্তার সীমিত: শিক্ষা সমাজের ওপর থেকে নিচে সেভাবে চুঁইয়ে পড়েনি; বরং এটি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ থাকে, ফলে সমাজে একটি নতুন বিভাজন তৈরি হয়।

উপসংহার: ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ ঔপনিবেশিক ভারতে শিক্ষার প্রসারে একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ ছিল, যা সীমিত সাফল্য পেলেও গণশিক্ষার আদর্শকে ব্যাহত করেছিল।

প্রশ্ন ৪: ‘উডের ডেসপ্যাচ’ (১৮৫৪)-কে কেন ভারতীয় শিক্ষার ‘মহাসনদ’ (Magna Carta) বলা হয়? এর প্রধান সুপারিশগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো। 📜🌟

উত্তর: ভূমিকা: ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উড ভারতে শিক্ষাবিস্তার সংক্রান্ত একটি বিস্তারিত নির্দেশনামা প্রকাশ করেন, যা ‘উডের ডেসপ্যাচ’ নামে পরিচিত। ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ‘মহাসনদ’ বলার কারণ: উডের ডেসপ্যাচকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ‘মহাসনদ’ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’ বলা হয় কারণ এটিই প্রথম ব্রিটিশ সরকারের তরফে ভারতে একটি সুসংহত, সার্বিক ও আধুনিক শিক্ষানীতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রদান করেছিল। এর সুপারিশগুলির ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে ভারতে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো গড়ে ওঠে।

প্রধান সুপারিশগুলি:

  • পৃথক শিক্ষা দপ্তর: প্রতিটি প্রদেশে একটি করে স্বতন্ত্র শিক্ষা দপ্তর (Department of Public Instruction) গঠন করার সুপারিশ করা হয়।
  • বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন: কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়।
  • শিক্ষার স্তরবিন্যাস: প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় এইরকম একটি স্তরভিত্তিক শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
  • মাতৃভাষায় শিক্ষাদান: প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে এবং উচ্চস্তরে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের সুপারিশ করা হয়।
  • নারীশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার: নারীশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
  • সাহায্যদান প্রথা (Grants-in-aid): যোগ্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারি অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়।
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।

উপসংহার: উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশগুলি ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল, যদিও এর বাস্তবায়ন ঔপনিবেশিক সরকারের স্বার্থ দ্বারা во многом (অনেকটাই) প্রভাবিত ছিল।

প্রশ্ন ৫: হান্টার কমিশনের (১৮৮২) সুপারিশগুলি কী ছিল এবং ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় এর প্রভাব কতখানি পড়েছিল? 🧐📊

উত্তর: ভূমিকা: লর্ড রিপনের ഭരണকালে (শাসনকালে) ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে হান্টার কমিশন গঠিত হয়। ভারতে উডের ডেসপ্যাচের (১৮৫৪) পরবর্তী সময়ে শিক্ষার অগ্রগতি, বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ করাই ছিল এই কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য।

প্রধান সুপারিশগুলি:

  • প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব: কমিশন প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। এই শিক্ষার দায়িত্ব স্থানীয় সংস্থাগুলির (যেমন জেলা ও মিউনিসিপ্যাল বোর্ড) হাতে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
  • মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা: প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেশীয় বা মাতৃভাষা ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়।
  • সরকারি অনুদান: বেসরকারি বিদ্যালয় ও কলেজগুলিকে সরকারি সাহায্য (গ্রান্টস-ইন-এইড) দেওয়ার নীতি আরও উদার ও সম্প্রসারিত করার কথা বলা হয়।
  • মাধ্যমিক শিক্ষার দুটি ধারা: মাধ্যমিক শিক্ষাকে দুটি ধারায় বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়: (ক) সাহিত্য ও কলা বিষয়ক শিক্ষা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য (খ) বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রস্তুত করবে।
  • নারীশিক্ষার প্রসার: নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
  • সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমানোর কথা বলা হয়।

প্রভাব:

  • হান্টার কমিশনের সুপারিশগুলি পরবর্তীকালে ভারতের শিক্ষানীতিতে প্রভাব ফেলেছিল। প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং স্থানীয় সংস্থাগুলির ভূমিকা বৃদ্ধি পায়।
  • বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি সরকারি অনুদান পাওয়ায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
  • তবে, সরকারি ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার আশানুরূপ হয়নি এবং শিক্ষার গুণগত মানের বিষয়েও প্রশ্ন ওঠে।

উপসংহার: হান্টার কমিশন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার পর্যালোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর সুপারিশগুলির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঔপনিবেশিক সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল, যা সবসময় ভারতীয়দের স্বার্থের অনুকূলে ছিল না।

প্রশ্ন ৬: উনিশ শতকে বাংলায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা আলোচনা করো। ✝️📖

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচার, কিন্তু শিক্ষার বিস্তারকেও তাঁরা সেই লক্ষ্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে দেখেছিলেন।

ভূমিকা ও কার্যাবলী:

  • বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপন: মিশনারিরা বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
    • শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন (১৮০০): উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড (‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’) এই মিশন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর অধীনে প্রায় ১২৬টি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। তাঁরা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর কলেজও প্রতিষ্ঠা করেন, যা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল।
    • লন্ডন মিশনারি সোসাইটি: রবার্ট মে-র উদ্যোগে এই সোসাইটি চুঁচুড়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রায় ৩৬টি বিদ্যালয় স্থাপন করে।
    • স্কটিশ মিশন: আলেকজান্ডার ডাফের নেতৃত্বে এই মিশন ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন’ (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) প্রতিষ্ঠা করে, যা উচ্চমানের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
    • অন্যান্য উদ্যোগ: বিশপ মিডলটন শিবপুরে বিশপস্ কলেজ (১৮১৯), জেসুইট মিশনারিরা কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ (১৮৩৫) ও লরেটো হাউস (১৮৪২) প্রতিষ্ঠা করেন।
  • নারীশিক্ষায় অবদান: মিশনারিরাই প্রথম বাংলায় বালিকাদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন।
  • মুদ্রণ ও পাঠ্যপুস্তক: শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে বাংলা ভাষায় বাইবেল ও অন্যান্য গ্রন্থ ছাপিয়ে শিক্ষার প্রসারে সাহায্য করে।

উদ্দেশ্য ও প্রভাব: মিশনারিদের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার হলেও, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রসারে সহায়ক হয়েছিল। এর ফলে বাঙালির মধ্যে যুক্তিবাদ ও আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে, যা পরবর্তীকালে বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরিতে সাহায্য করে।

উপসংহার: উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর ক্ষেত্রে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, যদিও তাঁদের কার্যক্রমের পেছনে ধর্মীয় উদ্দেশ্য সক্রিয় ছিল।

প্রশ্ন ৭: শিক্ষাবিস্তারে ডেভিড হেয়ারের অবদান উল্লেখ করো। 🕰️❤️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে স্কটল্যান্ডের ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫-১৮৪২) এক স্মরণীয় নাম। তিনি তাঁর উপার্জিত অর্থ ও সমগ্র জীবন এদেশের মানুষের মধ্যে আধুনিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।

অবদান:

  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৭): ডেভিড হেয়ার কলকাতায় হিন্দু কলেজ (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। এই কলেজ বাংলা তথা ভারতে পাশ্চাত্য ধারার উচ্চশিক্ষা বিস্তারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে।
  • বিদ্যালয় স্থাপন: তিনি কলকাতায় আরও কয়েকটি ইংরেজি শিক্ষার বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যেমন – সিমলা স্কুল, আরপুলি স্কুল এবং পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি (যার বর্তমান নাম হেয়ার স্কুল) ।
  • ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭): শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ছাপানো ও বিতরণের উদ্দেশ্যে তিনি এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন ।
  • ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি (১৮১৮): নতুন নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং বিদ্যমান বিদ্যালয়গুলির উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি তিনি গড়ে তোলেন ।
  • কলকাতা মেডিকেল কলেজে উৎসাহদান: সামাজিক কুসংস্কার উপেক্ষা করে ভারতীয় ছাত্রদের কলকাতা মেডিকেল কলেজে শবব্যবচ্ছেদসহ আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা চর্চায় উৎসাহিত করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।

উপসংহার: ডেভিড হেয়ার ছিলেন একজন প্রকৃত মানবতাবাদী ও শিক্ষানুরাগী। তাঁর নিঃস্বার্থ উদ্যোগ বাংলায় আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।

প্রশ্ন ৮: রাজা রামমোহন রায় কীভাবে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট হয়েছিলেন? 💡🇮🇳

উত্তর: ভূমিকা: ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

উদ্যোগসমূহ:

  • লর্ড আমহার্স্টকে চিঠি (১৮২৩): ১৮১৩ সালের সনদ আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত এক লক্ষ টাকা প্রাচ্য শিক্ষার পরিবর্তে গণিত, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন, শারীরস্থান বিদ্যা ও অন্যান্য উপযোগী বিজ্ঞানসহ পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয় করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বড়লাট লর্ড আমহার্স্টকে এক ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন ।
  • বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: তিনি নিজে কলকাতায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল (১৮১৫ বা ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ) নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যেখানে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল ।
  • বেদান্ত কলেজ স্থাপন (১৮২৫/২৬): প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে তিনি বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন ।
  • অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহযোগিতা: হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় ডেভিড হেয়ারকে এবং জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠায় আলেকজান্ডার ডাফকে তিনি সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন ।

উপসংহার: রাজা রামমোহন রায়ের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন উদ্যোগগুলি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করতে এবং একটি আধুনিকমনস্ক বাঙালি সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রশ্ন ৯: শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা রাধাকান্ত দেবের রক্ষণশীলতা ও প্রগতিশীলতার একটি তুলনামূলক আলোচনা করো। 🤔⚖️

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলার এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রাজা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭) শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে এক জটিল ও দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁকে একদিকে যেমন কিছু প্রগতিশীল শিক্ষামূলক উদ্যোগের সমর্থক হিসেবে দেখা যায়, তেমনই অন্যদিকে তাঁর রক্ষণশীল মনোভাবও প্রকট ছিল।

প্রগতিশীল ভূমিকা:

  • পাশ্চাত্য শিক্ষায় সমর্থন: তিনি হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এবং এই প্রতিষ্ঠানে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ জুগিয়েছেন ।
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যুক্ততা: তিনি ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ও ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ।
  • চিকিৎসাশাস্ত্রে আধুনিকতা: কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের শবব্যবচ্ছেদকে তিনি সমর্থন করেছিলেন, যা তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রগতিশীল পদক্ষেপ ছিল ।
  • নারীশিক্ষায় পরোক্ষ সমর্থন: তিনি গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারের সহযোগিতায় ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ (১৮২২) নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, নারীশিক্ষা হিন্দু ঐতিহ্যবিরোধী নয় ।

রক্ষণশীল মনোভাব:

  • প্রাচ্য শিক্ষার প্রতি দুর্বলতা: তিনি মূলত প্রাচ্যবাদী শিক্ষাকাঠামোর মধ্যে থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সচেষ্ট ছিলেন ।
  • সতীদাহ প্রথার সমর্থন: রাজা রামমোহন রায় যখন সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন, তখন রাধাকান্ত দেব ‘ধর্মসভা’ (১৮৩০) প্রতিষ্ঠা করে এই প্রথার সমর্থনে প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলেন।
  • নারীশিক্ষার সীমাবদ্ধতা: নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও, তিনি মেয়েদের বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনার চেয়ে গৃহশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন ।
  • বিধবাবিবাহের বিরোধিতা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনেরও তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।

উপসংহার: রাজা রাধাকান্ত দেবের চরিত্রে প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ দেখা যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষার কিছু দিক গ্রহণ করলেও, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মূলত ঐতিহ্যবাদী ও স্থিতাবস্থার সমর্থক।

প্রশ্ন ১০: উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষা বিস্তারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগগুলি কতখানি সফল হয়েছিল? 👩‍🏫💪

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষার আলো ছাড়া নারীসমাজের প্রকৃত উন্নতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এই লক্ষ্যে তিনি একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন।

বিদ্যাসাগরের উদ্যোগসমূহ:

  • বেথুন স্কুলে সহযোগিতা: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বেথুন সাহেব) ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ (পরে বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা করলে, বিদ্যাসাগর এই উদ্যোগকে wholeheartedly (সর্বান্তকরণে) সমর্থন করেন এবং বিদ্যালয়টির সম্পাদক হিসেবে এর পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।
  • ব্যক্তিগত উদ্যোগে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন: তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ১৮৫৭-৫৮ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং সরকারি সহায়তায় বাংলার বিভিন্ন জেলায় (হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদিয়া) প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা । এই বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশোনা করত এবং এগুলির বেশিরভাগই তিনি নিজ ব্যয়ে চালাতেন ।
  • মাতৃস্মৃতিতে বিদ্যালয়: জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিজ গ্রাম বীরসিংহে মায়ের নামে ‘ভগবতী বালিকা বিদ্যালয়’ (১৮৯০) প্রতিষ্ঠা করেন ।
  • পাঠ্যপুস্তক রচনা: তাঁর রচিত ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’ ইত্যাদি শিশুপাঠ্য গ্রন্থগুলি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে অপরিহার্য ছিল ।

সাফল্যের মূল্যায়ন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগ তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে নারীশিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি বহু বালিকাকে শিক্ষার আলোয় এনেছিল। যদিও সামাজিক কুসংস্কার, বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা এবং সরকারি সহায়তার অভাবের কারণে তাঁর প্রচেষ্টার সাফল্য কিছুটা সীমাবদ্ধ ছিল, তবুও তাঁর দেখানো পথেই বাংলায় নারীশিক্ষার ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে নারী প্রগতির ধারা আরও বেগবান হয়েছিল।

উপসংহার: প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে নারীশিক্ষার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংগ্রাম ও সাফল্য উনিশ শতকের বাংলার ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।

প্রশ্ন ১১: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বেথুন সাহেব) কীভাবে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে স্মরণীয় হয়ে আছেন? 🏫❤️

উত্তর: ভূমিকা: জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১) ছিলেন গভর্নর জেনারেলের আইন সচিব এবং শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি। উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়।

অবদান:

  • হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় (বেথুন স্কুল) প্রতিষ্ঠা: বেথুনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ১৮৪৯ সালের ৭ই মে কলকাতার সিমলা স্ট্রিটে ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা । এটিই পরবর্তীকালে ‘বেথুন স্কুল’ নামে পরিচিত হয়। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ভারতীয় শিক্ষানুরাগীদের সক্রিয় সহযোগিতা লাভ করেন ।
  • ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক শিক্ষার প্রসার: বেথুন স্কুল ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য ধর্মনিরপেক্ষ বালিকা বিদ্যালয়, যেখানে আধুনিক পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
  • ব্যক্তিগত উৎসর্গ: বেথুন সাহেব নারীশিক্ষার প্রতি এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে, তিনি তাঁর যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি এই বিদ্যালয়ের জন্য দান করে যান ।
  • বেথুন কলেজ: তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিই পরবর্তীকালে বিকশিত হয়ে ১৮৭৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বেথুন কলেজ’-এ উন্নীত হয়, যা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ ।

উপসংহার: ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ছিলেন একজন প্রকৃত শিক্ষানুরাগী এবং নারী প্রগতির সমর্থক। তাঁর দূরদৃষ্টি ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই বাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক নারীশিক্ষার এক মজবুত ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে অগণিত নারীর জীবনে শিক্ষার আলো এনে দিয়েছে।

প্রশ্ন ১২: কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আলোচনা করো। 🩺🔬

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যার প্রসারে কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫) এক যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছিল। এর প্রতিষ্ঠার পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ ও প্রেক্ষাপট ছিল।

প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট:

  • প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: তৎকালীন ভারতে প্রচলিত আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসা ব্যবস্থা মূলত পুঁথিগত এবং অভিজ্ঞতানির্ভর ছিল। এতে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যবচ্ছেদ বা শল্যচিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের চর্চা ছিল না।
  • কোম্পানির প্রয়োজন: ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ সৈন্য ও কর্মচারীদের চিকিৎসার জন্য ইউরোপ থেকে ডাক্তার আনতে হতো যা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই, দেশীয় ডাক্তার তৈরির প্রয়োজন অনুভূত হয়।
  • সরকারি উদ্যোগ ও কমিশন গঠন: গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতে আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হন। তিনি ১৮৩৩ সালে জন গ্রান্টের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল কমিশন গঠন করেন।
  • কমিশনের সুপারিশ: এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৮৩৫ সালের ২৮শে জানুয়ারি কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয় এবং পুরনো ‘নেটিভ মেডিকেল ইনস্টিটিউশন’, সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগ এবং মাদ্রাসার ইউনানি বিভাগে শিক্ষাদান বন্ধ করে দেওয়া হয়।

উপসংহার: এই সমস্ত কারণের সম্মিলিত ফলস্বরূপ, ভারতে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রশ্ন ১৩: মধুসূদন গুপ্তের শবব্যবচ্ছেদকে কেন ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা বলা হয়? 🔪

উত্তর: ভূমিকা: কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র মধুসূদন গুপ্ত ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি (কারও মতে ২৮শে অক্টোবর) প্রথম ভারতীয় হিসেবে শবব্যবচ্ছেদ করে এক ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেন, যা ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।

যুগান্তকারী বলার কারণ:

  • কুসংস্কারের অবসান: তৎকালীন ভারতীয় সমাজে মৃতদেহ স্পর্শ করা এবং কাটাছেঁড়া করা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ ও পাপ বলে মনে করা হতো। মধুসূদন গুপ্ত এই গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে গিয়ে শবব্যবচ্ছেদ করে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেন।
  • বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষার সূচনা: এই ঘটনা পুঁথিগত শিক্ষার পরিবর্তে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাস্তবসম্মত চর্চার পথ খুলে দেয়। এর ফলে অ্যানাটমি বা শারীরবিদ্যা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানার্জন সম্ভব হয়।
  • ভবিষ্যৎ ছাত্রদের অনুপ্রেরণা: মধুসূদন গুপ্তের এই সাহসী পদক্ষেপ মেডিকেল কলেজের অন্যান্য ভারতীয় ছাত্রদের শবব্যবচ্ছেদে উৎসাহিত করে। তাঁর কাজে সহায়তা করেছিলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত প্রমুখ ছাত্ররা।
  • আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন: শবব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে ব্যবহারিক জ্ঞানার্জন শুরু হওয়ায়, ভারতে দক্ষ ও আধুনিক মনোভাবাপন্ন চিকিৎসক তৈরির পথ সুগম হয়, যা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে।

উপসংহার: মধুসূদন গুপ্তের এই একক সাহসী পদক্ষেপ ছিল কুসংস্কারের ওপর বিজ্ঞানের জয় এবং ভারতে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথে এক বিশাল মাইলফলক।

প্রশ্ন ১৪: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার (১৮৫৭) প্রেক্ষাপট ও প্রাথমিক কার্যাবলী উল্লেখ করো। 🏛️🎓

উত্তর: ভূমিকা: ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ছিল ভারতের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রতিষ্ঠার পেছনে সুস্পষ্ট প্রেক্ষাপট এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল।

প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট:

  • উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ‘মহাসনদ’ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামে পরিচিত স্যার চার্লস উডের নির্দেশনামায় (১৮৫৪) কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছিল।
  • উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: দেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটায় বহু কলেজ স্থাপিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের পঠনপাঠনের মান নিয়ন্ত্রণ এবং ছাত্রদের পরীক্ষা নিয়ে ডিগ্রি দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ছিল।
  • সরকারি উদ্যোগ: উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ কার্যকর করার জন্য তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর উদ্যোগে আইন পাস করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। প্রাথমিক কার্যাবলী:
  • অনুমোদন ও পরীক্ষা গ্রহণ: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কাজ ছিল বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কলেজকে পড়ানোর জন্য অনুমোদন (Affiliation) দেওয়া এবং সেই কলেজের ছাত্রদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরীক্ষা নিয়ে সফল ছাত্রদের ডিগ্রি প্রদান করা।
  • পাঠ্যক্রম নির্ধারণ: বিভিন্ন পরীক্ষার (যেমন – এনট্রান্স, এফ.এ, বি.এ, এম.এ) জন্য পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস নির্ধারণ করা।
  • ডিগ্রি প্রদান: ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বি.এ. এবং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এম.এ. ডিগ্রি প্রদান শুরু করে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও যদুনাথ বসু ছিলেন প্রথম দুজন বি.এ. স্নাতক।

উপসংহার: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমদিকে মূলত একটি পরীক্ষক সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করলেও, পরবর্তীকালে এটি গবেষণা ও উচ্চমানের জ্ঞানচর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।

প্রশ্ন ১৫: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সময়কালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো। 🌟🐯

Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

উত্তর: ভূমিকা: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (যিনি ‘বাংলার বাঘ’ নামে পরিচিত ছিলেন) মোট চারবার (১৯০৬-১৪ এবং ১৯২১-২৩) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি পরীক্ষক সংস্থা থেকে এক বিশ্বমানের গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়।

অগ্রগতি ও অবদান:

  • নতুন বিভাগ খোলা: আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা, পালি, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যাসহ বহু নতুন স্নাতকোত্তর (Post-graduate) বিভাগ খোলেন।
  • শিক্ষক নিয়োগ: তিনি দেশ-বিদেশ থেকে বহু স্বনামধন্য অধ্যাপককে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আনেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সি. ভি. রমন, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ।
  • গবেষণায় উৎসাহদান: তিনি পঠনপাঠনের পাশাপাশি মৌলিক গবেষণার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন এবং গবেষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা তৈরি করেন।
  • বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বশাসিত রাখা: লর্ড কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের (১৯০৪) মাধ্যমে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চেয়েছিল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এই সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের অধিকার অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন।

উপসংহার: স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দূরদৃষ্টি ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এক আধুনিক জ্ঞানচর্চার পীঠস্থানে পরিণত হয়েছিল এবং তার খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।

প্রশ্ন ১৬: উনিশ শতকের ব্রিটিশ শিক্ষানীতির প্রধান ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল? 😟🇬🇧

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে ব্রিটিশ সরকার ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, তাদের শিক্ষানীতির পেছনে ঔপনিবেশিক স্বার্থ সক্রিয় ছিল। এর ফলে এই শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু গুরুতর ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থেকে যায়।

প্রধান ত্রুটিসমূহ:

  • গণশিক্ষার অবহেলা: মেকলের ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র মতো নীতির কারণে সরকার মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্তের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল। এর ফলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা চরমভাবে অবহেলিত হয় এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে।
  • শহরকেন্দ্রিকতা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি মূলত কলকাতা ও অন্যান্য কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ বাংলায় শিক্ষার প্রসার ঘটেনি।
  • মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা: শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় বাংলাসহ অন্যান্য দেশীয় ভাষার উন্নতি ব্যাহত হয় এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিক্ষা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে।
  • কারিগরি শিক্ষার অভাব: সাধারণ শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হলেও, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রসারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
  • ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য: ব্রিটিশ শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের মধ্যে থেকে স্বল্প বেতনের অনুগত কর্মচারী তৈরি করা, যারা ব্রিটিশ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। একটি স্বাধীন চিন্তাশীল জাতি গঠন করা তাদের লক্ষ্য ছিল না।

উপসংহার: ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি ভারতে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটালেও, এর সীমাবদ্ধতাগুলি দেশের সার্বিক ও সুষম উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

প্রশ্ন ১৭: ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ এবং ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’র ভূমিকা কী ছিল? 📚🤝

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এই দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

  • ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭):
    • প্রতিষ্ঠাতা: ডেভিড হেয়ার, স্যার হাইড ইস্ট প্রমুখ।
    • উদ্দেশ্য: তৎকালীন বিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্যপুস্তকের বিশাল অভাব ছিল। এই সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সুলভে ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় উন্নত মানের পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা
    • ভূমিকা: এই সোসাইটি গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, নীতিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বই প্রকাশ করে শিক্ষার প্রসারে বিরাট সাহায্য করেছিল।
  • ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি (১৮১৮):
    • প্রতিষ্ঠাতা: ডেভিড হেয়ার, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ।
    • উদ্দেশ্য: এই সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কলকাতায় ও তার আশেপাশে নতুন নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করা এবং বিদ্যমান বিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান উন্নত করা
    • ভূমিকা: এই সোসাইটি বহু বিদ্যালয়কে আর্থিক সাহায্য করত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত এবং যোগ্য ছাত্রদের বৃত্তি দিয়ে পড়াশোনায় উৎসাহিত করত।

উপসংহার: এই দুটি সোসাইটির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এক মজবুত ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।

প্রশ্ন ১৮: শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের শিক্ষাবিস্তার সম্পর্কিত কার্যাবলী আলোচনা করো। ✝️⛪

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশন এক পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিল। উইলিয়াম কেরি, জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড, যাঁরা একত্রে ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ নামে পরিচিত, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে এই মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

শিক্ষাবিস্তারে কার্যাবলী:

  • বিদ্যালয় স্থাপন: এই মিশন বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য প্রায় ১২৬টি বিদ্যালয় স্থাপন করে, যেখানে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হতো।
  • শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা (১৮১৮): উচ্চশিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে তাঁরা শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী কলেজগুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি সাধারণ বিষয়েও পড়ানো হতো।
  • মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ: শ্রীরামপুর মিশন প্রেস স্থাপন করে তাঁরা বাংলা ভাষায় বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক ছেপে শিক্ষার প্রসারে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। বাংলা গদ্যের বিকাশেও এই ছাপাখানার ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
  • নারীশিক্ষায় উদ্যোগ: মিশনের সদস্যরা নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বালিকাদের জন্যও বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।

উপসংহার: ধর্মপ্রচার মূল উদ্দেশ্য হলেও, শ্রীরামপুর মিশনের শিক্ষা সংক্রান্ত উদ্যোগগুলি বাংলায় আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করতে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

প্রশ্ন ১৯: টীকা লেখো: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। 🏛️🇬🇧

উত্তর: ভূমিকা: গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুলাই কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল ভারতে ব্রিটিশদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য:

  • প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ: কলেজের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অসামরিক কর্মচারীদের (সিভিলিয়ানদের) ভারতীয় ভাষা (যেমন – বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত, ফারসি), আইন, ইতিহাস, রীতিনীতি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করা, যাতে তাঁরা দক্ষতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন।
  • প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা: এই কলেজে প্রাচ্যবিদ্যার বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা ও চর্চার ব্যবস্থা ছিল। বাংলা ভাষার বিকাশে ভূমিকা:
  • এই কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন উইলিয়াম কেরি।
  • মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, গোলকনাথ শর্মা প্রমুখ পণ্ডিতরা এই কলেজে কাজ করতেন।
  • তাঁদের প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত ও অনূদিত হয়, যা বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রাথমিক বিকাশে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
  • কলেজের প্রয়োজনে বাংলা হরফ তৈরি ও ছাপাখানার উন্নতি ঘটে।

পরিণতি: যদিও কোম্পানির পরিচালন সভার নির্দেশে এই কলেজ পরে মূলত একটি ভাষা শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়, তবুও উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা ভাষার বিকাশে এর অবদান ছিল অনস্বীকার্য।

প্রশ্ন ২০: ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করো। 🏛️🆚🧑‍🤝‍🧑

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই দুই ধরনের উদ্যোগের লক্ষ্য ও পদ্ধতিতে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও বেশ কিছু বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়।

তুলনামূলক আলোচনা:

বিষয়সরকারি উদ্যোগবেসরকারি উদ্যোগ (মিশনারি ও ভারতীয়)
মূল লক্ষ্য• ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য ইংরেজি জানা কর্মচারী তৈরি করা ।
• ভারতে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য তৈরি করা ।
• সীমিত পরিসরে ‘সভ্য’ করে তোলার ধারণা।
মিশনারি: খ্রিস্টধর্ম প্রচার ।
ভারতীয়: সামাজিক কুসংস্কার দূর করা, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মাধ্যমে দেশের উন্নতি ।
পরিধি• মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এবং শহরকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা ।
• ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র (Downward Filtration Theory) প্রয়োগ ।
মিশনারি: বিভিন্ন অঞ্চলে, এমনকি প্রত্যন্ত এলাকাতেও বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা ।
ভারতীয়: প্রধানত কলকাতা ও অন্যান্য শহরে, তবে নারীশিক্ষা ও গণশিক্ষার প্রতিও আগ্রহ দেখা যায় ।
শিক্ষার মাধ্যম• ১৮৩৫ সালের পর থেকে মূলত ইংরেজি ভাষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ ।
• উডের ডেসপ্যাচে (১৮৫৪) প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষা ও উচ্চস্তরে ইংরেজির কথা বলা হলেও, কার্যক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্যই ছিল বেশি ।
মিশনারি: কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করলেও, ইংরেজি শিক্ষার ওপর জোর দিত ।
ভারতীয়: রামমোহন রায় পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক হলেও, বিদ্যাসাগর মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব দেন ।
অর্থায়ন• ১৮১৩ সালের সনদ আইন অনুযায়ী বার্ষিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ ।
• পরবর্তীকালে প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়।
মিশনারি: বিদেশি সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অর্থ ।
ভারতীয়: ব্যক্তিগত দান, বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিদের চাঁদা ।
ফলাফল• আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো তৈরি ।
• বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ।
• ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ।
• শিক্ষার প্রাথমিক প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ।
• হিন্দু কলেজ, বেথুন স্কুলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন ।
• পাঠ্যপুস্তক রচনা ও মুদ্রণে সাহায্য ।

উপসংহার: সরকারি উদ্যোগগুলি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করলেও, বেসরকারি উদ্যোগগুলি, বিশেষত ভারতীয় বিদ্যোৎসাহীদের প্রচেষ্টা, বাংলায় আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন এবং সামাজিক চেতনার উন্মেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। উভয় উদ্যোগের সম্মিলিত ফলেই উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষার নবজাগরণ সম্ভব হয়েছিল।

প্রশ্ন ২১: “মেকলে মিনিট ভারতে আধুনিক শিক্ষার অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছিল” – মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। 🗣️🧭

উত্তর: ভূমিকা: টমাস ব্যাবিংটন মেকলের ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে পেশ করা প্রস্তাব, যা ‘মেকলে মিনিট’ নামে পরিচিত, ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতির ইতিহাসে এক বিতর্কিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই প্রস্তাব যে ভারতে আধুনিক শিক্ষার অভিমুখ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়।

শিক্ষার অভিমুখ নির্ধারণে ভূমিকা:

  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা: মেকলে তাঁর প্রস্তাবে প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞানচর্চাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপের সুপারিশ করেন । এই সুপারিশ গৃহীত হওয়ায় সরকারি শিক্ষানীতি সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুকূলে চলে যায়।
  • শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি: মেকলে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন । এর ফলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং ভারতীয় ভাষাগুলি তুলনামূলকভাবে অবহেলিত হয়।
  • ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র প্রয়োগ: তাঁর প্রস্তাবিত ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’ অনুসারে, সমাজের উচ্চস্তরে পাশ্চাত্য শিক্ষা দিলে তা ক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে । এই নীতি সীমিত পরিসরে হলেও শিক্ষার একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি করে।
  • ঔপনিবেশিক উদ্দেশ্য সাধন: মেকলের লক্ষ্য ছিল এমন এক ভারতীয় শ্রেণি তৈরি করা, যারা রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি ও বুদ্ধিতে ইংরেজদের অনুসারী হবে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে । শিক্ষার এই অভিমুখ ঔপনিবেশিক শাসনকে সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল।

উপসংহার: যদিও মেকলের শিক্ষানীতি গণশিক্ষা ও মাতৃভাষার অবহেলাসহ বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হয়েছিল, তবুও এটি অস্বীকার করা যায় না যে, তাঁর প্রস্তাবই ভারতে সরকারি উদ্যোগে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের পথ খুলে দিয়েছিল এবং পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দীর জন্য ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অভিমুখ নির্ধারণ করেছিল।

প্রশ্ন ২২: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির তাৎপর্য কী ছিল? 👧📚🌟

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলি তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

তাৎপর্য:

  • নারীশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন: বিদ্যাসাগর যখন বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন, তখন সমাজে নারীশিক্ষা প্রায় ব্রাত্য ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় (১৮৫৭-৫৮) বাংলার বিভিন্ন গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে নারীশিক্ষার এক মজবুত ভিত্তি স্থাপন করে।
  • সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ: তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ মনে করত, মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে অকল্যাণ হবে। বিদ্যাসাগরের এই বিদ্যালয়গুলি ছিল সেই সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
  • নারীর ক্ষমতায়নের সূচনা: শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের আত্মসচেতন করে তোলা এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করাই ছিল বিদ্যাসাগরের লক্ষ্য । এই বিদ্যালয়গুলি সেই ক্ষমতায়নের প্রাথমিক সোপান হিসেবে কাজ করেছিল।
  • ব্যাপকতার প্রয়াস: কলকাতা শহরের বাইরে, হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদিয়ার মতো জেলাগুলির গ্রামে এই বিদ্যালয়গুলি স্থাপিত হওয়ায়, শিক্ষার আলো শহরের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছানোর একটি প্রয়াস দেখা যায়। এই বিদ্যালয়গুলিতে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশোনা করত ।

উপসংহার: আর্থিক সংকট ও সামাজিক বিরোধিতা সত্ত্বেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে নিষ্ঠা ও упорством (অধ্যবসায়) নিয়ে বালিকা বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছিলেন, তা বাংলার নারীশিক্ষার ইতিহাসে তাঁকে এক অমর ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এই বিদ্যালয়গুলিই পরবর্তীকালে নারী প্রগতির পথকে প্রশস্ত করেছিল।

প্রশ্ন ২৩: কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথমদিকের বাঙালি ছাত্রদের প্রতিকূলতা ও সাফল্য আলোচনা করো। 🩺👨‍🎓💪

উত্তর: ভূমিকা: ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে, এটি ছিল ভারতীয়দের জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিদ্যা শেখার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ । তবে প্রথমদিকের বাঙালি ছাত্রদের এই নতুন ধারার শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তাঁরা উল্লেখযোগ্য সাফল্যও অর্জন করেছিলেন।

প্রতিকূলতা:

  • সামাজিক কুসংস্কার: তৎকালীন হিন্দু সমাজে শবব্যবচ্ছেদ বা মৃতদেহ স্পর্শ করা ধর্মীয়ভাবে অশাস্ত্রীয় ও পাপ বলে মনে করা হতো । এই কারণে অনেক ছাত্র এবং তাদের পরিবারবর্গ মেডিকেল কলেজে পড়া এবং বিশেষত অ্যানাটমি বা শবব্যবচ্ছেদবিদ্যা শেখার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন।
  • ধর্মচ্যুতির ভয়: শবব্যবচ্ছেদ করলে সমাজে পতিত বা একঘরে হওয়ার ভয় ছিল ।
  • ভাষাগত সমস্যা: শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ায় অনেক ছাত্রের পক্ষেই প্রথমদিকে বিষয়গুলি বোঝা কঠিন হতো।
  • পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি অনাস্থা: দেশীয় আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসার প্রচলন থাকায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্য অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি প্রাথমিক অনাস্থা ছিল।

সাফল্য:

  • মধুসূদন গুপ্তের সাহসিকতা: সমস্ত সামাজিক বাধা ও ভয় উপেক্ষা করে মধুসূদন গুপ্ত ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ভারতীয় হিসেবে শবব্যবচ্ছেদ করেন, যা এক যুগান্তকারী ঘটনা। তাঁকে সহায়তা করেছিলেন উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্রের মতো ছাত্ররা ।
  • দক্ষ চিকিৎসক তৈরি: প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, মেডিকেল কলেজ থেকে বহু কৃতি বাঙালি ছাত্র (যেমন – উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত) ডাক্তারি পাস করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসা সেবায় নিযুক্ত হন এবং আধুনিক চিকিৎসার প্রসার ঘটান ।
  • উচ্চশিক্ষার সুযোগ: এই কলেজের কিছু ছাত্র পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও গিয়েছিলেন, যেমন দ্বারকানাথ ঠাকুরের আর্থিক সহায়তায় চারজন কৃতি ছাত্র ইংল্যান্ডে যান ।

উপসংহার: কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রথমদিকের বাঙালি ছাত্ররা সামাজিক কুসংস্কার ও প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন এবং ভারতে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।

প্রশ্ন ২৪: উনিশ শতকে বাংলায় উচ্চশিক্ষা বিস্তারে হিন্দু কলেজের (পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়) অবদান কী ছিল? 🏛️🌟

উত্তর: ভূমিকা: ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজ ছিল বাংলায় তথা ভারতে পাশ্চাত্য ধারার উচ্চশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান । পরবর্তীকালে এটি প্রেসিডেন্সি কলেজ (১৮৫৫) এবং আরও পরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় (২০১০) নামে পরিচিত হয়।

অবদান:

  • পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন: হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভারতীয় যুবকদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্য ও পাশ্চাত্য বিজ্ঞান বিষয়ে আধুনিক শিক্ষাদান করা। এখানে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস, গণিত ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা পড়ানো হতো।
  • আধুনিক মনন গঠন: এই কলেজের শিক্ষা বহু বাঙালি তরুণের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তাধারা, মানবতাবাদ ও জিজ্ঞাসু மனப்பான்மை (মনোভাব) তৈরি করতে সাহায্য করেছিল, যা বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
  • ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ: হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং তাঁর অনুগামী ছাত্ররা (নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী) এই কলেজকে কেন্দ্র করেই তাঁদের প্রগতিশীল ও সংস্কারপন্থী কার্যকলাপ পরিচালনা করেছিলেন ।
  • কৃতি ছাত্র তৈরি: হিন্দু কলেজ বহু কৃতি ছাত্র তৈরি করেছিল, যাঁরা পরবর্তীকালে বাংলার তথা ভারতের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ডিরোজিওর শিষ্যবর্গ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ।

উপসংহার: উনিশ শতকে বাংলায় আধুনিক উচ্চশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন, প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রসার এবং বহু মনীষীর জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দু কলেজের অবদান ছিল অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী।

প্রশ্ন ২৫: লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি ও ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯০৪) কীভাবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রভাবিত করেছিল? 📜🎓

উত্তর: ভূমিকা: বড়লাট লর্ড কার্জন (১৮৯৯-১৯০৫) ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার, বিশেষত উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাঁর এই শিক্ষানীতির একটি প্রধান দিক ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা, যা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কেও প্রভাবিত করেছিল।

কার্জনের শিক্ষানীতি ও বিশ্ববিদ্যালয় আইন (১৯০৪):

  • র‍্যালে কমিশন (১৯০২): কার্জন ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস র‍্যালের নেতৃত্বে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করেন । এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতেই ‘ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ (১৯০৪) পাস হয় ।
  • আইনের প্রধান দিক:
    • সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি: এই আইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সেনেট ও সিন্ডিকেটের ওপর সরকারি মনোনয়ন বৃদ্ধি করা হয় এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হয়।
    • অধিভুক্ত কলেজের ওপর নিয়ন্ত্রণ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অধিভুক্ত (affiliated) কলেজগুলির ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়।
    • শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণায় গুরুত্ব: আইনটিতে শিক্ষার মান উন্নয়ন, পঠনপাঠনের উন্নতি এবং গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপের কথাও বলা হয় ।
  • কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আইনের প্রভাব:
    • প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া: এই আইন পাস হওয়ার পর আশঙ্কা করা হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের অধিকার খর্ব হবে।
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা: এই সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের মুখেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন । তিনি এই আইনের সুযোগ নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু নতুন বিভাগ খোলেন, গবেষণার ওপর জোর দেন এবং এটিকে একটি প্রথম শ্রেণির শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত করেন ।

উপসংহার: লর্ড কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয় আইন একদিকে যেমন সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেছিল, তেমনই অন্যদিকে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই আইনের কাঠামোর মধ্যেই শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হয়েছিল।

📚 গ) ব্যাখ্যামূলক উত্তর ভিত্তিক প্রশ্ন (Explanatory – প্রতিটি ৮ নম্বর) Madhyamik History Chapter 2 Question Answer

প্রশ্ন ১: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের প্রেক্ষাপট কী ছিল? এই শিক্ষাবিস্তারে সরকারি উদ্যোগ এবং বিভিন্ন দেশীয় ও বিদেশি ব্যক্তিগত উদ্যোগের ভূমিকা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করো। এর ফলাফল কী হয়েছিল? (৩+৫)

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা, যা বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও মনন জগতে গভীর ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিল। এই শিক্ষার প্রসারের পেছনে ছিল এক জটিল প্রেক্ষাপট এবং সরকারি ও বেসরকারি স্তরে বহুবিধ উদ্যোগ।

শিক্ষাবিস্তারের প্রেক্ষাপট:

  • ব্রিটিশ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক প্রয়োজন: ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও প্রশাসন বিস্তারের সাথে সাথে ইংরেজি জানা কেরানি ও কর্মচারীর প্রয়োজন বৃদ্ধি পায় । কম খরচে এই চাহিদা মেটানো ছিল সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য।
  • খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ: খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে মিশনারিরা এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে আগ্রহী ছিল । তারা মনে করত, শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়দের কুসংস্কার দূর করে ধর্মান্তরিত করা সহজ হবে।
  • ভারতীয় মনীষীদের আকাঙ্ক্ষা: রাজা রামমোহন রায়ের মতো ভারতীয় সমাজ সংস্কারকগণ উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের প্রগতি ও কুসংস্কারমুক্তির জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা অপরিহার্য ।
  • অর্থনৈতিক কারণ: ইংরেজি শিক্ষা লাভ করলে সরকারি চাকরি ও অন্যান্য পেশায় সুযোগ বাড়বে, এই আশায় মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকরাও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল ।

শিক্ষাবিস্তারে বিভিন্ন উদ্যোগ:

  1. সরকারি উদ্যোগ:
    • ১৮১৩ সালের সনদ আইন: এই আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দের নির্দেশ দেওয়া হয় ।
    • সাধারণ জনশিক্ষা কমিটি (GCPI, ১৮২৩): এই অর্থ কীভাবে ব্যয় হবে, তা নির্ধারণ এবং শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য এই কমিটি গঠিত হয় ।
    • প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্ব ও মেকলের মিনিট (১৮৩৫): শিক্ষার মাধ্যম ও বিষয়বস্তু নিয়ে প্রাচ্যবাদী (ঐতিহ্যগত ভারতীয় শিক্ষার সমর্থক) ও পাশ্চাত্যবাদীদের (ইংরেজি ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থক) মধ্যে তীব্র বিতর্ক হয় । এই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের প্রস্তাবের (মেকলে মিনিট) ভিত্তিতে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সরকারি নীতি ঘোষণা করেন । মেকলে ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র কথাও বলেন ।
    • লর্ড হার্ডিঞ্জের ঘোষণা (১৮৪৪): সরকারি চাকরিতে ইংরেজি জানা ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা করা হলে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পায় ।
    • উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪): স্যার চার্লস উডের এই নির্দেশনামা ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার নীলনকশা হিসেবে পরিচিত । এতে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সুসংহত শিক্ষাকাঠামো, মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, নারীশিক্ষা, সরকারি অনুদান ইত্যাদির সুপারিশ করা হয় ।
    • বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন: উডের ডেসপ্যাচের সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ।
    • হান্টার কমিশন (১৮৮২): প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা ও সুপারিশের জন্য এই কমিশন গঠিত হয় ।
  2. বেসরকারি ও মিশনারি উদ্যোগ:
    • খ্রিস্টান মিশনারি: শ্রীরামপুর ত্রয়ী (উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, ওয়ার্ড) ব্যাপ্টিস্ট মিশন (১৮০০) ও শ্রীরামপুর কলেজ (১৮১৮) প্রতিষ্ঠা করেন এবং বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন । আলেকজান্ডার ডাফ প্রতিষ্ঠা করেন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন (১৮৩০) (পরে স্কটিশ চার্চ কলেজ) । লন্ডন মিশনারি সোসাইটি (রবার্ট মে), চার্চ মিশনারি সোসাইটি প্রভৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
    • ভারতীয় বিদ্যোৎসাহী: রাজা রামমোহন রায় অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল (১৮১৫/২২) ও বেদান্ত কলেজ (১৮২৬) প্রতিষ্ঠা করেন । ডেভিড হেয়ার হিন্দু কলেজ (১৮১৭) প্রতিষ্ঠায় প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন এবং পটলডাঙ্গা অ্যাকাডেমি (হেয়ার স্কুল) ও ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭) প্রতিষ্ঠা করেন । রাজা রাধাকান্ত দেব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখও শিক্ষাবিস্তারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
    • নারীশিক্ষায় উদ্যোগ: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বেথুন স্কুল, ১৮৪৯ ) প্রমুখ নারীশিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন ।

ফলাফল ও প্রভাব:

  • নবজাগরণের সূচনা: পাশ্চাত্য শিক্ষা ও ভাবধারার সংস্পর্শে বাংলায় এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়, যা সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে ।
  • আধুনিক চেতনার উন্মেষ: যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, জাতীয়তাবোধ ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটে ।
  • মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান: ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়, যারা পরবর্তীকালে ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনে নেতৃত্ব দেয় ।
  • সামাজিক কুসংস্কারের বিরোধিতা: সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহের মতো সামাজিক কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ও সংস্কার আন্দোলন গতি লাভ করে ।
  • সীমাবদ্ধতা: তবে এই শিক্ষা মূলত শহরকেন্দ্রিক ও উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । সাধারণ মানুষ ও গ্রামীণ জনতা এর সুফল সেভাবে পায়নি। মাতৃভাষার তুলনায় ইংরেজিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার ভিত ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বল থেকে যায়। ব্রিটিশদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করা ।

উপসংহার: উনিশ শতকে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার বহু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক নবযুগের সূচনা করেছিল। এটি শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনের পথই প্রশস্ত করেনি, বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকেও জাগ্রত করেছিল এবং আধুনিক ভারত গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।

প্রশ্ন ২: শিক্ষাবিস্তারে প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক কী ছিল? এই বিতর্কে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের ভূমিকা এবং এর চূড়ান্ত পরিণতি ও প্রভাব আলোচনা করো। (৩+৩+২)

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় শিক্ষার মাধ্যম, বিষয়বস্তু এবং লক্ষ্য নিয়ে এক তীব্র বিতর্ক দেখা দেয়, যা ইতিহাসে ‘প্রাচ্য-পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব’ নামে পরিচিত ।

প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক:

  • প্রেক্ষাপট: ১৮১৩ সালের সনদ আইনে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হলে, সেই অর্থ প্রাচ্যদেশীয়传统 (ঐতিহ্যপূর্ণ) বিদ্যাচর্চায় ব্যয় হবে, নাকি আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ব্যয় হবে—এই নিয়ে ‘সাধারণ জনশিক্ষা কমিটি’র (১৮২৩) সদস্যদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় ।
  • প্রাচ্যবাদী (Orientalists): এইচ. টি. প্রিন্সেপ, এইচ. এইচ. উইলসন, কোলব্রুক প্রমুখ প্রাচ্যবাদীরা ভারতে সংস্কৃত, আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, দর্শন ও আইন চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন । তাঁরা মনে করতেন, এর মাধ্যমেই ভারতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রকৃত জ্ঞানচর্চা সম্ভব।
  • পাশ্চাত্যবাদী (Anglicists): টমাস ব্যাবিংটন মেকলে, আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদীরা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য, দর্শন এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা শিক্ষার সপক্ষে মত দেন । তাঁদের মতে, প্রাচ্যদেশীয় জ্ঞান পুরনো ও অবৈজ্ঞানিক, এবং ভারতের অগ্রগতির জন্য পাশ্চাত্য জ্ঞান অপরিহার্য। রাজা রামমোহন রায়ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবল সমর্থক ছিলেন এবং এই মর্মে লর্ড আমহার্স্টকে চিঠিও লিখেছিলেন ।

মেকলের ভূমিকা:

  • তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইন সচিব এবং জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি টমাস ব্যাবিংটন মেকলে এই বিতর্কে পাশ্চাত্যবাদীদের পক্ষে এক নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেন ।
  • ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘মিনিট’ বা প্রস্তাব পেশ করেন, যেখানে তিনি প্রাচ্য শিক্ষাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন ।
  • তিনি বলেন, “একটি ভালো ইউরোপীয় গ্রন্থাগারের একটিমাত্র তাক ভারত ও আরবের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ” ।
  • মেকলে ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র (Downward Filtration Theory) অবতারণা করেন, যার মূল কথা ছিল উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা দিলে তা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে ।
  • তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন এক ভারতীয় শ্রেণি তৈরি করা, যারা “রক্তে ও বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি, মত, নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ” ।

চূড়ান্ত পরিণতি ও প্রভাব:

  • মেকলের জোরালো যুক্তির প্রভাবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালের ৭ই মার্চ এক নির্দেশ জারি করে ঘোষণা করেন যে, ভারতে সরকারি শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য হবে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ঘটানো । এর ফলে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দ্বন্দ্বের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে এবং পাশ্চাত্যবাদীরা জয়ী হন।
  • প্রভাব:
    • ভারতে সরকারি উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের পথ সুগম হয় ।
    • কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫), বোম্বাই-এ এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন (১৮৩৫), এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য পাশ্চাত্য ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
    • ইংরেজি শিক্ষিত এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়, যারা সামাজিক সংস্কার ও পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
    • তবে, দেশীয় ভাষা ও ঐতিহ্যগত জ্ঞানচর্চা অবহেলিত হয় এবং শিক্ষা মূলত শহরকেন্দ্রিক ও উচ্চবর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

উপসংহার: প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্ক এবং মেকলের ভূমিকা ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার গতিপথ নির্ধারণে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এর ফলে ভারত আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এলেও, ঔপনিবেশিক স্বার্থই ছিল এই শিক্ষানীতির মূল চালিকাশক্তি।

প্রশ্ন ৩: উনিশ শতকে বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান বিস্তারিতভাবে আলোচনা করো। এই উদ্যোগগুলির সীমাবদ্ধতা কী ছিল? (৫+৩)

উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের বাংলায় সামাজিক নবজাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল নারীশিক্ষার প্রসার। তৎকালীন সমাজে নারীরা নানা বিধিনিষেধ ও কুসংস্কারের শিকার ছিলেন এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু ইউরোপীয় মিশনারি, ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং প্রধানত ভারতীয় সমাজ সংস্কারকদের উদ্যোগে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

নারীশিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ:

  1. খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রাথমিক প্রচেষ্টা:
    • বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে প্রথম উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনের উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ৪০ জন বালিকাকে নিয়ে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন ।
    • লন্ডন মিশনারি সোসাইটির রবার্ট মে ১৮১৮ সালে চুঁচুড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন ।
    • মিসেস কুক, মেরি উইলসন, মেরি কার্পেন্টার প্রমুখ বিদেশিনী মহিলারাও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং বিভিন্ন সোসাইটির (যেমন: ক্যালকাটা ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি, ১৮১৯ ) মাধ্যমে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ধর্মপ্রচার হলেও, নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
  2. বেসরকারি ভারতীয় উদ্যোগ:
    • রাজা রাধাকান্ত দেব ব্যক্তিগতভাবে নারীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন এবং ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, নারীশিক্ষা হিন্দু শাস্ত্রবিরোধী নয় । তবে তিনি মূলত মেয়েদের গৃহশিক্ষার পক্ষপাতী ছিলেন ।
    • তরুণ ডিরোজিয়ান বা ‘নব্যবঙ্গ’ গোষ্ঠীও নারীশিক্ষার সমর্থনে সোচ্চার হয়েছিল।
  3. বেথুন সাহেবের উদ্যোগ:
    • বাংলার নারীশিক্ষার ইতিহাসে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (বেথুন সাহেব) এক স্মরণীয় নাম। তিনি ছিলেন গভর্নর জেনারেলের আইন সচিব এবং শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি ।
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সহযোগিতায় তিনি ১৮৪৯ সালের ৭ই মে কলকাতায় ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে ‘বেথুন স্কুল’ নামে পরিচিত । এটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক পদ্ধতিতে পরিচালিত প্রথম উল্লেখযোগ্য বালিকা বিদ্যালয়।
    • বেথুন সাহেব তাঁর সমস্ত সম্পত্তি এই বিদ্যালয়ের জন্য দান করে যান । পরবর্তীকালে এই স্কুল থেকেই বেথুন কলেজের সূচনা হয় (১৮৭৮), যা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহিলা কলেজ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান: নারীশিক্ষার প্রসারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) অবদান ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী।

  • দৃষ্টিভঙ্গি: বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমাজের প্রকৃত উন্নতি নারীজাতির উন্নতি ছাড়া সম্ভব নয় এবং শিক্ষার মাধ্যমেই নারীরা সমাজে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করতে পারে ।
  • বেথুন স্কুলের সাথে সক্রিয়তা: তিনি বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় সহযোগিতা করেন এবং দীর্ঘদিন এর সম্পাদক হিসেবে বিদ্যালয়টির উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ।
  • ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপন: তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ১৮৫৭-৫৮ সালের মধ্যে নিজ উদ্যোগে এবং সরকারি সহায়তায় বাংলার বিভিন্ন জেলায় (হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর, নদিয়া) প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে প্রায় ১৩০০ ছাত্রী পড়াশোনা করত । এই বিদ্যালয়গুলির বেশিরভাগই তিনি নিজ খরচে চালাতেন।
  • পাঠ্যপুস্তক রচনা: তিনি শিশুদের উপযোগী ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’ ইত্যাদি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে সহায়ক হয়েছিল ।
  • বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যালয়: জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিজ গ্রাম বীরসিংহে মায়ের নামে ‘ভগবতী বালিকা বিদ্যালয়’ (১৮৯০) প্রতিষ্ঠা করেন ।

উদ্যোগগুলির সীমাবদ্ধতা:

  • সামাজিক বিরোধিতা: তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলিম সমাজ নারীশিক্ষার তীব্র বিরোধী ছিল। তারা মনে করত, মেয়েরা পড়াশোনা শিখলে অকল্যাণ হবে বা বিধবা হবে।
  • বাল্যবিবাহ ও পর্দাপ্রথা: বাল্যবিবাহ ও কঠোর পর্দাপ্রথার কারণে মেয়েদের পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া বা শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল ।
  • সরকারি উদাসীনতা: সরকার নারীশিক্ষার বিষয়ে প্রথমদিকে তেমন উৎসাহ দেখায়নি এবং আর্থিক সাহায্যও ছিল অপ্রতুল।
  • শহরকেন্দ্রিকতা: নারীশিক্ষার উদ্যোগগুলি মূলত কলকাতা ও কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; গ্রামী হবেনালে এর প্রভাব কম ছিল।
  • শিক্ষিত নারীর অভাব: শিক্ষিকার অভাবও নারীশিক্ষার প্রসারে একটি বড় বাধা ছিল।

উপসংহার: বহু প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, উনিশ শতকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং বিশেষত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলায় নারীশিক্ষার যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে নারী প্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সমাজ ও ধর্ম সংস্কারের খুঁটিনাটি জানো? প্রশ্নোত্তর পর্ব

উনিশ শতকের বাংলার সমাজ ও ধর্মীয় জীবনের আমূল পরিবর্তনগুলি থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর তৈরি আছে। এখনই তোমার প্রস্তুতি যাচাই করে নাও!

Bengal Renaissance: বিতর্ক ও বিশ্লেষণ – সম্পূর্ণ প্রশ্নোত্তর!

বাংলার নবজাগরণের চরিত্র, সাফল্য, সীমাবদ্ধতা ও ঐতিহাসিক বিতর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা। পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন ও উত্তর দেখে নাও।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি যাচাই! মক টেস্ট দাও এখনই!

মাধ্যমিক ইতিহাসের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১ নম্বরের বহু বিকল্পভিত্তিক প্রশ্ন (MCQ) এবং সত্য/মিথ্যা (ঠিক/ভুল) প্রশ্ন দিয়ে সাজানো এই মক টেস্ট। নিজের প্রস্তুতি যাচাই করে নাও!

error: Content is protected !!
Scroll to Top