
প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ | Madhyamik History Chapter 3 Notes
📜 অধ্যায়ের মূল বিষয় (Madhyamik History Chapter 3 Notes): এই অধ্যায়ে তুমি জানবে কিভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে ভারতের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষক ও আদিবাসী সম্প্রদায়, কোম্পানির বিভিন্ন শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম একশো বছরে শতাধিক এমন আন্দোলন হয়েছিল। এই সব প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এগুলিই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মজবুত ভিত্তি তৈরি করেছিল।
💡 কিছু জরুরি ধারণা:
- বিদ্রোহ (Rebellion): কোনো প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থেকে জন্ম নেওয়া প্রতিবাদ বা বিরোধিতা, যা সশস্ত্র বা নিরস্ত্র উভয়ই হতে পারে। যেমন – কোল বিদ্রোহ, সাঁওতাল হুল।
- অভ্যুত্থান (Coup/Uprising): সাধারণত আকস্মিকভাবে এবং প্রায়শই সশস্ত্রভাবে কোনো শাসক বা সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রচেষ্টা।
- বিপ্লব (Revolution): সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রচলিত ব্যবস্থার আমূল, অর্থাৎ মৌলিক ও ব্যাপক পরিবর্তন। যেমন – ফরাসি বিপ্লব।
🌳 ১. ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন ও আদিবাসী জনগণের প্রতিক্রিয়া

ভারতের বিশাল অরণ্যভূমি ছিল সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনরেখা। তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জঙ্গলের কাঠ, ফলমূল ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার করে এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করে জীবন চালাত। এই অরণ্যকে তারা নিজেদের সম্পত্তি মনে করত এবং এর জন্য কোনো রাজস্ব দিত না।
কিন্তু, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে।
📜 ঔপনিবেশিক অরণ্য আইনের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য: প্রথমে কোম্পানি অরণ্য নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও, ক্রমেই বিভিন্ন কারণে তারা অরণ্যের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়:
- 🚂 রেলের স্লিপার তৈরির জন্য উন্নত মানের কাঠের চাহিদা বৃদ্ধি।
- 🚢 জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য কাঠের প্রয়োজন।
- 💰 রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা।
- (ব্যবসা) অরণ্যজাত সম্পদ বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করা।
এই উদ্দেশ্যগুলি পূরণের জন্য ব্রিটিশ সরকার একাধিক পদক্ষেপ নেয়:
- ডিয়েট্রিক ব্রান্ডিস: জার্মানির বন বিশেষজ্ঞ ডিয়েট্রিক ব্রান্ডিসকে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ ফরেস্ট পদে নিয়োগ করা হয়।
- ভারতীয় বন বিভাগ গঠন: ব্রান্ডিসের প্রচেষ্টায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- প্রথম অরণ্য আইন (১৮৬৫): এই আইনের মাধ্যমে অরণ্যের ওপর কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অরণ্যবাসী আদিবাসীদের অধিকার সীমিত করা হয়।
- দ্বিতীয় অরণ্য আইন (১৮৭৮): এই আইন আরও কঠোর ছিল। এর মাধ্যমে অরণ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়:
- সংরক্ষিত অরণ্য (Reserved Forest)
- সুরক্ষিত অরণ্য (Protected Forest)
- গ্রামীণ অরণ্য (Village Forest) এই বিভাজন অরণ্যের ওপর ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বকে আরও দৃঢ় করে।
🌲 আদিবাসী জীবনে অরণ্য আইনের প্রভাব:
- ঐতিহ্যগত অধিকারে হস্তক্ষেপ: আদিবাসীরা তাদের দীর্ঘদিনের অরণ্য ব্যবহারের অধিকার হারায়।
- জীবিকায় আঘাত: ঝুম চাষের (স্থানান্তর কৃষি) মতো पारंपरिक (ঐতিহ্যগত) চাষাবাদ পদ্ধতি বাধা পায়। ফলমূল সংগ্রহ, শিকার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
- রাজস্বের বোঝা: যে জমি তারা এতদিন বিনামূল্যে ভোগ করত, তার জন্য কর দিতে বাধ্য করা হয়।
- বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ: ‘দিকু’ (বহিরাগত মহাজন, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার) দের দাপট বাড়ে, যারা আদিবাসীদের শোষণ করত।
✊ আদিবাসী প্রতিক্রিয়া: বিভিন্ন প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন এবং ব্রিটিশ শোষণ আদিবাসী সম্প্রদায়কে বিদ্রোহী করে তোলে। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনগুলি ছিল নিজেদের অধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রাম।


ক) চুয়ার বিদ্রোহ (দ্বিতীয় পর্ব, ১৭৯৮-৯৯) Madhyamik History Chapter 3 Notes
- এলাকা: মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও ধলভূম। এটি ছিল বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আদিবাসী বিদ্রোহ।
- কারা এই চুয়ার: এরা মূলত কৃষিকাজ, পশুপালন ও শিকার করত। স্থানীয় জমিদারদের অধীনে তারা পাইক বা রক্ষীর কাজ করত এবং বিনিময়ে নিষ্কর জমি ভোগ করত (যা ‘পাইকান জমি’ নামে পরিচিত ছিল)।
- বিদ্রোহের কারণ:
- পাইকান জমির অধিকার হারানো।
- জমির ওপর উচ্চহারে খাজনা আরোপ।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে পুরোনো জমিদারদের জমিদারি হারানো, যার প্রভাব চুয়ারদের ওপর পড়েছিল।
- নেতৃত্ব: দুর্জন সিংহ, রানি শিরোমণি। গোবর্ধন দিকপতি, মাধব সিংহ, লাল সিংহ প্রমুখ।
- গুরুত্ব ও ফলাফল:
- বিদ্রোহীরা সরকারি প্রশাসন প্রায় অচল করে দিয়েছিল।
- ব্রিটিশ সরকার কঠোর দমননীতি নিলেও, এই বিদ্রোহের ফলে তারা আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের ভূমিরাজস্ব নির্ধারণে কিছুটা সতর্ক হয়।
- বিদ্রোহী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে নিয়ে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ‘জঙ্গলমহল’ নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করা হয়।
খ) কোল বিদ্রোহ (১৮৩১-৩২) Madhyamik History Chapter 3 Notes
- এলাকা: ছোটনাগপুর, সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ।
- কোল কারা: এরা স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল এবং নিজেদের সর্দারের অধীনে চাষাবাদ করত।
- বিদ্রোহের কারণ:
- জমি থেকে উচ্ছেদ ও ঐতিহ্যগত অধিকারে হস্তক্ষেপ।
- অরণ্য সম্পদ ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা।
- ভূমিরাজস্বের হার বৃদ্ধি ও তা আদায়ে অত্যাচার।
- বহিরাগত ‘দিকু’ (মহাজন, ব্যবসায়ী) দ্বারা শোষণ ও অত্যাচার।
- তাদের নিজস্ব প্রাচীন শাসন ও বিচারব্যবস্থার বদলে কোম্পানির আইন চালু করা।
- জোর করে বেগার শ্রম ও আফিম চাষে বাধ্য করা।
- নেতৃত্ব: বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, ঝিন্দরাই মানকি, সুই মুন্ডা।
- গুরুত্ব ও ফলাফল:
- কোল বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করা হলেও, ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়।
- ছোটনাগপুর অঞ্চলে ‘দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি’ নামে একটি নতুন প্রশাসনিক অঞ্চল তৈরি করা হয়।
- আদিবাসীদের জন্য কিছু স্বতন্ত্র আইন চালু করা হয় এবং জমি জরিপের মাধ্যমে ভূমিবণ্টন ও রাজস্ব ব্যবস্থা নতুন করে সাজানো হয়।
গ) সাঁওতাল ‘হুল’ (বিদ্রোহ) (১৮৫৫-৫৬) Madhyamik History Chapter 3 Notes
- এলাকা: রাজমহল পার্বত্য অঞ্চল, বিশেষত ‘দামিন-ই-কোহ’ (পাহাড়ের প্রান্তদেশ)।
- সাঁওতাল কারা: এরা অত্যন্ত পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু উপজাতি ছিল, যাদের বেশিরভাগই কৃষিজীবী। তারা বিশ্বাস করত, যে জমি প্রথম চাষ করবে, জমির অধিকার তারই।
- বিদ্রোহের কারণ:
- জমিদারদের দ্বারা জমি দখল ও বিভিন্নভাবে প্রতারণা।
- কোম্পানির চাপানো অত্যধিক ভূমিরাজস্ব, যা নগদে দিতে হত।
- মহাজনদের শোষণ: চড়া সুদের হারে (৫০% থেকে ৫০০% পর্যন্ত) ঋণ নিতে বাধ্য হওয়া এবং ক্রমে জমি হারানো।
- ব্যবসায়ীদের দ্বারা ওজনে কারচুপি: কেনার সময় বেশি ওজনের বাটখারা (‘কেনারাম’) এবং বিক্রির সময় কম ওজনের বাটখারা (‘বেচারাম’) ব্যবহার করে ঠকানো।
- নীলকর, রেললাইনের ঠিকাদার ও থানার দারোগাদের অত্যাচার ও জুলুম।
- সাঁওতাল নারীদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ ও ধর্মান্তরের চেষ্টা।
- নেতৃত্ব: সিধু ও কানহু। এছাড়াও চাঁদ, ভৈরব, ডোমন মাঝি, বীরসিংহ মাঝি, কালো প্রামাণিক।
- ঘটনাপ্রবাহ: ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন ভাগনাডিহির মাঠে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল একত্রিত হয়ে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ‘হুল’ বা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
- গুরুত্ব ও ফলাফল:
- বিদ্রোহ অত্যন্ত হিংস্রভাবে দমন করা হয়; প্রায় ২৩ হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয় এবং সিধু ও কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
- সাঁওতালদের জন্য ‘সাঁওতাল পরগনা’ নামে একটি পৃথক জেলা গঠন করা হয়।
- সাঁওতালদের ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ঘোষণা করা হয় যে সাঁওতাল পরগনায় ব্রিটিশ আইন সরাসরি কার্যকর হবে না। (তবে জমির খাজনা কমানো হয়নি বা জমির অধিকার পুরোপুরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। )
- ৩০শে জুন দিনটি বর্তমানে ‘হুল দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
ঘ) মুন্ডা ‘উলগুলান’ (ভয়ংকর বিশৃঙ্খলা) (১৮৯৯-১৯০০) Madhyamik History Chapter 3 Notes
- এলাকা: বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচি ও সিংভূম অঞ্চল।
- বিদ্রোহের কারণ:
- মুন্ডাদের চিরাচরিত যৌথ কৃষি ব্যবস্থা বা ‘খুঁৎকাঠি’ (জমির যৌথ মালিকানা) প্রথার অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা চালু করা।
- বহিরাগত ‘দিকু’ (জমিদার, মহাজন, ঠিকাদার) দ্বারা মুন্ডাদের জমি হস্তগত করা।
- মুন্ডাদের নিজস্ব আইন, বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন।
- জমিদারদের জমিতে বেগার শ্রম বা ‘বেট বেগারি’ দিতে বাধ্য করা।
- নেতৃত্ব: বিরসা মুন্ডা। তিনি মুন্ডাদের কাছে ‘ধরতি আবা’ ( পৃথিবীর পিতা) এবং ভগবান রূপে পূজিত হতেন। তাঁর উপাস্য দেবতা ছিলেন ‘সিং বোঙা’ (সূর্য দেবতা)। বিরসা মুন্ডার লক্ষ্য ছিল স্বাধীন মুন্ডা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
- গুরুত্ব ও ফলাফল:
- এই বিদ্রোহও কঠোরভাবে দমন করা হয়। বিরসা মুন্ডা বন্দি হন এবং রাঁচি জেলে মাত্র ২৫ বছর বয়সে কলেরায় তাঁর মৃত্যু হয় (৯ জুন, ১৯০০)।
- এই বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ সরকার আদিবাসী সমস্যা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়।
- ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন’ পাস করা হয়, যার মাধ্যমে মুন্ডাদের ‘খুঁৎকাঠি’ প্রথাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ ও বেগার শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
- বিরসা মুন্ডা হলেন একমাত্র আদিবাসী নেতা যাঁর ছবি ভারতীয় সংসদের মূল কক্ষে রাখা আছে।

🕌 ২. সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, বাংলায় ওয়াহাবি ও ফরাজি আন্দোলন
এই পর্যায়ে তুমি জানবে এমন কিছু গণআন্দোলন সম্পর্কে যেগুলিতে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট থাকলেও, আদতে সেগুলি ছিল ঔপনিবেশিক শোষণ ও তার সহযোগী দেশীয় জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ।
ক) সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০) Madhyamik History Chapter 3 Notes
বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক পর্বে এই বিদ্রোহ প্রায় চার দশক ধরে চলেছিল।
- বিদ্রোহের কারণ:
- তীর্থযাত্রার ওপর কর: মোগল আমলের শেষ দিক থেকে আগত ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসী (হিন্দু) ও ফকির (মুসলিম) সম্প্রদায়ের তীর্থযাত্রার ওপর ব্রিটিশরা উচ্চহারে কর আরোপ করে।
- ভূমি রাজস্ব: বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করা এবং কৃষিকাজ করা সন্ন্যাসী-ফকিরদের ওপর অত্যধিক ভূমিরাজস্ব চাপানো হয়।
- ব্যবসা-বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ ও শোষণ।
- ধর্মীয় স্থানে (যেমন দরগা) প্রবেশে বাধা।
- এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিল কর্মচ্যুত মোগল সৈনিক, শোষিত কৃষক ও কারিগর শ্রেণি।
- বিস্তার: ঢাকা থেকে শুরু হয়ে এই বিদ্রোহ কোচবিহার, বগুড়া, মালদহ, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
- নেতৃত্ব: ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, মজনু শাহ, চিরাগ আলি, মুসা শাহ প্রমুখ।
- আন্দোলনের প্রকৃতি: বিদ্রোহীরা কোম্পানির কুঠি, রাজস্ব দপ্তর, জমিদারদের কাছারি আক্রমণ ও লুঠ করত এবং রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
- ব্যর্থতার কারণ: সাংগঠনিক দুর্বলতা, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব, উন্নত ব্রিটিশ অস্ত্রশস্ত্র ও রণকৌশল।
- গুরুত্ব:
- ওয়ারেন হেস্টিংস এই বিদ্রোহকে ‘পেশাদার ডাকাতদের উপদ্রব’ বললেও, এটি ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের প্রসারে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে এই বিদ্রোহের ছায়া লক্ষ্য করা যায়।
খ) বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (বারাসাত বিদ্রোহ বা তিতুমিরের বিদ্রোহ, ১৮৩০-৩১) Madhyamik History Chapter 3 Notes
- আদর্শগত প্রেক্ষাপট: আরবের আব্দুল ওয়াহাব এবং দিল্লির সন্ত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও তাঁর পুত্র আব্দুল আজিজের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ভারতে এর প্রসার ঘটান সৈয়দ আহমদ বেরেলভি। ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ ‘নবজাগরণ’। মূল লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মের শুদ্ধিকরণ এবং ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) থেকে মুক্ত করে ‘দার-উল-ইসলাম’ (ইসলামের দেশ) প্রতিষ্ঠা করা।
- বাংলায় নেতৃত্ব: মীর নিসার আলি বা তিতুমির।
- আন্দোলনের চরিত্র পরিবর্তন: ইসলাম ধর্মের সংস্কারের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও, অচিরেই এই আন্দোলন অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দরিদ্র কৃষক ও তাঁতিদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদে পরিণত হয়। বহু নিম্নবর্ণের হিন্দুও এই আন্দোলনে যোগ দেন।
- বিস্তার: ২৪ পরগনা, নদিয়া, যশোহর, মালদহ, ঢাকা, রাজশাহি প্রভৃতি অঞ্চলে।
- গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা:
- তিতুমির নিজেকে ‘বাদশাহ’ ঘোষণা করেন এবং বারাসতের নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বিখ্যাত বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন, যা ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। মইনুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী ও গোলাম মাসুমকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন।
- পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের মতো অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম শুরু হয়।
- পতন: ১৮৩১ সালের ১৯শে নভেম্বর ব্রিটিশ বাহিনীর গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লার পতন ঘটে এবং তিতুমির ও তাঁর বহু অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
- গুরুত্ব:
- ধর্মীয় আবরণ থাকলেও, এটি মূলত ছিল কৃষক ও নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।
- এই বিদ্রোহ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নিদর্শন দেখিয়েছিল এবং ভবিষ্যতের কৃষক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল।


গ) ফরাজি আন্দোলন (১৮২০-১৮৬০ এর দশক পর্যন্ত) Madhyamik History Chapter 3 Notes
- ‘ফরাজি’ শব্দের অর্থ: আরবি ‘ফরাইজ’ শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ ‘ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’।
- প্রতিষ্ঠাতা ও আদর্শ: ফরিদপুরের হাজি শরিযতউল্লাহ। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের সংস্কার, সামাজিক কুসংস্কার দূর করা এবং ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষকে ‘দার-উল-হারব’ ঘোষণা করে ব্রিটিশ শোষণমুক্ত করা।
- দুদু মিঞার (মহম্মদ মহসিন) ভূমিকা: শরিযতউল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দুদু মিঞা এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করেন।
- তিনি ঘোষণা করেন, “জমির মালিক আল্লাহ্”, সুতরাং জমিদারদের খাজনা আদায়ের কোনো অধিকার নেই।
- তিনি কৃষকদের জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করতে সঙ্ঘবদ্ধ করেন এবং একটি নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করেন।
- আন্দোলন পরিচালনার জন্য তিনি বাংলাকে কয়েকটি ‘হল্কা’ (অঞ্চল)-য় ভাগ করে প্রতিটি অঞ্চলের দায়িত্ব একজন করে খলিফার হাতে দেন (ফরাজি খিলাফততন্ত্র)।
- বিস্তার: ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, যশোহর, খুলনা, পাবনা প্রভৃতি অঞ্চলে এই আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
- ব্যর্থতার কারণ: দুদু মিঞার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাব (তাঁর পুত্র নোয়ামিঞা আন্দোলনকে মূলত ধর্মীয় দিকে চালিত করেন), সাংগঠনিক দুর্বলতা, এবং ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি।
- গুরুত্ব:
- এই আন্দোলন কৃষকদের মধ্যে নতুন চেতনার সঞ্চার করে এবং জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে।
- ধর্মীয় আঙ্গিকে শুরু হলেও, এটি মূলত ছিল কৃষক শ্রেণির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বহু হিন্দু কৃষকও এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন এবং ফরাজি আন্দোলনের মধ্যেকার মূল সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি (Madhyamik History Chapter 3 Notes)
তুলনার বিষয় 📜 | 🕉️☪️ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ | ⚔️ বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (বারাসাত বিদ্রোহ) | ☪️ ফরাজি আন্দোলন |
---|---|---|---|
🕰️ সময়কাল | প্রায় ১৭৬৩ – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ (প্রায় ৪০ বছর স্থায়ী) | তিতুমিরের নেতৃত্বে প্রধানত ১৮৩০ – ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ | প্রায় ১৮২০ – ১৮৬০ এর দশক পর্যন্ত (দুদুমিঞার নেতৃত্বে চরম পর্যায়) |
🧑🤝🧑 প্রধান নেতা/নেতৃবৃন্দ | ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী, মজনু শাহ, চিরাগ আলি শাহ, মুসা শাহ প্রমুখ | বাংলায়: মীর নিসার আলি (তিতুমির) (ভারতে মূল প্রবর্তক: সৈয়দ আহমদ বেরেলভি) | হাজি শরিয়তউল্লাহ, তাঁর পুত্র দুদুমিঞা (মহম্মদ মহসিন), এবং পরে নোয়ামিঞা (আব্দুল গফুর) |
🎯 মূল দাবি/লক্ষ্য | • তীর্থযাত্রার ওপর কর লোপ ও অবাধ তীর্থের অধিকার • কৃষিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরদের ওপর অতিরিক্ত ভূমিরাজস্ব হ্রাস • ব্রিটিশ ও তাদের সহযোগী জমিদারদের শোষণ ও অত্যাচার বন্ধ করা | • প্রথমে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও কুসংস্কার দূর করা • ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ (শত্রুর দেশ) থেকে ‘দার-উল-ইসলাম’ (ইসলামের পবিত্রভূমি)-এ পরিণত করা • অত্যাচারী জমিদার ও নীলকরদের শোষণ থেকে দরিদ্র কৃষকদের মুক্তি | • ইসলামের শুদ্ধিকরণ ও ফরাইজ (অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) প্রতিষ্ঠা • ভারতবর্ষকে ‘দার-উল-হারব’ থেকে মুক্ত করা • জমিদার ও নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের অবসান • দুদুমিঞার ঘোষণা: “জমির মালিক আল্লাহ্” |
🙏💰 ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক দিক | • ধর্মীয়: তীর্থকর ও ধর্মীয় আচার-আচরণে বাধার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ • অর্থনৈতিক: প্রধানত কৃষক বিদ্রোহ; অতিরিক্ত ভূমিরাজস্ব ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরোধিতা | • ধর্মীয়: ইসলামের শুদ্ধিকরণের আদর্শে অনুপ্রাণিত • অর্থনৈতিক: দরিদ্র কৃষক ও তাঁতিদের জমিদার-নীলকরদের শোষণ থেকে রক্ষার সংগ্রাম; অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস | • ধর্মীয়: ইসলাম ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা ও সংস্কার; ফরাইজ পালন • অর্থনৈতিক: মূলত কৃষক ও নিম্নবর্গের (তাঁতি, কলু) মুসলমানদের জমিদার-নীলকরদের শোষণ থেকে মুক্তি; খাজনা না দেওয়ার ডাক |
⭐ পরিণতি/ফলাফল | • ব্রিটিশদের উন্নত রণকৌশল ও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে শেষপর্যন্ত ব্যর্থ • তবে, ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে • পরবর্তী কৃষক বিদ্রোহের প্রেরণা জোগায় • বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে (‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’) এর প্রভাব দেখা যায় | • বারাসাতের নারকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লা ব্রিটিশ গোলার আঘাতে ধ্বংস হয় (১৮৩১) • তিতুমির ও তাঁর বহু অনুগামী যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন • আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও, অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে • ভবিষ্যৎ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রেরণা জোগায় | • দুদুমিঞার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এবং নোয়ামিঞার আমলে আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় • সাংগঠনিক দুর্বলতা ও ধর্মীয় সংকীর্ণতাও পতনের কারণ ছিল • কৃষকদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল |
💙 ৩. নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬০) (Madhyamik History Chapter 3 Notes)
উনিশ শতকের বাংলায় যত কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, তার মধ্যে নীল বিদ্রোহ ছিল সবচেয়ে ব্যাপক, সংগঠিত এবং সফল একটি গণ-আন্দোলন।
📜 নীল চাষের প্রেক্ষাপট:
- রাসায়নিক নীল আবিষ্কারের আগে, বস্ত্র রঙ করার জন্য প্রাকৃতিক নীলের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
- বাংলায় নীল চাষের সূচনা করেন ফরাসি বণিক লুই বোনার্ড (সাল নিয়ে বিভিন্ন বইতে তথ্যপার্থক্য আছে, তবে ১৭৭৭ নাগাদ)। কার্ল ব্ল্যাম নামে এক ব্রিটিশ বণিক প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করে নীল ব্যবসা শুরু করেন।
- বাংলার মাটি ও জলবায়ু উৎকৃষ্ট মানের নীল চাষের জন্য উপযুক্ত হওয়ায়, এখানে নীলের চাষ দ্রুত প্রসার লাভ করে। ১৮৩০ সাল নাগাদ বাংলায় প্রায় এক হাজার নীলকুঠি গড়ে উঠেছিল।
नीलকরদের শোষণ ও অত্যাচারের পদ্ধতি: নীলকর সাহেবরা (বেশিরভাগই ইউরোপীয়) অধিক মুনাফার লোভে বাংলার গরিব চাষিদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালাত:
- 😨 জোর করে নীল চাষে বাধ্য করা: চাষিরা তাদের উর্বর জমিতে ধান বা অন্যান্য খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীল চাষ করতে বাধ্য হত। এতে খাদ্য সংকট দেখা দিত।
- 💰 দাদন প্রথা: চাষিদের বিঘাপ্রতি অতি সামান্য টাকা (যেমন, ২ টাকা) অগ্রিম বা ‘দাদন’ নিতে বাধ্য করা হত। একবার দাদন নিলে সেই ঋণ আর শোধ হত না, এবং চাষিরা নীলকরদের ক্রীতদাসে পরিণত হত। দাদন না নিলে তাদের গরু-বাছুর কেড়ে নেওয়া বা আটকে রাখা হত।
- 📏 জমির মাপে কারচুপি: নীলকররা জমির মাপের সময় চাষিদের ঠকাতো; যেমন, আড়াই বিঘাকে এক বিঘা দেখানো হত।
- 📉 অলাভজনক চাষ: নীল চাষ করে চাষিদের লোকসান হত। নীল কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বিঘায় খরচ হত প্রায় ১৩ টাকা ৬ আনা, কিন্তু চাষিরা পেত মাত্র ৬ টাকা।
- ⚖️ পঞ্চম আইন (১৮৩০): এই আইন অনুযায়ী, দাদন নিয়ে নীল চাষ না করলে চাষিকে গ্রেপ্তার ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যেত। এটি নীলকরদের অত্যাচারের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
- 👊 শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: নীল চাষে রাজি না হলে বা নীলকরদের কথামতো না চললে চাষিদের ওপর চলত অকথ্য অত্যাচার – প্রহার, নীলকুঠিতে আটকে রাখা, ঘরে আগুন লাগানো, এমনকি স্ত্রী-কন্যাদের সম্মানহানি করা হত।
- 👨⚖️ বিচার ব্যবস্থায় অবিচার: প্রশাসন, পুলিশ এবং বিচারক – সকলেই ছিল নীলকরদের পক্ষে। ফলে অত্যাচারিত চাষিরা আদালতে গিয়েও কোনো সুবিচার পেত না।
✊ বিদ্রোহের সূচনা ও প্রসার:
- ১৮৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামে এই বিদ্রোহ প্রথম শুরু হয়। (কারও মতে বারাসতে প্রথম শুরু হয়। )
- বিদ্রোহ দ্রুত নদিয়া, পাবনা, যশোহর, খুলনা, রাজশাহি, ফরিদপুর, মালদহ, দিনাজপুর, বারাসত প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষক স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই সংগ্রামে অংশ নেয়।
🌿 আন্দোলনের পর্যায় ও পদ্ধতি:
- প্রথম পর্যায়: অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন-নিবেদন।
- দ্বিতীয় পর্যায়: কোনো ফল না হওয়ায় নীল চাষ বয়কট। দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস (যাঁদের ‘বাংলার ওয়াট টাইলার’ বলা হয়) এই পর্যায়ে নীলচাষিদের সংগঠিত করেন।
- তৃতীয় পর্যায়: জোর করে নীল চাষ করাতে এলে সশস্ত্র প্রতিরোধ।
🧑🤝🧑 প্রধান নেতাগণ:
- দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস (নদিয়া)
- রামরতন মল্লিক (নড়াইলের জমিদার, ‘বাংলার নানাসাহেব’ নামে পরিচিত)
- রফিক মণ্ডল (মালদহ), কাদের মোল্লা (খুলনা), বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশ্বনাথ সর্দার বা ‘বিশে ডাকাত’ (বাঁশবেড়িয়া), মেঘাই সর্দার (আসাননগর), মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (পাবনা), রহিমউল্লা (সুন্দরবন) প্রমুখ।
✒️ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা: নীল বিদ্রোহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বাংলার তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের সক্রিয় সমর্থন।
- হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এবং চাষিদের আইনি লড়াইয়ে সাহায্য করেন।
- দীনবন্ধু মিত্র: তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০)-এ তিনি নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচারের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেন, যা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
- মাইকেল মধুসূদন দত্ত: তিনি ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
- রেভারেন্ড জেমস লঙ: তিনি নিজের নামে এই ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করলে, নীলকররা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তাঁর কারাদণ্ড ও জরিমানা হয়। (জরিমানার টাকা কালীপ্রসন্ন সিংহ দিয়েছিলেন। )
- অন্যান্য পত্রিকা: ‘সমাচার দর্পণ’, ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, শিশিরকুমার ঘোষের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ প্রভৃতিও নীলচাষিদের দুর্দশার কথা তুলে ধরে।
- আইনজীবী: শম্ভুনাথ পণ্ডিত, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ আইনজীবীরা নীলচাষিদের পক্ষে মামলা লড়েন।
- খ্রিস্টান মিশনারি: ফ্রেডারিক শূর, জে. জে. লিংকে প্রমুখ কিছু মিশনারিও নীলকরদের অত্যাচারের সমালোচনা করেন।
⚖️ ফলাফল ও গুরুত্ব:
- নীল কমিশন গঠন (১৮৬০): বাংলার ছোটলাট জে. পি. গ্রান্ট ১৮৬০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর একটি নীল কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনের রিপোর্টে নীলকরদের অত্যাচারের ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত হয়।
- আইন পরিবর্তন: কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অষ্টম আইন’ পাস করে জোর করে নীলচাষ করানো নিষিদ্ধ করা হয় এবং নীল চুক্তি আইন বাতিল করা হয়। (অন্যান্য সূত্রে ১৮৬২ সালে নীল আইন পাসের কথাও বলা হয়েছে )। চাষিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নীলচাষ বন্ধ হয়।
- ঐতিহাসিক তাৎপর্য:
- এটি ছিল ব্রিটিশ ভারতের প্রথম সফল ও সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ।
- এই বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, ঐক্যবদ্ধ হলে সাধারণ মানুষও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে।
- শিশিরকুমার ঘোষের মতে, এই বিদ্রোহই ভারতীয়দের প্রথম সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিল।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এই বিদ্রোহের অন্যতম শক্তি ছিল।
- ঐতিহাসিক এল. নটরাজনের মতে, নীলচাষিরা নীল চাষ বন্ধ করে ভারতের ইতিহাসে প্রথম ধর্মঘটের নজির সৃষ্টি করেন।
- তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং এই বিদ্রোহকে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন।

নীল কমিশনের রায় – চাষিদের জন্য নতুন দিনের সূচনা
১৮৫৯-৬০ সালের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত নীল বিদ্রোহে বাংলার চাষিরা যেভাবে গর্জে উঠেছিল, তাতে ব্রিটিশ সরকার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। এই বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান এবং নীল চাষ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য ১৮৬০ সালে গঠিত হয়েছিল ‘নীল কমিশন’। এই কমিশনের রিপোর্টে নীলকরদের ভয়াবহ অত্যাচার ও শোষণ এবং চাষিদের দুর্দশার চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। চলো, দেখে নিই নীল কমিশন চাষিদের স্বার্থে কী কী গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছিল।
নীল কমিশনের প্রধান সুপারিশসমূহ:
- 🚫 জোর করে নীল চাষ বন্ধ হোক!
- সুপারিশ: চাষিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা জোর করে নীল চাষ করানো যাবে না। নীল চাষ হবে সম্পূর্ণভাবে চাষির স্বাধীন ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ: কমিশন বুঝতে পারে যে, নীলকরদের বলপ্রয়োগই বিদ্রোহের মূল কারণ। তাই এই সুপারিশটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- 📝 শোষণমূলক ‘নীল চুক্তি’ বাতিল হোক!
- সুপারিশ: চাষিদের সঙ্গে নীলকরদের যে ‘দাদন চুক্তি’ বা ‘নীল চুক্তি’ হতো, তা ছিল অত্যন্ত শোষণমূলক এবং একতরফা। এই অন্যায্য চুক্তি বাতিল করতে হবে।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ: দাদন নিয়ে একবার চুক্তিবদ্ধ হলে চাষিরা প্রায় সারাজীবনের জন্য নীলকরদের ক্রীতদাসে পরিণত হতো। এই প্রথা বন্ধের সুপারিশ করা হয়।
- 💰 নীলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হোক! ⚖️
- সুপারিশ: যদি কোনো চাষি স্বেচ্ছায় নীল চাষ করতে চায়, তবে তাকে তার উৎপাদিত নীলের জন্য একটি ন্যায্য ও লাভজনক মূল্য দিতে হবে।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ: নীলকররা অত্যন্ত কম দামে নীল কিনত, যাতে চাষিদের লোকসান হতো। কমিশন এই অবস্থার পরিবর্তনের কথা বলে।
- 🛡️ চাষিদের ওপর অত্যাচার বন্ধ হোক!
- সুপারিশ: নীলকর সাহেব ও তাদের কর্মচারীরা চাষিদের ওপর যে অমানবিক অত্যাচার (যেমন – মারধর, আটক, ঘরবাড়ি জ্বালানো) চালায়, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং চাষিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ: নীলকরদের লাঠিয়াল বাহিনীর দৌরাত্ম্য এবং শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করার ওপর জোর দেওয়া হয়।
- 🤝 বিবাদ মীমাংসার সুষ্ঠু ব্যবস্থা হোক!
- সুপারিশ: নীলকর ও চাষিদের মধ্যে কোনো বিবাদ দেখা দিলে, তার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ: এতদিন ধরে বিচারব্যবস্থা নীলকরদের পক্ষেই কাজ করত। কমিশন এই একপেশে ব্যবস্থার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।
- 📜 পঞ্চম আইনের সংশোধন বা বিলোপ:
- সুপারিশ (পরোক্ষ): ১৮৩০ সালের কুখ্যাত ‘পঞ্চম আইন’, যা দাদন নিয়ে নীল চাষ না করলে চাষিকে অপরাধী গণ্য করত, তার সংশোধন বা বিলোপের প্রয়োজন। (কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরে এই ধরনের আইন বাতিল হয়)।
- সংক্ষিপ্ত বিবরণ: এই আইন নীলকরদের হাতে চাষিদের শোষণের একটি বড় হাতিয়ার ছিল।