Madhyamik History Chapter 6 Question Answer | ষষ্ঠ অধ্যায় | কৃষক-শ্রমিক-বাম আন্দোলন | Comprehensive and Free Exam Guide

madhyamik history chapter 6 question answer

Madhyamik History Chapter 6 Question Answer. Chapter: ষষ্ঠ অধ্যায়: বিশ শতকের ভারতে কৃষক, শ্রমিক ও বামপন্থী আন্দোলন: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা। WBBSE পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য এই অধ্যায়ে আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, আন্দোলন এবং প্রেক্ষাপটগুলি বোঝা অত্যন্ত জরুরী। এই পেজটিতে তোমরা পাবে মাধ্যমিক ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রশ্ন ও উত্তরের এক বিস্তারিত সংগ্রহ, যা তোমাদের জ্ঞানকে আরও মজবুত করতে এবং কার্যকরভাবে অনুশীলন করতে সাহায্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এখানে তোমরা তিন ধরনের প্রশ্নের (যেমন – সংক্ষিপ্ত উত্তরধর্মী প্রশ্ন (SAQ), বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন এবং ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন) যত্ন সহকারে তৈরি করা উত্তর পাবে। এই প্রশ্নোত্তরগুলি ব্যবহার করে তোমরা নিজেদের প্রস্তুতি যাচাই করতে পারবে, বিষয়গুলি নিয়ে ধারণা স্পষ্ট করতে পারবে এবং তোমাদের ইতিহাস পরীক্ষার জন্য আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারবে।


বিষয় ১: 🧑‍🌾 বিশ শতকের ভারতে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ 🧑‍🌾


📌 সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ২) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

Madhyamik History Chapter 6 Question Answer: কৃষক আন্দোলনের

১. প্রশ্ন: একা আন্দোলন কী?

উত্তর: অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন (১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দ) উত্তরপ্রদেশের হরদৈ, বারাবাঙ্কি, সীতাপুর প্রভৃতি জেলায় অতিরিক্ত খাজনা, বেগার শ্রম ও জমিদার-তালুকদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা মাদারি পাশি ও বাবা গরিবদাসের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে আন্দোলন গড়ে তোলে, তা একা আন্দোলন নামে পরিচিত। কৃষকরা একতাবদ্ধ থাকার শপথ নেওয়ায় এর এই নামকরণ হয়।

২. প্রশ্ন: মোপলা বিদ্রোহ (১৯২১) কোথায় এবং কেন হয়েছিল?

উত্তর:

  • কোথায়: কেরলের মালাবার উপকূলে।
  • কেন: এখানকার মুসলিম কৃষক (মোপলা) ও হিন্দু জমিদারদের (জেনমি) মধ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। অতিরিক্ত খাজনা, জমি থেকে উচ্ছেদ ও অন্যান্য শোষণ এবং খিলাফৎ আন্দোলনের প্রভাব যুক্ত হয়ে এই বিদ্রোহের জন্ম দেয়।

৩. প্রশ্ন: বাবা রামচন্দ্র কে ছিলেন?

উত্তর: বাবা রামচন্দ্র (প্রকৃত নাম শ্রীধর বলবন্ত জোধপুরকর) ছিলেন অসহযোগ আন্দোলন পর্বে উত্তরপ্রদেশের (অযোধ্যা) কৃষক আন্দোলনের প্রধান নেতা। তিনি কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদার ও তালুকদারদের বিরুদ্ধে খাজনা বন্ধ, বেগার শ্রম বন্ধ ও সামাজিক বয়কটের ডাক দেন এবং অযোধ্যা কিষান সভা (১৯২০) প্রতিষ্ঠা করেন।

৪. প্রশ্ন: বারদৌলি সত্যাগ্রহে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: গুজরাটের বারদৌলি তালুকে সরকার অতিরিক্ত খাজনা বৃদ্ধি করলে (১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ) কৃষকদের অনুরোধে বল্লভভাই প্যাটেল এই অহিংস সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেন। তিনি কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন, খাজনা বন্ধের ডাক দেন এবং তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় আন্দোলন সাফল্য লাভ করে। এখানকার মহিলারাই তাঁকে ‘সর্দার’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

৫. প্রশ্ন: কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তর: কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল (১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইতে প্রতিষ্ঠিত) মূলত নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল:

  • জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে থেকে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা প্রচার করা।
  • কৃষক ও শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার জন্য আন্দোলন সংগঠিত করা এবং তাদের জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোতে যুক্ত করা।
  • পূর্ণ স্বরাজের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দাবিকে জোরালো করা। এর প্রধান নেতা ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব, রামমনোহর লোহিয়া প্রমুখ।

৬. প্রশ্ন: সারাভারত কিষান সভা কবে, কাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর:

  • কবে: ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে, লখনউতে। (প্রথমে নাম ছিল সারাভারত কিষান কংগ্রেস, ১৯৩৭ সালে নাম পরিবর্তিত হয়)।
  • কাদের উদ্যোগে: মূলত কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল ও কমিউনিস্টদের মিলিত উদ্যোগে এবং স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী, এন. জি. রঙ্গ, জওহরলাল নেহরু প্রমুখ নেতাদের প্রচেষ্টায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম সভাপতি ছিলেন স্বামী সহজানন্দ ও সম্পাদক ছিলেন এন. জি. রঙ্গ।

৭. প্রশ্ন: ‘লাঙল যার, জমি তার’—এই স্লোগানটি কোন সংগঠনের এবং এর তাৎপর্য কী?

উত্তর:

  • সংগঠন: এটি ছিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের প্রতিষ্ঠিত কৃষক প্রজা পার্টি-র প্রধান স্লোগান।
  • তাৎপর্য: এর মাধ্যমে প্রকৃত চাষির হাতে জমির মালিকানা তুলে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল, যা ছিল জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ আওয়াজ।

৮. প্রশ্ন: বখস্ত আন্দোলন কোথায় এবং কী জন্য হয়েছিল?

উত্তর:

  • কোথায়: মূলত বিহারের মুঙ্গের, গয়া প্রভৃতি অঞ্চলে (১৯৩৬-৩৮ খ্রিস্টাব্দ)।
  • কারণ: জমিদাররা নানা অজুহাতে প্রজাদের চাষ করা জমি (‘বকস্ত’ বা খাস জমি) কেড়ে নিত। এই জমি পুনরুদ্ধারের দাবিতে ও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে কৃষকরা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী, কার্যানন্দ শর্মা প্রমুখের নেতৃত্বে এই আন্দোলন করে।

📝 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ৪) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে বাংলার কৃষকেরা অংশগ্রহণ করেনি কেন?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে (১৯০৫) বাংলার কৃষকসমাজের ব্যাপক অংশগ্রহণ না করার প্রধান কারণগুলি হল:

  • কংগ্রেসের উদাসীনতা: কংগ্রেস নেতৃত্ব মূলত জমিদার ও মধ্যবিত্ত-নির্ভর হওয়ায় কৃষকদের সমস্যা (যেমন – খাজনা, ঋণ) নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি নেয়নি। তারা জমিদারদের অসন্তুষ্ট করতে চায়নি। ডঃ সুমিত সরকারের মতে, ‘সুনির্দিষ্ট কৃষিভিত্তিক কর্মসূচির অভাব’ ছিল।
  • নেতৃত্বের শ্রেণিচরিত্র: আন্দোলনের নেতারা ছিলেন মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু জমিদার বা মধ্যবিত্ত, যাদের সঙ্গে সাধারণ মুসলিম বা নিম্নবর্ণের হিন্দু কৃষকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দূরত্ব ছিল।
  • সাম্প্রদায়িক বিভেদ: ব্রিটিশ সরকারের উস্কানিতে এবং কিছু মুসলিম নেতার প্রচারে পূর্ববঙ্গের মুসলিম কৃষকদের অনেকে বঙ্গভঙ্গকে তাদের স্বার্থের অনুকূল ভেবে আন্দোলন থেকে দূরে থাকে বা বিরোধিতা করে।
  • কৃষকদের অনীহা: কৃষকরা আন্দোলনকারী শহুরে ‘বাবু’দের নিজেদের শোষক শ্রেণির অংশ হিসেবে দেখত এবং তাদের দ্বারা স্বদেশি পণ্য ব্যবহারে বাধ্য হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

২. প্রশ্ন: অযোধ্যায় বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের বিবরণ দাও।

উত্তর: অসহযোগ আন্দোলনের সময় উত্তরপ্রদেশের (তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ) অযোধ্যা অঞ্চলে বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে:

  • প্রেক্ষাপট: অতিরিক্ত খাজনা, বেগার শ্রম, নজরানা বা ভেট আদায় এবং জমিদার-তালুকদারদের চরম অত্যাচারে কৃষকরা অতিষ্ঠ ছিল।
  • সংগঠন: বাবা রামচন্দ্র ঝিঙ্গুরি সিং ও দুর্গাপাল সিং-এর মতো স্থানীয় নেতাদের নিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করেন। তিনি জওহরলাল নেহরুর সহযোগিতায় ‘অযোধ্যা কিষান সভা’ (১৯২০) প্রতিষ্ঠা করেন, যার বহু শাখা দ্রুত জেলাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
  • আন্দোলনের পদ্ধতি: কৃষকরা খাজনা ও বেগার শ্রম বন্ধ করে দেয়, জমিদার ও তালুকদারদের সামাজিকভাবে বয়কট করে (নাপিত-ধোপা বন্ধ)। তারা পঞ্চায়েত গঠন করে নিজেদের বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করে।
  • সরকারি দমন ও পরিণতি: আন্দোলন তীব্র হলে সরকার বাবা রামচন্দ্রকে গ্রেফতার করে (১৯২০), কিন্তু কৃষকদের বিশাল প্রতিবাদে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরে আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠলে কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং সরকার কঠোর দমননীতিতে আন্দোলন ভেঙে দেয়। বাবা রামচন্দ্র পুনরায় গ্রেফতার হন (১৯২১)। তবে এই আন্দোলনের চাপে সরকার ‘অযোধ্যা খাজনা আইন’ (১৯২১) পাস করে কৃষকদের কিছু দাবি মেনে নেয়।

৩. প্রশ্ন: টীকা লেখো: একা আন্দোলন।

উত্তর: ভূমিকা: অহিংস অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-২২) চলাকালীন উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (হরদৈ, বারাবাঁকি, সীতাপুর, বারাইচ) সংঘটিত একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলন হল ‘একা’ বা ‘একতা’ আন্দোলন (১৯২১-২২)।

  • কারণ: খাজনার অত্যধিক হার (প্রচলিত হারের চেয়ে ৫০% বেশি দাবি), ইজারাদার ও সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচার, বেগার শ্রম এবং ফসলের পরিবর্তে নগদে খাজনা আদায়ের চেষ্টার বিরুদ্ধে কৃষকরা ক্ষুব্ধ হয়।
  • নামকরণ ও শপথ: কৃষকরা ধর্মীয় রীতি মেনে একতাবদ্ধ থাকার শপথ নিত যে তারা বর্ধিত খাজনা দেবে না, বেগার শ্রম দেবে না, জমি থেকে উচ্ছেদ মানবে না, পঞ্চায়েতের নির্দেশ মেনে চলবে ইত্যাদি। এই একতার শপথ থেকেই আন্দোলনের নাম হয় ‘একা’ বা ‘একতা’।
  • নেতৃত্ব: প্রথমদিকে কংগ্রেস ও খিলাফৎ নেতারা যুক্ত থাকলেও পরে আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যায় স্থানীয় কৃষক নেতা মাদারি পাশি ও বাবা গরিবদাসের হাতে।
  • চরিত্র ও পরিণতি: আন্দোলন ক্রমশ হিংসাত্মক হয়ে ওঠে, জমিদারদের বাড়ি ও শস্যক্ষেত্র আক্রান্ত হয়। কংগ্রেস এর থেকে দূরত্ব তৈরি করে। সরকার কঠোর দমননীতি প্রয়োগ করে। মাদারি পাশি গ্রেফতার হলে (১৯২২) আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়।

৪. প্রশ্ন: বারদৌলি সত্যাগ্রহের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের কীরূপ মনোভাব ছিল?

উত্তর: গুজরাটের বারদৌলি সত্যাগ্রহের (১৯২৮) প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ছিল অত্যন্ত সমর্থনসূচক ও সহযোগিতামূলক, যদিও তারা প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে রাখেনি:

  • নেতৃত্ব গ্রহণে সহায়তা: বারদৌলির স্থানীয় নেতারা (কল্যাণজি মেহতা, দয়ালজি দেশাই) যখন খাজনা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাঁরা কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানান। গান্ধিজির সম্মতিক্রমে প্যাটেল নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
  • গান্ধিজির সমর্থন: মহাত্মা গান্ধি নিজে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না হলেও, তাঁর পত্রিকা ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’-তে সরকারের খাজনা বৃদ্ধি নীতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং আন্দোলনের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানান। তিনি পরে বারদৌলিতে আসার পরিকল্পনাও করেন।
  • কংগ্রেস কর্মীদের অংশগ্রহণ: বহু কংগ্রেস কর্মী ও নেতা (যেমন – নরহরি পারিখ, রবিশংকর ব্যাস, মোহনলাল পান্ডে) সত্যাগ্রহ সংগঠনে প্যাটেলকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন।
  • আইনসভায় প্রতিবাদ: আন্দোলনের সমর্থনে বোম্বাই আইনসভার কংগ্রেস সদস্য কে. এম. মুন্সি ও লালজি নারাণজি পদত্যাগ করেন।
  • সাফল্যে উচ্ছ্বাস: সত্যাগ্রহের সাফল্য (রাজস্ব হার ২২% থেকে কমে প্রায় ৬% হওয়া) কংগ্রেসকে উৎসাহিত করে এবং বল্লভভাই প্যাটেল ‘সর্দার’ হিসেবে জাতীয় স্তরে পরিচিতি লাভ করেন।

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ৮) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: অহিংস অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলন কালে ভারতের কৃষক আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর: ভূমিকা: মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে পরিচালিত দুটি প্রধান জাতীয় আন্দোলন – অহিংস অসহযোগ (১৯২০-২২) এবং আইন অমান্য (১৯৩০-৩৪) – ভারতের কৃষক সমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ও সক্রিয় করে তুলেছিল। এই দুটি পর্বে কৃষক আন্দোলনগুলি জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলন পর্ব (১৯২০-২২):

  • প্রেক্ষাপট: বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট, রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, খিলাফৎ সমস্যা ইত্যাদি কারণে দেশজুড়ে অসন্তোষ ছিল। গান্ধিজির অসহযোগের ডাকে কৃষক সমাজ সাড়া দেয়।
  • আন্দোলনের রূপ:
    • উত্তরপ্রদেশ: বাবা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে অযোধ্যা কিষান সভার মাধ্যমে খাজনা বন্ধ, বেগার শ্রম বন্ধ ও সামাজিক বয়কটের আন্দোলন তীব্র হয়। মাদারি পাশির নেতৃত্বে ‘একা আন্দোলন’ (১৯২১-২২) খাজনা বৃদ্ধি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চৌরিচৌরার ঘটনা (১৯২২) কৃষকদের চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
    • বাংলা: মেদিনীপুরে বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নেতৃত্বে ইউনিয়ন বোর্ড বিরোধী ও চৌকিদারি কর বন্ধের সফল আন্দোলন হয়। পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, বীরভূম প্রভৃতি জেলাতেও কৃষকরা খাজনা বন্ধ ও বয়কটে অংশ নেয়।
    • বিহার: স্বামী বিদ্যানন্দের নেতৃত্বে দ্বারভাঙ্গা অঞ্চলে জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। ভাগলপুর, পূর্ণিয়া, মুজফ্ফরপুরেও কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে।
    • দক্ষিণ ভারত: মালাবার উপকূলে মোপলা কৃষকদের জমিদার-বিরোধী বিদ্রোহ (১৯২১) তীব্র আকার ধারণ করে (যদিও এতে সাম্প্রদায়িক হিংসার উপাদান ছিল)। অন্ধ্রের গুন্টুর ও গোদাবরী অঞ্চলে (রম্পা বিদ্রোহ, নেতৃত্বে আল্লুরি সীতারাম রাজু) খাজনা বন্ধ ও বন আইন বিরোধী আন্দোলন হয়।
    • রাজস্থান: বিজোলিয়ায় সামন্ততন্ত্র বিরোধী এবং মারোয়াড় ও আলোয়ারে কর বন্ধের আন্দোলন হয়।

আইন অমান্য আন্দোলন পর্ব (১৯৩০-৩৪):

  • প্রেক্ষাপট: বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মহামন্দা (১৯২৯), কৃষিপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যহ্রাস, সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন এবং গান্ধিজির ডান্ডি অভিযানের (লবণ আইন ভঙ্গ) প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলন শুরু হয়।
  • আন্দোলনের রূপ:
    • উত্তরপ্রদেশ: অর্থনৈতিক মন্দায় কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় হওয়ায় তারা ব্যাপকভাবে খাজনা বন্ধের আন্দোলনে নামে (No-Rent Campaign)। রায়বেরিলি, আগ্রা, বারাবাঁকি, লখনউ ইত্যাদি অঞ্চল আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা এই আন্দোলনে সমর্থন জানায়।
    • বাংলা: এখানেও খাজনা বন্ধ এবং চৌকিদারি কর বন্ধের আন্দোলন তীব্র হয়। মেদিনীপুর, শ্রীহট্ট, ঢাকা, হুগলি, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলা সক্রিয় ছিল।
    • বিহার: স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী ও বিহার প্রাদেশিক কিষান সভার নেতৃত্বে খাজনা হ্রাসের দাবিতে তীব্র আন্দোলন চলে।
    • গুজরাট: বারদৌলি, খেদা প্রভৃতি অঞ্চলে কৃষকরা কর বন্ধের আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
    • দক্ষিণ ভারত: অন্ধ্রপ্রদেশে এন. জি. রঙ্গ ও ‘রায়ত অ্যাসোসিয়েশন’, কেরালায় কেলাপ্পান এবং তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস নেতারা কৃষকদের সংগঠিত করে খাজনা বন্ধ ও কর বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেন।
    • পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক: এই সব অঞ্চলেও খাজনা ও জলসেচ কর হ্রাসের দাবিতে কৃষকরা আন্দোলনে অংশ নেয়।

উপসংহার: দুটি আন্দোলনেই কৃষক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ জাতীয় আন্দোলনের গণভিত্তিকে প্রসারিত করেছিল। যদিও কংগ্রেস নেতৃত্ব অনেক সময় কৃষকদের শ্রেণি-সংগ্রামকে (যেমন – খাজনা পুরোপুরি বন্ধ করা) পূর্ণ সমর্থন দেয়নি বা নিয়ন্ত্রিত রাখতে চেয়েছে, তবুও এই পর্বগুলি কৃষক সমাজকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও সংগঠিত হতে প্রভূত সাহায্য করেছিল।

২. প্রশ্ন: বারদৌলি সত্যাগ্রহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। তুমি কি মনে কর যে, এই আন্দোলন কৃষক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করেছিল?

উত্তর: বারদৌলি সত্যাগ্রহের বিবরণ: ভূমিকা: ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের সুরাট জেলার বারদৌলি তালুকে সংঘটিত কৃষক সত্যাগ্রহ ছিল গান্ধিवादी অহিংস প্রতিরোধের এক ক্লাসিক উদাহরণ এবং এটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

  • প্রেক্ষাপট: বারদৌলি একটি রায়তওয়ারি অঞ্চল ছিল। ১৯২৫ সালের ভয়াবহ বন্যা ও ফসলের ক্ষতির পরেও বোম্বাই সরকার এখানে ভূমিরাজস্ব প্রায় ২২% (প্রথমে ৩০% প্রস্তাবিত) বৃদ্ধি করে। কৃষকদের আবেদন অগ্রাহ্য হলে তারা খাজনা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
  • নেতৃত্ব: স্থানীয় নেতারা (কল্যাণজি মেহতা, দয়ালজি দেশাই) কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং তাঁদের অনুরোধে গান্ধিवादी কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। গান্ধিজি নৈতিক সমর্থন জানান।
  • আন্দোলনের প্রকৃতি:
    • এটি ছিল সম্পূর্ণ অহিংস সত্যাগ্রহ।
    • কৃষকরা ঈশ্বর বা আল্লাহর নামে বর্ধিত খাজনা না দেওয়ার শপথ নেয়।
    • সরকারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত বা জমি অধিগ্রহণের চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।
    • সামাজিক বয়কট ও অসহযোগিতার নীতি গ্রহণ করা হয়।
    • আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্যাটেল তালুককে ১৩টি অঞ্চলে ভাগ করে শিবির স্থাপন করেন এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলেন।
  • জনগণের অংশগ্রহণ: কালিপরাজ (উপজাতি) ও উজলিপরাজ (উচ্চবর্ণ), হিন্দু ও মুসলিম সকল কৃষক, এমনকি ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকরাও এই আন্দোলনে সামিল হয়। মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য (মিঠুবেন পেটিট, মণিবেন প্যাটেল, সারদা মেহতা প্রমুখ)। তাঁরাই বল্লভভাইকে ‘সর্দার’ উপাধি দেন।
  • সাফল্য: আন্দোলনের তীব্রতা, দেশব্যাপী সমর্থন (যেমন – বোম্বাইয়ের শ্রমিকদের চাঁদা দান) এবং আইনসভার সদস্যদের পদত্যাগের চাপে সরকার নতিস্বীকার করে। ব্লুমফিল্ড-ম্যাক্সওয়েল তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সুপারিশে বর্ধিত রাজস্ব হার বাতিল করে মাত্র ৬.০৩% বৃদ্ধি कायम রাখা হয়। বাজেয়াপ্ত জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

কৃষক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করেছিল কি? (মূল্যায়ন): হ্যাঁ, বারদৌলি সত্যাগ্রহ কৃষক শ্রেণির (বিশেষত বারদৌলির) স্বার্থরক্ষায় অনেকাংশে সফল হয়েছিল। যেমন:

  • অর্থনৈতিক সাফল্য: অন্যায্যভাবে চাপানো অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা থেকে কৃষকরা মুক্তি পায়। ২২% বৃদ্ধির বদলে মাত্র ৬.০৩% বৃদ্ধি তাদের কাছে বিরাট জয় ছিল।
  • জমি পুনরুদ্ধার: বাজেয়াপ্ত বা জোর করে বিক্রি করা জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
  • সামাজিক শোষণ হ্রাস: ‘হালি প্রথা’র মতো সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং আন্দোলনের ফলে কৃষকদের সামাজিক মর্যাদা কিছুটা হলেও বাড়ে।
  • আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে শক্তিশালী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জয়লাভ কৃষকদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
  • জাতীয় গুরুত্ব: এই সাফল্য সারা দেশের কৃষক আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে এবং জাতীয় আন্দোলনে কংগ্রেস ও গান্ধিवादी পদ্ধতির প্রতি আস্থা বৃদ্ধি করে।

তবে, এই আন্দোলন মূলত জমির মালিক কৃষকদের (পতিদার, কুনবি) আন্দোলন হওয়ায় ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকদের মূল সমস্যাগুলির (যেমন মজুরি, স্থায়ী কর্মসংস্থান) সমাধান সেভাবে হয়নি। তা সত্ত্বেও, तात्कालिक দাবি আদায়ে এবং কৃষক সমাজকে সংগঠিত ও সচেতন করার ক্ষেত্রে এর সাফল্য অনস্বীকার্য।

বিষয় ২: 👷 বিশ শতকের ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ 👷

madhyamik history chapter 6 question answer: শ্রমিক আন্দোলন

📌 সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ২) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: ভারতে কবে প্রথম মে দিবস পালিত হয় এবং কার নেতৃত্বে?

উত্তর:

  • কবে: ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে।
  • কার নেতৃত্বে: মাদ্রাজের (চেন্নাই) সমুদ্রতটে বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার-এর নেতৃত্বে ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয়।

২. প্রশ্ন: নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (AITUC) কবে, কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর:

  • কবে: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ৩১শে অক্টোবর।
  • কোথায়: বোম্বাইতে (বর্তমান মুম্বাই)। (এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন লালা লাজপত রায়, এন. এম. যোশী, দেওয়ান চমনলাল, জোশেফ ব্যাপিস্তা প্রমুখ।)

৩. প্রশ্ন: AITUC-র প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক কারা ছিলেন?

উত্তর:

  • প্রথম সভাপতি: লালা লাজপত রায়।
  • প্রথম সাধারণ সম্পাদক: দেওয়ান চমনলাল।

৪. প্রশ্ন: মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন কবে এবং কার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর:

  • কবে: ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে।
  • কার উদ্যোগে: বি. পি. ওয়াদিয়া-র উদ্যোগে (সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের সহযোগিতায়) এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই ছিল ভারতের প্রথম আধুনিক শ্রমিক সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন।

৫. প্রশ্ন: ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি কবে এবং কী নামে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর:

  • কবে ও কী নামে: ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা নভেম্বর কলকাতায় ‘দ্য লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • প্রতিষ্ঠাতা: কুতুবউদ্দিন আহমেদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার প্রমুখ। (পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ হয়)।

৬. প্রশ্ন: ‘গিরনি কামগড় ইউনিয়ন’ কে, কবে প্রতিষ্ঠা করেন?

উত্তর:

  • কে: বিখ্যাত বামপন্থী নেতা এস. এ. ডাঙ্গে।
  • কবে: ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে, বোম্বাইতে। (এই ইউনিয়নের নেতৃত্বে বোম্বাইয়ের বস্ত্র শ্রমিকরা ঐতিহাসিক ধর্মঘট করে)।

৭. প্রশ্ন: কবে এবং কেন ‘রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ গঠিত হয়?

উত্তর:

  • কবে: ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।
  • কেন: নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের (AITUC) নরমপন্থী ও চরমপন্থী (কমিউনিস্ট) নেতাদের মধ্যে বিভেদ দেখা দিলে, বি. টি. রণদিভে, সোমনাথ লাহিড়ী প্রমুখ চরমপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা বেরিয়ে এসে ‘রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ গঠন করেন।

৮. প্রশ্ন: শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব কেমন ছিল?

উত্তর: শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি জাতীয় কংগ্রেসের মনোভাব ছিল কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত:

  • কংগ্রেস শ্রমিকদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও, শ্রমিক-মালিক প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে চলতে চাইত, কারণ মালিক শ্রেণি কংগ্রেসের অন্যতম সমর্থক ছিল।
  • তারা শ্রমিকদের মূলত জাতীয় আন্দোলনের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইত, কিন্তু তাদের শ্রেণি-দাবিকে সবসময় অগ্রাধিকার দেয়নি।

📝 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ৪) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন কালে শ্রমিক শ্রেণির কীরূপ ভূমিকা ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে (১৯০৫) শ্রমিক শ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য, যদিও তা মূলত অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া কেন্দ্রিক ছিল, তবে কিছু ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী আবেগও কাজ করেছিল।

  • ধর্মঘট: কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন শিল্প (যেমন – চটকল, রেল, সরকারি প্রেস, ট্রাম কোম্পানি, ডক) এবং এমনকি পুরসভার কুলি-মেথররাও ধর্মঘটে সামিল হয়। ১৬ই অক্টোবর (বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন) ব্যাপক ধর্মঘট পালিত হয়।
  • ট্রেড ইউনিয়ন গঠন: এই সময়েই প্রথম সংগঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ার প্রয়াস দেখা যায়। যেমন – সরকারি প্রেসের কর্মীদের ‘প্রিন্টার্স ইউনিয়ন’ (১৯০৫), চটকল শ্রমিকদের ‘ইন্ডিয়ান মিলহ্যান্ডস ইউনিয়ন’ (১৯০৬), রেলকর্মীদের ‘রেলওয়ে মেনস ইউনিয়ন’ (১৯০৬) ইত্যাদি।
  • নেতৃবৃন্দের সমর্থন: অশ্বিনীকুমার ব্যানার্জি, প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী, অপূর্বকুমার ঘোষ, প্রেমতোষ বসু, বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাশ, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতারা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে, তাদের দাবি আদায়ে ও ধর্মঘটে সাহায্য করেন।
  • রাজনৈতিক প্রভাব: বালগঙ্গাধর তিলকের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বোম্বাইয়ের শ্রমিকদের ধর্মঘট (১৯০৮) ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধর্মঘট। পাঞ্জাবেও রেল ও অস্ত্র কারখানার শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে লালা লাজপত রায় ও অজিত সিংকে নির্বাসিত করা হয় (১৯০৭)।

উপসংহার: এই আন্দোলনগুলি শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি সচেতনতা ও সংগঠন গড়ার প্রাথমিক প্রয়াসকে তুলে ধরে এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি করে।

২. প্রশ্ন: ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিষ্ঠা ও কার্যকলাপ সংক্ষেপে বর্ণনা করো।

উত্তর: ভূমিকা: বিশ শতকের কুড়ির দশকে ভারতে বামপন্থী ভাবধারার প্রসারের ফলে শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP) গঠিত হয়।

  • প্রতিষ্ঠা: কমিউনিস্টরা সরাসরি রাজনৈতিক কাজের সুযোগ না পাওয়ায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ‘দ্য লেবার স্বরাজ পার্টি অফ দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি দল গঠন করেন। পরে মুজফ্ফর আহমেদ প্রমুখ এতে যোগ দেন এবং এর নাম পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি অফ বেঙ্গল’ (১৯২৭) এবং পরে সর্বভারতীয় স্তরে ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি’ (১৯২৮) হয়।
  • উদ্দেশ্য: প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কৃষক ও শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময় নির্দিষ্ট করা, জমিদারি উচ্ছেদ, বেগার প্রথা রদ ইত্যাদি দাবিতে সংগঠিত করা এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতীয় আন্দোলনে সামিল করা।
  • কার্যকলাপ:
    • বিভিন্ন প্রদেশে (বাংলা, বোম্বাই, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ) এর শাখা স্থাপিত হয়।
    • দলের নেতারা শ্রমিক ধর্মঘট (যেমন – লিলুয়া রেল ধর্মঘট, কানপুর টেক্সটাইল ধর্মঘট) সংগঠনে সাহায্য করেন।
    • তারা বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন গঠনেও সহায়তা করে।
    • ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ (বাংলায়), ‘ক্রান্তি’ (মারাঠি), ‘কীর্তি’ (পাঞ্জাবি) প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে দলের বক্তব্য প্রচারিত হতো।
    • সাইমন কমিশন বয়কটে দলটি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
  • অবসান: দলের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ব্রিটিশ সরকারকে শঙ্কিত করে তোলে। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় (১৯২৯) দলের প্রথম সারির প্রায় সমস্ত নেতা গ্রেফতার হলে দলটি কার্যত ভেঙে যায়।

৩. প্রশ্ন: ভারত ছাড়ো আন্দোলন কালে ভারতে শ্রমিক আন্দোলনের পরিচয় দাও।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল মূলত একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান। কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও এবং কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা কারারুদ্ধ থাকলেও, ভারতের শ্রমিক শ্রেণি এই আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করে।

  • স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ: গান্ধিজি সহ প্রধান নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বোম্বাই, আমেদাবাদ, দিল্লি, কানপুর, জামশেদপুর, নাগপুর, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর প্রভৃতি শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট ও প্রতিবাদ শুরু করে।
  • উল্লেখযোগ্য ধর্মঘট:
    • জামশেদপুর: টাটা লৌহ ও ইস্পাত কারখানার শ্রমিকরা জাতীয় সরকার গঠনের দাবিতে ১৩ দিন একটানা ধর্মঘট পালন করে।
    • আমেদাবাদ: এখানকার বস্ত্রশিল্পের প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে ঐতিহাসিক ধর্মঘট চালিয়ে যায়।
    • বোম্বাই ও অন্যান্য: বোম্বাইয়ের প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক জুলাই মাসেই ধর্মঘট করে। দিল্লি, নাগপুর, লখনউতেও ব্যাপক ধর্মঘট হয়। কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও ট্রাম শ্রমিকরা একাধিকবার ধর্মঘটে সামিল হয়।
  • চরিত্র: শ্রমিকদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবির জন্য ছিল না, এর মধ্যে তীব্র ব্রিটিশ-বিরোধিতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছিল। তারা কলকারখানায় কাজ বন্ধ করার পাশাপাশি মিছিল, পিকেটিং এবং কিছু ক্ষেত্রে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের কাজেও অংশ নেয়।
  • কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা: যদিও দলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ছিল আন্দোলনে যোগ না দেওয়া, বহু সাধারণ শ্রমিক ও নিচুতলার কমিউনিস্ট কর্মীরা দলের নির্দেশ অমান্য করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।

উপসংহার: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির এই স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণ আন্দোলনকে গণচরিত্র দান করেছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি দুর্বল করতে সাহায্য করেছিল।


📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ৮) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: ভারতে বিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনে কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনীতির কীভাবে সংযোগ ঘটেছিল?

উত্তর: ভূমিকা: বিশ শতকের ভারতে শ্রমিক আন্দোলন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা ক্রমশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এই সংযোগ স্থাপনে জাতীয় কংগ্রেস এবং বামপন্থী দলগুলির (বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল) ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

কংগ্রেস ও শ্রমিক আন্দোলন:

  • প্রাথমিক পর্যায় (১৯২০ পূর্ব): কংগ্রেস প্রথমদিকে শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিল না। বঙ্গভঙ্গ যুগে কিছু নেতা ব্যক্তিগতভাবে শ্রমিকদের সাহায্য করলেও দলের তেমন কোনো কর্মসূচি ছিল না।
  • অসহযোগ পর্ব: গান্ধিজির উত্থানের পর কংগ্রেস শ্রমিকদের জাতীয় আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। নাগপুর (১৯২০) ও গয়া (১৯২২) অধিবেশনে শ্রমিক সংক্রান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। বহু কংগ্রেস নেতা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সাহায্য করেন। কিন্তু কংগ্রেস মূলত শ্রমিক-মালিক শ্রেণি সমন্বয়ে বিশ্বাসী ছিল এবং তীব্র শ্রেণি সংগ্রাম বা দীর্ঘমেয়াদী ধর্মঘটকে সমর্থন করত না, কারণ এতে জাতীয় আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে এবং শিল্পপতিদের সমর্থন হারাতে পারে বলে তারা মনে করত।
  • আইন অমান্য পর্ব: এই সময়েও কংগ্রেস শ্রমিকদের আন্দোলনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে, কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়াকে জাতীয় দাবির ঊর্ধ্বে স্থান দেয়নি। গান্ধিজি বা কংগ্রেস নেতৃত্ব অনেক সময় শ্রমিকদের চরমপন্থী কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
  • কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল (১৯৩৪): কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই জয়প্রকাশ নারায়ণ, নরেন্দ্র দেব প্রমুখের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠা শ্রমিকদের দাবিদাওয়াকে আরও গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে সাহায্য করে। তারা বামপন্থীদের সঙ্গে সহযোগিতার পথে হাঁটে।
  • ভারত ছাড়ো পর্ব: কংগ্রেসের ডাকে বহু শ্রমিক স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে যোগ দেয়, যদিও দল হিসেবে কংগ্রেস কারারুদ্ধ থাকায় সরাসরি নেতৃত্ব দিতে পারেনি।

বামপন্থী রাজনীতি ও শ্রমিক আন্দোলন:

  • সূচনা: রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের (১৯১৭) পর ভারতে বামপন্থী ভাবধারার প্রবেশ ঘটে। এম. এন. রায়, মুজফ্ফর আহমেদ, এস. এ. ডাঙ্গে, সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার প্রমুখ নেতারা শ্রমিকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন।
  • AITUC-তে প্রভাব: বামপন্থীরা নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে (AITUC, ১৯২০) যোগ দেয় এবং ক্রমশ এর মধ্যে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করে। শ্রেণি সংগ্রামের ধারণা শ্রমিক আন্দোলনে প্রাধান্য পেতে থাকে।
  • ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস্ পার্টি (WPP, ১৯২৫-২৮): কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে কাজ করার জন্য এই মঞ্চ তৈরি করে। WPP বিভিন্ন প্রদেশে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সংগঠন বিস্তার করে এবং বহু ধর্মঘট পরিচালনা করে।
  • কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ: বামপন্থীরা কংগ্রেসের নরমপন্থী বা আপসকামী নীতির সমালোচক ছিল। তারা পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শ্রমিক আন্দোলনকে চালিত করতে চেয়েছিল। এই মতপার্থক্যের জেরে AITUC একাধিকবার বিভক্ত হয় (যেমন – ১৯৩১ সালে রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস গঠন)।
  • সরকারি দমননীতি: ব্রিটিশ সরকার বামপন্থী প্রভাব বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পেশোয়ার, কানপুর এবং বিশেষ করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯) মাধ্যমে প্রথম সারির প্রায় সমস্ত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় (১৯৩৪)।
  • কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে সহযোগিতা: কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাকালীন বামপন্থীরা অনেক সময় কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলের মাধ্যমে কাজ চালায়।
  • ভারত ছাড়ো পর্বে দ্বিধা: কমিউনিস্ট পার্টি ‘জনযুদ্ধ’ নীতির কারণে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে, যা তাদের জাতীয়তাবাদী গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস করে। তবে বহু সাধারণ শ্রমিক তাদের নির্দেশ অমান্য করে আন্দোলনে যোগ দেয়।
  • বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নেতৃত্ব: বিশ্বযুদ্ধের পর তেভাগা, পুন্নাপ্রা-ভায়লার, তেলেঙ্গানা আন্দোলন এবং নৌবিদ্রোহে বামপন্থীরাই প্রধান নেতৃত্ব দেয়।

উপসংহার: বিশ শতকের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে কংগ্রেসের সংযোগ ছিল মূলত জাতীয়তাবাদী লক্ষ্যের অধীনে নিয়ন্ত্রিত পথে শ্রমিকদের সামিল করা। অন্যদিকে, বামপন্থীরা শ্রমিকদের শ্রেণি-স্বার্থ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে সামনে রেখে তাদের বিপ্লবী সম্ভাবনার বিকাশে জোর দিয়েছিল। উভয় ধারার টানাপোড়েন ও সহযোগিতার মধ্য দিয়েই ভারতের শ্রমিক আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল।

২. প্রশ্ন: ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেস প্রধান শক্তি হলেও, বামপন্থী (বিশেষত কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী) দলগুলির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বতন্ত্র। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের (১৯১৭) পর ভারতে বামপন্থী ভাবধারার সূচনা হয়।

  • সংগঠন স্থাপন:
    • ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI): ১৯২০ সালে তাসখন্দে এম. এন. রায়ের উদ্যোগে এবং ১৯২৫ সালে কানপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে এই দল প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP): কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে কাজ করার জন্য ১৯২৫-২৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে এই মঞ্চ গঠন করে।
    • কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল (CSP): ১৯৩৪ সালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্র দেব প্রমুখের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরা সংগঠিত হন।
    • অন্যান্য: রেড ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক (কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী গোষ্ঠী) ইত্যাদি।
  • আদর্শ ও লক্ষ্য:
    • বামপন্থীরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার (পূর্ণ স্বরাজ) দাবিই করত না, তারা শ্রমিক-কৃষকের শোষণমুক্তি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যের উপর ভিত্তি করে এক সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য প্রচার করত।
    • তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে দেখত এবং এর সম্পূর্ণ উচ্ছেদের পক্ষে ছিল।
  • কার্যকলাপ:
    • শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন: বামপন্থীদের প্রধান কাজ ছিল শিল্প শ্রমিক ও কৃষকদের তাদের শ্রেণি-স্বার্থ বিষয়ে সচেতন করা এবং ট্রেড ইউনিয়ন (যেমন – গিরনি কামগড় ইউনিয়ন) ও কিষান সভার (যেমন – সারাভারত কিষান সভা) মাধ্যমে সংগঠিত করা।
    • আন্দোলন পরিচালনা: তারা বহু শ্রমিক ধর্মঘট (যেমন – বোম্বাই বস্ত্রকল ধর্মঘট ১৯২৮, রেল ধর্মঘট) এবং কৃষক আন্দোলন (যেমন – তেভাগা, তেলেঙ্গানা, পুন্নাপ্রা-ভায়লার) পরিচালনা বা তাতে নেতৃত্ব দেয়।
    • জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সমালোচনা: বামপন্থীরা কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনগুলিতে (অসহযোগ, আইন অমান্য) অংশ নিলেও কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘আপসকামী’ বা ‘বুর্জোয়া’ নীতির সমালোচক ছিল। তারা আন্দোলনকে আরও তীব্র ও বিপ্লবী পথে চালিত করতে চাইত। সাইমন কমিশন বয়কটে তারা সক্রিয় ছিল।
    • প্রচার: ‘দ্য সোশ্যালিস্ট’, ‘ইনকিলাব’, ‘লেবার কিষান গেজেট’, ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে তারা তাদের মতাদর্শ প্রচার করত।
  • ব্রিটিশ দমননীতি:
    • সরকার বামপন্থী আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করত। তাই তাদের উপর কঠোর দমননীতি নামিয়ে আনা হয়।
    • পেশোয়ার, কানপুর ও বিশেষ করে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯-৩৩) দায়ের করে প্রথম সারির প্রায় সমস্ত বামপন্থী নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
    • ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ রাখা হয়।
  • বিতর্কিত ভূমিকা:
    • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ: যুদ্ধের প্রথম পর্যায়কে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ বললেও, হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করার পর (১৯৪১) বামপন্থীরা (বিশেষত CPI) একে ‘জনযুদ্ধ’ আখ্যা দেয় এবং ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়।
    • ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): ‘জনযুদ্ধ’ নীতির কারণে CPI আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে, যা তাদের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। যদিও বহু সাধারণ বামপন্থী কর্মী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
    • দেশভাগ: দেশভাগের প্রশ্নেও তাদের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

উপসংহার: বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা এক স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ধারা তৈরি করেছিল। শ্রমিক-কৃষককে সংগঠিত করে, শ্রেণি সংগ্রামের ধারণা প্রচার করে এবং পূর্ণ স্বরাজ ও সমাজতন্ত্রের দাবি তুলে তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কখনও সহযোগিতামূলক, কখনও সংঘাতপূর্ণ ছিল। সরকারি দমনপীড়ন এবং কিছু বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থান সত্ত্বেও ভারতের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তীকালে সামাজিক ন্যায়বিচার ও শ্রমিক-কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

বিষয় ৩: ☭ বিশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির অংশগ্রহণের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা ☭


📌 সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ২) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI) কোথায় এবং কবে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়?

উত্তর: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর, রাশিয়ার তাসখন্দে। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম. এন. রায়) এবং তাঁর সহযোগীরা।

২. প্রশ্ন: ভারতে প্রথম কমিউনিস্ট পত্রিকা কোনটি এবং তার সম্পাদক কে ছিলেন?

উত্তর:

  • পত্রিকা: ভারতে প্রকাশিত প্রথম কমিউনিস্ট পত্রিকা ছিল বোম্বাই থেকে প্রকাশিত ‘দ্য সোশ্যালিস্ট’ (The Socialist)।
  • সম্পাদক: শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে (এস. এ. ডাঙ্গে)। (প্রকাশকাল: ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ)

৩. প্রশ্ন: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯) কী?

উত্তর: ভারতে ক্রমবর্ধমান কমিউনিস্ট কার্যকলাপ ও শ্রমিক আন্দোলনে শঙ্কিত হয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩৩ জন प्रमुख কমিউনিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। এই মামলাই মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এতে বহু নেতার দীর্ঘ কারাদণ্ড হয়।

৪. প্রশ্ন: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত দুজন বিদেশি কমিউনিস্ট নেতার নাম লেখো।

উত্তর: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত তিনজন বিদেশি কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন:

  • ফিলিপ স্প্র্যাট (Philip Spratt)
  • বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি (Benjamin Bradley)
  • লেস্টার হাচিনসন (Lester Hutchinson)

৫. প্রশ্ন: মানবেন্দ্রনাথ রায় স্মরণীয় কেন?

উত্তর: মানবেন্দ্রনাথ রায় (প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট নেতা এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। তিনি:

  • ১৯২০ সালে বিদেশে (তাসখন্দে) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
  • কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
  • ভারতে বামপন্থী ভাবধারা প্রসারে তাঁর লেখনী ও কার্যকলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৬. প্রশ্ন: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘দ্বিজ’ বলা হয় কেন?

উত্তর: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা দুবার হয়েছিল বলে মনে করা হয়:

  • প্রথমবার ১৯২০ সালে এম. এন. রায়ের উদ্যোগে বিদেশে (তাসখন্দে)।
  • দ্বিতীয়বার ১৯২৫ সালে ভারতের মাটিতে কানপুরে (সিঙ্গারভেলু চেট্টিয়ার, এস. ভি. ঘাটে প্রমুখের উদ্যোগে)। এই দুবার জন্ম হয়েছিল বলে একে ‘দ্বিজ’ (অর্থাৎ যার দুবার জন্ম) বলা হয়।

৭. প্রশ্ন: ‘জনযুদ্ধ’ তত্ত্ব কী?

উত্তর: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-৪৫) প্রথম পর্যায়কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ বলে বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালে জার্মানি যখন সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করে, তখন কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধকে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ‘জনযুদ্ধ’ (People’s War) বলে ঘোষণা করে এবং সোভিয়েত রাশিয়াকে রক্ষার স্বার্থে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটাই ‘জনযুদ্ধ’ তত্ত্ব নামে পরিচিত।

৮. প্রশ্ন: তেভাগা আন্দোলন কবে এবং কোথায় হয়েছিল?

উত্তর:

  • কবে: ১৯৪৬-১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে।
  • কোথায়: মূলত অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর, রংপুর, জলপাইগুড়ি, খুলনা, মেদিনীপুর, ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে।

৯. প্রশ্ন: তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবি কী ছিল?

উত্তর: তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল উৎপন্ন ফসলের তিনভাগের দুইভাগ (তেভাগা) বর্গাদার বা ভাগচাষিদের দিতে হবে এবং একভাগ জমির মালিক বা জোতদার পাবে। এছাড়াও ইলাকাদারদের শোষণ বন্ধ এবং ঋণ মকুবেরও দাবি ছিল। এর মূল স্লোগান ছিল ‘আধি নয়, তেভাগা চাই’, ‘নিজ খোলানে ধান তোলো’।


📝 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ৪) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: টীকা লেখো: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা।

উত্তর: ভূমিকা: ভারতে বামপন্থী আন্দোলন ও শ্রমিক সংগঠনকে দমন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৯-৩৩) ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

  • প্রেক্ষাপট: বিশের দশকের শেষদিকে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির নেতৃত্বে এবং কমিউনিস্টদের প্রভাবে ভারতে শ্রমিক আন্দোলন ও ধর্মঘট তীব্র আকার ধারণ করে। ব্রিটিশ সরকার এই ক্রমবর্ধমান বামপন্থী প্রভাবকে সাম্রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করে।
  • ঘটনা: ১৯২৯ খ্রিস্টাবdeosর ২০শে মার্চ সরকার সারা ভারত থেকে ৩১ জন (পরে আরও ২ জন যুক্ত হয়) কমিউনিস্ট, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও জাতীয়তাবাদী নেতাকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ কমিউনিস্টও (ফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ব্র্যাডলি, হাচিনসন) ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও বলপূর্বক শাসন ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অভিযোগ আনা হয় এবং মিরাটে মামলা শুরু হয়।
  • প্রতিক্রিয়া: এই গণ-গ্রেফতার ও মামলার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। মতিলাল নেহরু, জওহরলাল নেহরু, এম. এ. আনসারি প্রমুখ জাতীয় নেতারা অভিযুক্তদের পক্ষ সমর্থন করেন। রোমাঁ রোলাঁ, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরাও এর নিন্দা করেন।
  • রায় ও ফলাফল: দীর্ঘ প্রায় চার বছর মামলার পর ১৯৩৩ সালে অভিযুক্তদের বেশিরভাগই কঠোর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন (যদিও আপিলে অনেকের সাজা কমে)। এই মামলায় এস. এ. ডাঙ্গে, মুজফ্ফর আহমেদ, পি. সি. যোশী, এস. ভি. ঘাটে প্রমুখ প্রধান নেতারা দণ্ডিত হন। এর ফলে ভারতের কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলন সাময়িকভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নেতৃত্ব সংকটে পড়ে।

উপসংহার: মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সাময়িকভাবে দুর্বল করলেও, এই মামলার প্রচার বামপন্থী মতাদর্শকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত করে তোলে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এর একটি স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করে দেয়।

২. প্রশ্ন: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: ১৯৪২ খ্রিস্টাবdeosর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (CPI) ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত:

  • আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ার পর (১৯৪১) CPI যুদ্ধটিকে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ থেকে ‘জনযুদ্ধ’-এ রূপান্তরিত বলে ঘোষণা করে এবং ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লড়াইয়ে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই ‘জনযুদ্ধ’ নীতির কারণে তারা কংগ্রেস আহূত ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং শ্রমিক শ্রেণিকে এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেয়।
  • আন্দোলনকারীদের সমালোচনা: তারা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ‘পঞ্চম বাহিনী’ বা ‘উন্মাদ দেশপ্রেমিক’ বলেও সমালোচনা করে।
  • সরকারি সুবিধা লাভ: ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থনের পুরস্কারস্বরূপ সরকার ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং কারারুদ্ধ কমিউনিস্ট নেতাদের মুক্তি দেয়।
  • সাধারণ কর্মীদের অংশগ্রহণ: দলের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা সত্ত্বেও, বহু সাধারণ শ্রমিক ও কৃষক, যারা কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক বা সদস্য ছিল, তারা দলের নির্দেশ অমান্য করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগদান করে এবং ধর্মঘট ও অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশ নেয় (যেমন – কলকাতা, আমেদাবাদ, জামশেদপুর)।

উপসংহার: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক ভূমিকা তাদের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছিল এবং জাতীয় আন্দোলনের মূলস্রোত থেকে তাদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। তবে সাধারণ কর্মীদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, ব্রিটিশ-বিরোধিতা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দলীয় অবস্থানের ঊর্ধ্বে ছিল।

৩. প্রশ্ন: মানবেন্দ্রনাথ রায় কীভাবে ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রসারে সাহায্য করেছিলেন?

উত্তর: ভূমিকা: মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম. এন. রায়, ১৮৮৭-১৯৫৪) ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিপ্লবী ও চিন্তাবিদ এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান স্থপতি।

  • বিদেশে পার্টি প্রতিষ্ঠা: বাঘাযতীনের নির্দেশনায় বিদেশে বিপ্লব সংগঠিত করতে গিয়ে তিনি মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন। তিনিই প্রথম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের উপস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
  • কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল (কমিন্টার্ন): তিনি ছিলেন কমিন্টার্নের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য। কমিন্টার্নের মাধ্যমে তিনি ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রসারের জন্য নির্দেশ পাঠাতেন এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
  • পত্রিকা ও লেখনী: তিনি বিদেশে থেকে ‘ভ্যানগার্ড অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স’ (Vanguard of Indian Independence) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা গোপনে ভারতে পাঠানো হতো এবং বামপন্থী কর্মীদের অনুপ্রাণিত করত। তাঁর লেখা ‘India in Transition’ গ্রন্থটিও ভারতে কমিউনিস্ট ভাবধারা প্রসারে সাহায্য করে।
  • ভারতে বামপন্থী গোষ্ঠী গঠন: তাঁর প্রেরণাতেই ভারতে বিভিন্ন গোষ্ঠী (যেমন – বোম্বাইয়ে ডাঙ্গে, লাহোরে গোলাম হোসেন, কলকাতায় মুজফ্ফর আহমেদ, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার) কমিউনিস্ট কার্যকলাপ শুরু করে, যারা পরে একত্রিত হয়ে ১৯২৫ সালে কানপুরে ভারতের মাটিতে CPI গঠন করে।

উপসংহার: যদিও মানবেন্দ্রনাথ রায় দীর্ঘকাল বিদেশে ছিলেন এবং পরে তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তিত হয়েছিল, তবুও ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনাপর্বে তাঁর তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪. প্রশ্ন: তেভাগা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর: ভূমিকা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলার গ্রামীণ সমাজে ঘটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষক আন্দোলন হল তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭)।

  • প্রেক্ষাপট ও দাবি: বাংলার বর্গাদার বা ভাগচাষিরা প্রথা অনুযায়ী উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক জমির মালিক বা জোতদারকে দিত এবং অর্ধেক নিজেরা পেত (‘আধিয়ারি’ প্রথা)। কিন্তু ১৯৪০ সালের সরকারি ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ ছিল যে, বর্গাদাররা ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ পাবে (‘তেভাগা’)। এই সুপারিশ কার্যকর করার দাবিতেই মূলত এই আন্দোলন শুরু হয়। তাদের স্লোগান ছিল – “আধি নয়, তেভাগা চাই”, “নিজ খোলানে ধান তোলো”।
  • সংগঠক ও নেতৃত্ব: বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষান সভা (কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সংগঠন) এই আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিল। চারু মজুমদার, অবনী লাহিড়ী, সুনীল সেন, বিভূতি গুহ, কংসারী হালদার, গুরুদাস তালুকদার প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতারা এর নেতৃত্ব দেন।
  • আন্দোলনের প্রসার: ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দিনাজপুরের রামচন্দ্রপুরে শুরু হয়ে আন্দোলন দ্রুত জলপাইগুড়ি, রংপুর, মালদা, ২৪ পরগনা, খুলনা, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ কৃষক এতে অংশ নেয়।
  • মহিলাদের অংশগ্রহণ: এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। জয়মণি, বাতাসী, বিমলা মণ্ডল, দীপেশ্বরী দেবী (‘বুড়িমা’) প্রমুখেরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • পরিণতি: মুসলিম লিগ সরকার কিছু আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও এবং কিছু জায়গায় কৃষকরা তেভাগা আদায় করতে সক্ষম হলেও, সরকারের দমননীতি এবং দেশভাগের ডামাডোলে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পূর্ণ সাফল্য পায়নি। তবে এটি কৃষক অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে।

📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন (প্রশ্নমান – ৮) | Madhyamik History Chapter 6 Question Answer

১. প্রশ্ন: ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: ভূমিকা: বিশ শতকের ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেস প্রধান শক্তি হলেও, বামপন্থী (বিশেষত কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী) দলগুলির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বতন্ত্র। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের (১৯১৭) পর ভারতে বামপন্থী ভাবধারার সূচনা হয়।

  • সংগঠন স্থাপন ও আদর্শ:
    • ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI): ১৯২০ সালে তাসখন্দে (এম. এন. রায়) এবং ১৯২৫ সালে কানপুরে (এস. ভি. ঘাটে প্রমুখ) প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি (WPP): ১৯২৫-২৮ সালের মধ্যে কমিউনিস্টরা এই মঞ্চ ব্যবহার করে কাজ করে।
    • কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল (CSP): ১৯৩৪ সালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রীরা (জয়প্রকাশ নারায়ণ, নরেন্দ্র দেব) সংগঠিত হন।
    • আদর্শ: বামপন্থীরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা (পূর্ণ স্বরাজ) নয়, শ্রমিক-কৃষকের শোষণমুক্তি ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয়। তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পুঁজিবাদের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে দেখে তার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ চায়।
  • শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করা:
    • বামপন্থীদের প্রধান শক্তি ছিল শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণি। তারা ট্রেড ইউনিয়ন (AITUC-তে প্রভাব বিস্তার, গিরনি কামগড় ইউনিয়ন) ও কিষান সভা (সারাভারত কিষান সভা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা) গঠনের মাধ্যমে এই দুই শ্রেণিকে সংগঠিত করে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে।
    • বহু ধর্মঘট ও কৃষক বিদ্রোহে তারা নেতৃত্ব দেয় বা সহায়তা করে।
  • জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও তার চরিত্র:
    • সমালোচনা ও সহযোগিতা: বামপন্থীরা কংগ্রেস পরিচালিত জাতীয় আন্দোলনগুলিতে (অসহযোগ, আইন অমান্য, সাইমন কমিশন বয়কট) অংশ নিলেও, তারা কংগ্রেসের ‘বুর্জোয়া’ নেতৃত্ব ও ‘আপসকামী’ নীতির সমালোচক ছিল। তারা আন্দোলনকে আরও বিপ্লবী ও গণমুখী করতে চাইত।
    • ভিন্ন পথ: তারা কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে শ্রমিক-কৃষক ভিত্তিক এক বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
    • পত্রিকা ও প্রচার: ‘দ্য সোশ্যালিস্ট’, ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকার মাধ্যমে তারা নিজেদের মতাদর্শ প্রচার করে।
  • ব্রিটিশ দমননীতির সম্মুখীন:
    • সরকার বামপন্থী আন্দোলনকে কঠোর হস্তে দমন করে। পেশোয়ার, কানপুর ও মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার (১৯২৯-৩৩) মাধ্যমে প্রথম সারির নেতাদের কারারুদ্ধ করা হয়। CPI-কে নিষিদ্ধ (১৯৩৪-৪২) করা হয়।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকা:
    • যুদ্ধের প্রথম পর্যায়কে ‘সাম্রাজ্যবাদী’ বললেও, জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার পর (১৯৪১) CPI একে ‘জনযুদ্ধ’ বলে ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়।
    • তারা ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে, যা তাদের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে।
  • যুদ্ধোত্তর পর্বের আন্দোলন:
    • বিশ্বযুদ্ধের পর বামপন্থীরাই মূলত তেভাগা আন্দোলন (বাংলা), পুন্নাপ্রা-ভায়লার সংগ্রাম (কেরালা), তেলেঙ্গানা কৃষক বিদ্রোহ (হায়দ্রাবাদ) এবং নৌবিদ্রোহে (বোম্বাই) সমর্থন ও নেতৃত্ব প্রদানে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

উপসংহার: ভারতে উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে গণমুখী করতে চেয়েছিল। তাদের শ্রেণি সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ, কংগ্রেসের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক এবং কিছু বিতর্কিত রাজনৈতিক অবস্থান সত্ত্বেও, ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।

error: Content is protected !!
Scroll to Top