📜 Madhyamik History Chapter 7 Notes: সপ্তম অধ্যায়: নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন: Free Exam Guide 📜

Madhyamik History Chapter 7 Notes: বিশ শতকের ভারত ছিল এক উত্তাল সময়। শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলির সংগ্রামই নয়, এই সময়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ নিজেদের অধিকার, পরিচিতি এবং স্বাধীনতার জন্য জেগে উঠেছিল। এই অধ্যায়ে আমরা জানব কীভাবে ভারতের নারীসমাজ অন্দরমহলের বাধা পেরিয়ে দেশের কাজে এগিয়ে এসেছিলেন, কীভাবে ছাত্রসমাজ নির্ভীক চিত্তে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এবং কীভাবে তথাকথিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী (বিশেষত দলিত সম্প্রদায়) সামাজিক বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিল। তাদের সম্মিলিত আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে। চলো, এই বিচিত্র ও শক্তিশালী আন্দোলনগুলির গভীরে প্রবেশ করি এবং তাদের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করি।

নারী আন্দোলনের Timeline: Madhyamik History Chapter 7 Notes

🚺 প্রথম ভাগ: বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ 🚺

💪 নারীশক্তি: পর্দার আড়াল থেকে সংগ্রামের ময়দানে 💪(Madhyamik History Chapter 7 Notes)

বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলন শুধুমাত্র পুরুষের সহযোগী হিসেবে নয়, বহুক্ষেত্রে নিজস্ব পরিচিতি ও নেতৃত্বের সঙ্গে বিকশিত হয়েছিল। শিক্ষা, সমাজ সংস্কার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা – এই তিনটি ক্ষেত্রেই নারীরা তাদের ছাপ রেখে গেছেন।

নারীশক্তি: Class 10 History Chapter 7 Notes

বিভিন্ন আন্দোলন ও পর্যায়ে নারীদের ভূমিকা (Madhyamik History Chapter 7 Notes)

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী বা স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১): জাগরণের প্রথম আলো
- এই সময়ে নারীরা মূলত ঘরোয়াভাবে আন্দোলনে অংশ নেন। অরন্ধন পালন, রাখিবন্ধন উৎসবে যোগদান, বিলিতি পণ্য বর্জন এবং স্বদেশি জিনিসপত্র ব্যবহার ছিল তাদের প্রতিবাদের প্রধান উপায়।
- সরলাদেবী চৌধুরানি এই সময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রতিষ্ঠা করে স্বদেশি জিনিসপত্র কেনাবেচার ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও, তিনি যুবকদের মধ্যে শারীরিক সক্ষমতা ও দেশপ্রেম জাগাতে ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ এবং ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ চালু করেন।
- অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নারীদের মধ্যে ছিলেন বরিশালের মনোরমা বসু (যিনি নারীবাহিনী গঠন করেছিলেন) এবং খুলনার লাবণ্যপ্রভা দত্ত। মুসলিম নারীদের মধ্যে খায়রুন্নেসা খাতুন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে স্বদেশি ভাবধারা প্রচার করেন।
অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২): গান্ধিজির আহ্বানে ব্যাপক অংশগ্রহণ
- মহাত্মা গান্ধির ডাকে সাড়া দিয়ে এই আন্দোলনে নারীরা বিপুল সংখ্যায় যোগ দেয়। তারা শুধুমাত্র বিদেশি পণ্য বয়কট বা চরকা কাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং সভা-সমিতি, পিকেটিং এবং কারাবরণেও নির্ভীকতার পরিচয় দেন।
- কলকাতায় খদ্দর বিক্রি করতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী, বোন ঊর্মিলা দেবী এবং ভাইঝি সুনীতি দেবী প্রথম মহিলা হিসেবে গ্রেফতার হন, যা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
- ঊর্মিলা দেবী ‘নারী কর্ম মন্দির’ (১৯২১) এবং ঢাকার আশালতা সেন ‘শিল্পাশ্রম’ (১৯২১) প্রতিষ্ঠা করে নারীদের স্বদেশি কাজে (যেমন খদ্দর তৈরি) যুক্ত করেন।
- চট্টগ্রামে ‘দেশপ্রিয়’ যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্ত চাঁদপুর স্টিমার ধর্মঘট ও কুলি ধর্মঘটে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেন।
আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-১৯৩৪): প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পুরোভাগে
- এই আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা আরও সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। তারা লবণ আইন ভঙ্গ করে লবণ তৈরি ও বিক্রিতে অংশ নেয়, বিদেশি মদের দোকান ও কাপড়ের দোকানের সামনে পিকেটিং করে, শোভাযাত্রা পরিচালনা করে এবং নির্ভয়ে পুলিশের অত্যাচার ও কারাবরণ সহ্য করে।
- কলকাতায় শান্তি দাশ ও ঊর্মিলা দেবীর উদ্যোগে ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ (১৯৩০) গঠিত হয়, যেখানে ইন্দুমতী গোয়েঙ্কা, সজ্জন দেবী প্রমুখ যোগ দেন।
- সরোজিনী নাইডু ধরসানা লবণগোলা সত্যাগ্রহে এবং কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ওয়াডালা লবণ কারখানায় বিক্ষোভ প্রদর্শনে নেতৃত্ব দেন।
- বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে মাতঙ্গিনী হাজরা (মেদিনীপুর), লাবণ্যলতা চন্দ (কুমিল্লা), আশালতা সেন (ঢাকা) প্রমুখ নারীরা স্থানীয় স্তরে আন্দোলন সংগঠিত করেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম নারীও এই আন্দোলনে সামিল হন।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): সর্বাত্মক লড়াই ও নেতৃত্ব
- “করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে” – এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নারীরা ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম সারির পুরুষ নেতারা গ্রেফতার হলে বহু স্থানে নারীরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়।
- বোম্বাইতে অরুণা আসফ আলি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আন্দোলনের সূচনা করেন এবং পরে আত্মগোপন করে আন্দোলন চালিয়ে যান। সুচেতা কৃপালনী অহিংস প্রতিরোধ সংগঠিত করেন।
- ঊষা মেহতা বোম্বাই থেকে গোপনে কংগ্রেসের বেতার কেন্দ্র ‘ভয়েস অফ ফ্রিডম’ পরিচালনা করে আন্দোলনের বার্তা ও নির্দেশ প্রচার করতেন।
- মেদিনীপুরের তমলুকে ‘তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ গঠিত হলে, সেখানে নারীদের নিয়ে ‘ভগিনী সেনা’ তৈরি হয়। ৭৩ বছর বয়সী মাতঙ্গিনী হাজরা (‘গান্ধিবুড়ি’) তমলুক থানা অভিযানে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
- আসামের তেজপুরে ১৩ বছরের কিশোরী কনকলতা বড়ুয়া থানা অভিযানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে এবং পাঞ্জাবের ভোগেশ্বরী ফুকোননী শোভাযাত্রায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারী: সাহসিকতার প্রতিমূর্তি
- নারীরা শুধুমাত্র অহিংস আন্দোলনেই নয়, সশস্ত্র বিপ্লবী পথেও দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন।
- পরোক্ষ ভূমিকা: অনেকে বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছেন, অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিয়েছেন, গোপন সংবাদ আদানপ্রদান করেছেন। যেমন, দুকড়িবালা দেবী (অস্ত্র রাখার অপরাধে কারাদণ্ড) এবং ননীবালা দেবী (বিপ্লবীদের ‘পিসিমা’, পুলিশি অত্যাচার সহ্য করেন)।
- প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ:
  - লীলা নাগ (রায়): ঢাকায় ‘দীপালি সংঘ’ (১৯২৩) প্রতিষ্ঠা করে নারীদের বিপ্লবী কার্যকলাপে যুক্ত করেন। এখানে শরীরচর্চা, লাঠিখেলা, অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। তিনি ‘দীপালি ছাত্রী সংঘ’ (১৯২৬) এবং ‘ছাত্রী ভবন’ (১৯৩০) প্রতিষ্ঠা করেন ও ‘জয়শ্রী’ (১৯৩১) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
  - প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার: মাস্টারদা সূর্য সেনের ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র সদস্য। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন (১৯৩০) ও অন্যান্য অভিযানে অংশ নেন। ১৯৩২ সালে পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেন এবং ধরা পড়ার আগে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম নারী শহিদ।
  - কল্পনা দত্ত: তিনিও সূর্য সেনের দলের সদস্য ছিলেন এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন। পরে গ্রেফতার হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তাঁর লেখা গ্রন্থ ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’।
  - বীণা দাস: ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি চালান।
  - শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী: কুমিল্লার দুই স্কুলছাত্রী ১৯৩১ সালে জেলাশাসক স্টিভেন্সকে হত্যা করেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজে নারী: দেশপ্রেমের চূড়ান্ত নিদর্শন
- নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ডাকে সাড়া দিয়ে নারীরা আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন। ১৯৪৩ সালে গঠিত হয় নারী বাহিনী ‘ঝাঁসির রানি ব্রিগেড’। এর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথন (সেহগল)। প্রায় ১৫০০ নারী এই বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দেন।

বিশ শতকে নারী জাগরণ: Madhyamik History Chapter 7

Woman Organization: Madhyamik History Chapter 7

🧑‍🎓 দ্বিতীয় ভাগ: বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ 🧑‍🎓

🔥 তরুণ তুর্কি: ব্রিটিশ বিরোধিতায় ছাত্রসমাজ 🔥(Madhyamik History Chapter 7 Notes)

বিশ শতকের ভারতে ছাত্রসমাজ শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নির্ভীক ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তাদের আন্দোলন ছিল মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং এই আন্দোলন জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে আরও শক্তিশালী করেছিল।

বিভিন্ন আন্দোলন ও পর্যায়ে ছাত্রদের ভূমিকা (Madhyamik History Chapter 7 Notes)

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১): জাগরণের প্রথম সোপান
- এই আন্দোলনেই বাংলার ছাত্রসমাজ প্রথম সম্মিলিতভাবে রাজনৈতিক প্রতিবাদে নামে। তাদের প্রধান কর্মসূচি ছিল বিলিতি স্কুল-কলেজ ও পণ্য বয়কট, পিকেটিং এবং স্বদেশি দ্রব্যের ব্যাপক প্রচার।
- কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ছাত্ররা বয়কটের শপথ নেয় এবং তাদের উদ্যোগে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়।
- ব্রিটিশ সরকার ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য বিভিন্ন দমনমূলক নির্দেশিকা জারি করে, যার মধ্যে কুখ্যাত ছিল কার্লাইল সার্কুলার (১০ অক্টোবর, ১৯০৫)। এই সার্কুলারের মাধ্যমে ছাত্রদের সভা-সমিতিতে যোগদান নিষিদ্ধ করা হয় এবং আন্দোলনকারী ছাত্রদের স্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হয়।
- এর প্রতিবাদে রিপন কলেজের ছাত্রনেতা শচীন্দ্রপ্রসাদ বসুর উদ্যোগে ‘অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি’ (৪ নভেম্বর, ১৯০৫) প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সোসাইটির সভাপতি ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র। এর প্রধান কাজ ছিল স্বদেশি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করা এবং স্বদেশি ভাবধারার প্রসার ঘটানো।
অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২): দেশব্যাপী ছাত্র জাগরণ
- মহাত্মা গান্ধির আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই আন্দোলনে ছাত্ররা অভূতপূর্ব সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে। ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে প্রায় ৯০ হাজার ছাত্র সরকারি স্কুল-কলেজ ত্যাগ করে।
- ছাত্ররা ‘তিলক স্বরাজ ফান্ডে’ অর্থ সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে (তাদের চেষ্টায় মাত্র ছয় মাসের মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি জমা পড়েছিল)।
- তারা স্বদেশি দ্রব্য, বিশেষত চরকা ও খদ্দরের প্রচারে আত্মনিয়োগ করে।
- এই সময়ে ছাত্রদের জন্য বহু জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যেমন – কাশী বিদ্যাপীঠ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, গুজরাট বিদ্যাপীঠ এবং কলকাতায় জাতীয় কলেজ (১৯২১)।
আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-১৯৩৪): প্রত্যক্ষ সংগ্রাম
- এই আন্দোলনেও ছাত্ররা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তারা লবণ আইন ভঙ্গ, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক গ্রন্থ পাঠ, বিলিতি পণ্য ত্যাগ এবং বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামনে পিকেটিং করে।
- তবে এই পর্বে ছাত্রদের উপর পুলিশি নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং বহু ছাত্র কারারুদ্ধ হয়। কিছু ক্ষেত্রে অসহযোগ আন্দোলনের তুলনায় এই পর্বে ছাত্রদের অংশগ্রহণ কিছুটা কম ছিল বলে মনে করা হয়।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২): আন্দোলনের পুরোভাগে ছাত্রসমাজ
- এই আন্দোলনকে অনেক ঐতিহাসিক ‘ছাত্র ও যুব বিদ্রোহ’ বলে অভিহিত করেন। প্রথম সারির জাতীয় নেতারা গ্রেফতার হওয়ার পর বহু স্থানে ছাত্ররাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে।
- ছাত্ররা স্কুল-কলেজে ধর্মঘট করে, গ্রামেগঞ্জে গিয়ে আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেয়, বিভিন্ন নাশকতামূলক কাজে (যেমন – টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন লাইন কাটা, রেলপথ অবরোধ, থানা আক্রমণ) লিপ্ত হয়।
- বিহারের পাটনায় সচিবালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে সাতজন ছাত্র পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়।
- সিন্ধুপ্রদেশে রেললাইন সরানোর দায়ে ১৯ বছর বয়সী ছাত্র হেমু কালানির ফাঁসি হয় (২১ জানুয়ারি, ১৯৪৩), যা ছাত্রসমাজের আত্মত্যাগের এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত।
- বাংলার বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত কলকাতা ও মেদিনীপুরে ছাত্ররা আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্র ও যুবসমাজ:
- বিশ শতকের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মূল শক্তিই ছিল ছাত্র ও যুবসমাজ। তাদের আদর্শবাদ, সাহস এবং আত্মত্যাগের মানসিকতা বিপ্লবী সংগঠনগুলিকে পুষ্ট করেছিল।
- বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স (বি.ভি.): এই গুপ্ত বিপ্লবী দলটি মূলত ঢাকার বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে বিকশিত হয়, যদিও ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এটি একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দলের তিন তরুণ বিপ্লবী বিনয় বসু (ঢাকা মেডিকেল স্কুলের ছাত্র), বাদল গুপ্ত ও দীনেש গুপ্ত ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং-এ দুঃসাহসিক অভিযান (যা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত) চালিয়ে কারা বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করেন।
- মাস্টারদা সূর্য সেন ও ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি: মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী দল ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’-র অধিকাংশ সদস্যই ছিল ছাত্র ও যুবক। এই বাহিনী ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম পুলিশ অস্ত্রাগার ও সহকারী বাহিনীর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে এবং কয়েকদিনের জন্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন অচল করে দেয়। পরবর্তীকালে জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়।
- বাংলার ছাত্রী বিপ্লবীদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যারা বিভিন্ন সময়ে দুঃসাহসিক বিপ্লবী কার্যকলাপে অংশ নিয়েছেন।
আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন:
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের বিচার শুরু হলে তার প্রতিবাদে সারা ভারতে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়।
- আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানি ক্যাপ্টেন রশিদ আলির কারাদণ্ডের প্রতিবাদে ১৯৪৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ছাত্রসমাজ, বিশেষত মুসলিম ছাত্র লিগ ও ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের ডাকে ‘রশিদ আলি দিবস’ পালিত হয়। এই দিন ব্যাপক ছাত্র ধর্মঘট ও গণবিক্ষোভ দেখা দেয়, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের প্রতিফলন ঘটায়।

ছাত্র ঐক্যের দুর্গ: Madhyamik History Chapter 7

Students Movement Timeline: Madhyamik History Chapter 7

তৃতীয় ভাগ: বিশ শতকের ভারতে দলিত রাজনীতি ও আন্দোলনের বিকাশ – চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ

✊ জাগরণ দলিতের: অস্পৃশ্যতা থেকে অধিকারের সংগ্রাম ✊(Madhyamik History Chapter 7 Notes)

Dalit Movement: Madhyamik History Chapter 7

বিশ শতকের ভারত শুধুমাত্র ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াই করেনি, সমাজের ভেতরে থাকা শতাব্দী প্রাচীন অন্যায়, অসাম্য ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও এক শক্তিশালী সংগ্রাম দেখেছিল। এই সংগ্রামের পুরোভাগে ছিলেন দলিত জনগোষ্ঠী, যারা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা, মানবিক অধিকার এবং রাজনৈতিক পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও কারণ (Madhyamik History Chapter 7 Notes)

বর্ণভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা: ভারতীয় সমাজে প্রচলিত কঠোর বর্ণভেদ প্রথার সর্বনিম্ন স্তরে থাকা দলিতরা (যাদের বিভিন্ন সময়ে পঞ্চম জাতি, চণ্ডাল, অতি শূদ্র ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হত) উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হত। তাদের মন্দিরে প্রবেশ, সাধারণ জলাশয় ব্যবহার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমান সুযোগ এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতে হত।
অর্থনৈতিক শোষণ: দলিতদের অধিকাংশই ছিল ভূমিহীন কৃষক, দিনমজুর, খেতমজুর অথবা সমাজের চোখে ‘ছোট’ বা ‘অশুচি’ বলে বিবেচিত পেশার সঙ্গে যুক্ত। তারা প্রায়শই বেগার শ্রম দিতে এবং অত্যন্ত স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হত। দারিদ্র্য ছিল তাদের জীবনের এক নির্মম বাস্তবতা।
আত্মমর্যাদার আকাঙ্ক্ষা: উনিশ ও বিশ শতকের সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলন, শিক্ষার সীমিত প্রসার এবং বিভিন্ন ধর্মীয় জাগরণমূলক প্রয়াস দলিতদের মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মসচেতনতা ও আত্মমর্যাদার আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করে। তারা এই অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে।

প্রধান ব্যক্তিত্ব, সংগঠন ও আন্দোলন (Madhyamik History Chapter 7 Notes)

মহারাষ্ট্রে জ্যোতিবা ফুলের সংগ্রাম:
- জ্যোতিবা ফুলে (১৮২৭-১৮৯০) ছিলেন মহারাষ্ট্রের দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁকে মহারাষ্ট্রে ‘সমাজ বিপ্লবের জনক’ বলা হয়।
- তিনি ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে পুণেতে ‘সত্যশোধক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর লক্ষ্য ছিল শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্ত করা, তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটানো (বিশেষত নারীশিক্ষা ও দলিতদের শিক্ষা) এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য খর্ব করা।
- তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুলামগিরি’ (১৮৭৩)-তে তিনি বর্ণভেদ প্রথা এবং সামাজিক অসাম্যের তীব্র সমালোচনা করেন। ‘দীনমিত্র’ ছিল সত্যশোধক সমাজের মুখপত্র।
দক্ষিণ ভারতে শ্রীনারায়ণ গুরু ও ভাইকম সত্যাগ্রহ:
- কেরালার শ্রীনারায়ণ গুরু (১৮৫৬-১৯২৮) ছিলেন এজাভা (একটি দলিত সম্প্রদায়) সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা ও মহান সমাজসংস্কারক।
- তিনি জাতিভেদ প্রথার তীব্র বিরোধিতা করে “এক জাতি, এক ধর্ম, এক ঈশ্বর” – এই মহান আদর্শ প্রচার করেন।
- তাঁর নেতৃত্বে ও অনুপ্রেরণায় দলিতদের মন্দিরের নিকটবর্তী রাস্তা ব্যবহারের অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দে কেরালায় ঐতিহাসিক ভাইকম সত্যাগ্রহ সংগঠিত হয়। এই আন্দোলন দলিত অধিকারের প্রশ্নে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ই. ভি. রামস্বামী নাইকার ও আত্মসম্মান আন্দোলন:
- তামিলনাড়ুতে ই. ভি. রামস্বামী নাইকার (১৮৭৯-১৯৭৩) ব্রাহ্মণদের সামাজিক ও ধর্মীয় আধিপত্য এবং জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘আত্মসম্মান আন্দোলন’ শুরু করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল দ্রাবিড় সংস্কৃতি ও পরিচয়ের ভিত্তিতে এক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
ড. ভীমরাও রামজি আম্বেদকর: দলিত জাগরণের অবিসংবাদিত নেতা:
- ড. বি. আর. আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) ছিলেন ভারতের দলিত আন্দোলনের প্রধান স্থপতি। তিনি নিজে মাহার সম্প্রদায়ের সন্তান হওয়ায় বাল্যকাল থেকেই অস্পৃশ্যতার নির্মম অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।
- গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন: তিনি দলিতদের সাধারণ জলাশয় থেকে জল ব্যবহারের অধিকার আদায়ের জন্য মাহার সত্যাগ্রহ (১৯২৭) এবং মন্দিরে প্রবেশের অধিকারের জন্য কলারাম মন্দির সত্যাগ্রহ (১৯৩০) পরিচালনা করেন। ১৯২৭ সালে তিনি প্রকাশ্যে ‘মনুস্মৃতি’ দাহ করে বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান।
- সংগঠন প্রতিষ্ঠা: দলিতদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ (১৯২৪), ‘সমতা সৈনিক দল’, ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ (১৯৩৬) এবং ‘সারাভারত তপশিলি জাতি ফেডারেশন’ (১৯৪২)-এর মতো বহু সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
- রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই: তিনি লন্ডনে অনুষ্ঠিত তিনটি গোলটেবিল বৈঠকেই (১৯৩০-৩২) দলিতদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন এবং তাঁদের জন্য পৃথক নির্বাচনের জোরালো দাবি জানান।
- পুনা চুক্তি (১৯৩২): ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি’ (১৯৩২) দলিতদের পৃথক নির্বাচনের অধিকার দিলে, গান্ধিজি তার প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করেন। শেষে গান্ধিজির জীবনরক্ষার্থে আম্বেদকর পৃথক নির্বাচনের দাবি ত্যাগ করে পুনা চুক্তি (২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২) স্বাক্ষর করেন। এর ফলে দলিতদের জন্য প্রাদেশিক আইনসভায় আসন সংখ্যা ৭১ থেকে বাড়িয়ে ১৪৭টি (এবং কেন্দ্রীয় আইনসভায় ১৮%) করা হয়, তবে তা যৌথ নির্বাচনের অধীনে।
- সংবিধান প্রণয়ন: স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার খসড়া কমিটির সভাপতি হিসেবে তিনি সংবিধানে অস্পৃশ্যতা বিলোপ (১৭ নং ধারা) এবং দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করেন।
মহাত্মা গান্ধি ও হরিজন আন্দোলন:
- গান্ধিজি অস্পৃশ্যতাকে হিন্দুধর্মের ‘কলঙ্ক’ বলে মনে করতেন এবং এর অবসানের জন্য দেশব্যাপী প্রচার চালান। তিনি দলিতদের ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) নামে অভিহিত করেন।
- ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সারাভারত অস্পৃশ্যতাবিরোধী সংঘ’ (All India Anti-Untouchability League) প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘হরিজন সেবক সংঘ’ নামে পরিচিত হয়।
- ‘হরিজন’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন এবং দলিতদের মন্দির প্রবেশ, সাধারণ জলাশয় ব্যবহার ও শিক্ষার অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেন।
- তবে, গান্ধিজি বর্ণাশ্রম প্রথার উচ্ছেদের পরিবর্তে এর সংস্কারের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং দলিতদের পৃথক নির্বাচনের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, যা আম্বেদকরের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্যের প্রধান কারণ ছিল।
বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন: আত্মপরিচয় ও অধিকারের সংগ্রাম:
- অবিভক্ত বাংলায়, বিশেষত পূর্ববঙ্গের জেলাগুলিতে (ফরিদপুর, বরিশাল, ঢাকা, খুলনা, যশোহর) নমঃশূদ্ররা ছিল অন্যতম বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ দলিত হিন্দু জনগোষ্ঠী।
- শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮): তিনি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণের লক্ষ্যে মতুয়া ধর্ম প্রবর্তন করেন। তাঁর সহজ-সরল ধর্মমত ও “হাতে কাম, মুখে নাম” নীতি নমঃশূদ্রদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ জাগিয়ে তোলে। ওড়াকান্দি ছিল এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র।
- শ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৭): হরিচাঁদ ঠাকুরের পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর মতুয়া আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী ও সংগঠিত করেন। তাঁর নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা শিক্ষার প্রসারে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করে (প্রায় চার হাজার বিদ্যালয় স্থাপনে উদ্যোগী হন)। তাঁর প্রচেষ্টাতেই সরকারি নথিতে ‘চণ্ডাল’ নামের পরিবর্তে ‘নমঃশূদ্র’ নামটি স্বীকৃতি পায় (১৯১১ সালের আদমশুমারিতে)। তিনি ‘নমঃশূদ্র ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নমঃশূদ্রদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্যও সচেষ্ট হন।
- রাজনৈতিক অবস্থান: নমঃশূদ্ররা অনেক সময় জাতীয় কংগ্রেসকে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সংগঠন মনে করে দূরত্ব বজায় রাখত এবং নিজেদের স্বার্থে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে বা মুসলিম লিগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কিছু রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করত। তারা বঙ্গভঙ্গকে (১৯০৫) সমর্থন করেছিল এবং ড. আম্বেদকরের পৃথক নির্বাচনের দাবিকেও সমর্থন জানিয়েছিল।

⚖️ গান্ধি-আম্বেদকর বিতর্ক: দলিত অধিকারের প্রশ্নে দুই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি (Madhyamik History Chapter 7 Notes) ⚖️

তুলনার বিষয় (Comparison Points)	👤 মহাত্মা গান্ধি	👤 ড. বি. আর. আম্বেদকর
১. বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা	বর্ণাশ্রম প্রথাকে ভারতীয় সমাজের ভিত্তি মনে করতেন, তবে এর বিকৃত রূপের (জাতিভেদ) বিরোধী ছিলেন।বর্ণব্যবস্থার উচ্ছেদের পরিবর্তে তার সংস্কারের উপর জোর দিয়েছিলেন।	বর্ণভেদ প্রথাকেই দলিতদের দুর্দশার মূল কারণ মনে করতেন। বর্ণভেদ প্রথার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ (Annihilation of Caste) দাবি করেছিলেন।
২. অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের পদ্ধতি	অস্পৃশ্যতাকে হিন্দুধর্মের ‘কলঙ্ক’ বলে মনে করতেন এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হৃদয় পরিবর্তনের মাধ্যমে এর অবসান চাইতেন। ‘হরিজন’ নামকরণ ও ‘হরিজন সেবক সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন।	অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য শুধুমাত্র সামাজিক সংস্কার যথেষ্ট নয় বলে মনে করতেন। দলিতদের জন্য আইনগত ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন।
৩. রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন	দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের তীব্র বিরোধী ছিলেন, কারণ এটি হিন্দু সমাজকে বিভক্ত করবে বলে মনে করতেন। যৌথ নির্বাচনের অধীনে দলিতদের জন্য আসন সংরক্ষণের পক্ষপাতী ছিলেন (পুনা চুক্তি)।	দলিতদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য আইনসভায় পৃথক নির্বাচনের জোরালো দাবি জানিয়েছিলেন। মনে করতেন, উচ্চবর্ণের আধিপত্য থেকে মুক্ত না হলে দলিতদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব সম্ভব নয়।
৪. দলিতদের সামগ্রিক উন্নতি	হিন্দুধর্মের কাঠামোর মধ্যে থেকেই দলিতদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেন। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।	দলিতদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচিতি প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছিলেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক – সকল ক্ষেত্রে দলিতদের পূর্ণ অধিকার লাভই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য।