
📜 ব্যাখ্যামূলক উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (৮ নম্বর) 📜 (১৫-১৬টি বাক্যে উত্তর দাও)
১. প্রশ্ন: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা এবং ভারতসভার গঠন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা:
- গঠন:
- প্রতিষ্ঠা: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয় । এটিকে যোগেশচন্দ্র বাগল বাংলার তথা ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন বলে মনে করেন।
- উদ্যোক্তা: এর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ রাজা রামমোহন রায়ের অনুগামীরা।
- প্রথম অধিবেশন ও নেতৃত্ব: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর এর প্রথম অধিবেশন বসে গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য (তর্কবাগীশ)-এর সভাপতিত্বে। সম্পাদক ছিলেন দুর্গাপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন।
- উদ্দেশ্য:
- সরকারি নীতির পর্যালোচনা: ভারতীয়দের স্বার্থ-সম্পর্কিত সরকারি কাজকর্ম ও নীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা।
- সরকারি কাজের সমালোচনা: ব্রিটিশ সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কাজকর্মের সমালোচনা করা ।
- কর আরোপের প্রতিবাদ: ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দের আইন দ্বারা নিষ্কর জমির ওপর সরকারের কর আরোপের চেষ্টার বিরোধিতা করা।
- জনস্বার্থ রক্ষা: সরকারের কাছে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে জনগণের মঙ্গলসাধনের চেষ্টা করা । (এই সভা ধর্মীয় আলোচনা থেকে বিরত থাকত)।
ভারতসভা (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন):
- গঠন:
- প্রতিষ্ঠা: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের উদ্যোগে কলকাতায় অ্যালবার্ট হলে ‘ভারতসভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- প্রাণপুরুষ: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতসভার প্রধান উদ্যোক্তা ও প্রাণপুরুষ।
- সদস্যপদ: সমাজের সকল স্তরের মানুষ এর সদস্য হতে পারত।
- উদ্দেশ্য:
- শক্তিশালী জনমত গঠন: ব্রিটিশ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সারা ভারতে শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলা।
- রাজনৈতিক ঐক্য: ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ও বিভিন্ন ভাষাভাষী, জাতি-ধর্মের মানুষকে সাধারণ রাজনৈতিক স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করা।
- হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি: উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাব ও ঐক্য স্থাপন করা।
- গণ সংযোগ: বৃহত্তর জনসাধারণকে রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা।
- সর্বভারতীয় চেতনা: দেশবাসীর মধ্যে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করা ।
- গণ আন্দোলন: ব্রিটিশ অপশাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা ।
২. প্রশ্ন: জমিদার সভা সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের ভারতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে ‘জমিদার সভা’ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । ডঃ অনিল শীল এই যুগকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলেছেন । জমিদার সভা ছিল ভারতের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠন ।
- প্রতিষ্ঠা:
- ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে (কিছু সূত্রানুযায়ী ১২ নভেম্বর, ১৮৩৭ প্রতিষ্ঠা এবং এপ্রিল ১৮৩৮ নামকরণ) দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এবং রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে কলকাতায় জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- এটি ‘ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি’ (Landholder’s Society) বা ‘ভূম্যধিকারী সমিতি’ নামেও পরিচিতি লাভ করে।
- সদস্য:
- প্রধানত বাংলার জমিদার, ধনী ব্যবসায়ী ও অভিজাতরাই এর সদস্য ছিলেন ।
- উল্লেখযোগ্য সদস্য: দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামকমল সেন, ভবানীচরণ মিত্র প্রমুখ।
- বেসরকারি ব্রিটিশদেরও সদস্য হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের বিশেষ সুযোগ ছিল না ।
- উদ্দেশ্য:
- এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলা, বিহার, ওড়িশার জমিদার শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করা ।
- কলকাতা কেন্দ্রিক ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে নিজেদের স্বার্থে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা ।
- লন্ডনের ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’র সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা।
- প্রজাস্বার্থ নিয়েও সীমিতভাবে কিছু দাবিদাওয়া পেশ করা।
- কর্মসূচি:
- সরকারের কাছে জমিদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য বিভিন্ন দাবি পেশ করা ।
- সারা ভারতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার দাবি করা ।
- নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপের বিরোধিতা করা ।
- পুলিশ, বিচার ও রাজস্ব বিভাগের সংস্কার দাবি করা ।
- নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা।
- অবদান:
- জমিদার সভা ভারতে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করে।
- এদের আবেদনে সরকার স্বল্প পরিমাণ ব্রহ্মোত্তর জমির খাজনা মকুব করে ।
- ডঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র একে ‘ভারতের স্বাধীনতার অগ্রদূত’ বলেছেন ।
- এটি পরবর্তী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মডেল হিসেবে কাজ করে ।
- বিলুপ্তি:
- সংগঠনটি মূলত জমিদারকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং বাংলার বাইরে প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হওয়ায় এটি ক্রমশ গুরুত্ব হারায় ।
- আনুমানিক ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব থাকলেও, ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ (১৮৪৩) এর স্থান গ্রহণ করতে শুরু করে ।
৩. প্রশ্ন: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভার বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর: ভূমিকা: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখের উদ্যোগে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতসভা’ বা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ ছিল উনিশ শতকের ভারতের এক অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন । সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এই সভা বিভিন্ন ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে।
- সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগ:
- ভারতসভাকে একটি সর্বভারতীয় সংগঠনে পরিণত করার লক্ষ্যে সুরেন্দ্রনাথ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে (যেমন – লখনউ, মিরাট, লাহোর) ভ্রমণ করে শাখা স্থাপন করেন ও জনমত গঠন করেন।
- প্রধান আন্দোলনসমূহ:
- আই.সি.এস পরীক্ষার বয়স সংক্রান্ত আন্দোলন: ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করলে (১৮৭৬) ভারতীয়দের পক্ষে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন শুরু করেন এবং বয়সসীমা বাড়িয়ে ২২ বছর করা ও ইংল্যান্ড ও ভারতে একইসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানান। এই আন্দোলনের চাপে সরকার ‘স্ট্যাটুটারি সিভিল সার্ভিস’ চালু করে কিছুটা নতিস্বীকার করে।
- লিটনের দমনমূলক আইনের বিরোধিতা: বড়লাট লর্ড লিটনের দুটি প্রতিক্রিয়াশীল আইনের বিরুদ্ধে ভারতসভা তীব্র প্রতিবাদ করে:
- দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন (Vernacular Press Act, 1878): এই ‘শ্বাসরোধক আইন’ (Gagging Act) দ্বারা দেশীয় ভাষার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়। ভারতসভা ‘নেটিভ প্রেস অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করে এর বিরোধিতা করে। অবশেষে লর্ড রিপন এই আইন প্রত্যাহার করেন (১৮৮১)।
- অস্ত্র আইন (Arms Act, 1878): এই আইন দ্বারা বিনা অনুমতিতে ভারতীয়দের অস্ত্র রাখা নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু ইউরোপীয়দের এর আওতার বাইরে রাখা হয়। এই জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ভারতসভা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
- ইলবার্ট বিল আন্দোলন (১৮৮৩): লর্ড রিপন ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয়দের বিচার করার অধিকার দেওয়ার জন্য ‘ইলবার্ট বিল’ আনলে শ্বেতাঙ্গরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভারতসভা এই বিলের সমর্থনে জোরালো আন্দোলন সংগঠিত করে । যদিও বিলটি সংশোধিত রূপে পাস হওয়ায় এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় ।
- অন্যান্য আন্দোলন: ভারতসভা কৃষকদের ওপর শোষণ, অসমের চা বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার, শোষণমূলক আমদানি-শুল্ক নীতি, সম্পদের নির্গমন প্রভৃতির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিও তোলে ।
- সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন: সুরেন্দ্রনাথের উদ্যোগে ভারতসভা ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন’ (All India National Conference) আহ্বান করে, যা ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে ছিল ‘জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া’ । এই সম্মেলনের প্রেরণাতেই ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় । সুরেন্দ্রনাথ পরে তাঁর অনুগামীদের নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন (১৮৮৬) ।
📝 বিশ্লেষণধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (৪ নম্বর) 📝 (৭-৮টি বাক্যে উত্তর দাও)
১. প্রশ্ন: ‘সভাসমিতির যুগ’ বলতে কী বোঝ? অথবা, টীকা লেখো: সভাসমিতির যুগ।
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের ভারতে, বিশেষত ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং ভারতীয়রা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে।
- প্রতিষ্ঠা: এই সময়কালে, মূলত ১৮৩৬ থেকে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে, বহু রাজনৈতিক সভাসমিতি গড়ে ওঠে । যেমন – বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা, জমিদার সভা, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, পুনা সার্বজনিক সভা, মাদ্রাজ মহাজন সভা, ভারতসভা ইত্যাদি ।
- নামকরণ: ভারতে উনিশ শতকে এইভাবে বহু রাজনৈতিক সংগঠন বা সভাসমিতি গড়ে ওঠার জন্য কেমব্রিজ ঐতিহাসিক ডঃ অনিল শীল এই যুগ বা সময়পর্বকে ‘সভাসমিতির যুগ’ (Age of Associations) বলে অভিহিত করেছেন।
- উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য: এই সভাসমিতিগুলি সাংবিধানিক পদ্ধতিতে আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে ভারতীয়দের বিভিন্ন দাবিদাওয়া ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করত এবং রাজনৈতিক চেতনা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল । এগুলিই ছিল ভারতের ভবিষ্যৎ জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার।
২. প্রশ্ন: সভাসমিতির যুগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো। অথবা, সভাসমিতির যুগের বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করো।
উত্তর: উনিশ শতকের ভারতে ‘সভাসমিতির যুগ’-এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল:
- ভৌগোলিক কেন্দ্র: রাজনৈতিক সংগঠনগুলির প্রতিষ্ঠা ও কার্যকলাপ প্রাথমিকভাবে বাংলা বা কলকাতা-কেন্দ্রিক ছিল, পরে তা বোম্বাই, মাদ্রাজ ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে প্রসারিত হয় ।
- প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্য: সংগঠনগুলির উদ্যোক্তা, নেতা ও সদস্যরা ছিলেন মূলত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত মানুষ (যেমন – জমিদার, আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী)।
- উদ্দেশ্য: এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের (বিশেষত নিজেদের শ্রেণির) স্বার্থ রক্ষা করা এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আবেদন-নিবেদন বা সমালোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন দাবিদাওয়া পেশ করা ।
- কার্যকলাপের প্রকৃতি: প্রথমদিকের সংগঠনগুলির কার্যকলাপ ছিল ধীর গতিসম্পন্ন ও আবেদন-নিবেদন নির্ভর । ভারতসভা (১৮৭৬) প্রতিষ্ঠার পর রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পায় ।
- সীমাবদ্ধতা: এই সংগঠনগুলির প্রভাব মূলত শহরকেন্দ্রিক এবং শিক্ষিত বা উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । সাধারণ কৃষক, শ্রমিক বা গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে এদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কম ছিল ।
৩. প্রশ্ন: ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’-কে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন?
উত্তর: ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’-কে অনেক ঐতিহাসিক (যেমন – যোগেশচন্দ্র বাগল) ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন, কারণ:
- রাজনৈতিক বিষয়ের আলোচনা: এটিই ছিল প্রথম সভা যেখানে ব্রিটিশ ধাঁচে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্ক ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো ।
- সরকারি নীতির পর্যালোচনা: এই সভা সরকারের সেইসব কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করত যেগুলির সঙ্গে ভারতীয়দের স্বার্থ জড়িত ছিল।
- প্রতিবাদী ভূমিকা: এটি সরকারি নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, সরকার কর্তৃক নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপের চেষ্টার (১৮২৮ সালের আইন অনুযায়ী) বিরুদ্ধে এই সভা সক্রিয় প্রতিবাদ জানায়।
- শুধুমাত্র ধর্মীয় বা সামাজিক নয়: পূর্ববর্তী সংগঠনগুলির মতো এটি কেবল ধর্মীয় বা সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করত না, বরং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিল। এই বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই একে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হয়।
৪. প্রশ্ন: টীকা লেখো: হিন্দুমেলা।
উত্তর: ভূমিকা: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলায় জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলির মধ্যে ‘হিন্দুমেলা’ ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ।
- প্রতিষ্ঠা: ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ই এপ্রিল (চৈত্র সংক্রান্তির দিন) কলকাতায় হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসু। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম সম্পাদক এবং নবগোপাল মিত্র সহ-সম্পাদক। চৈত্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হতো বলে এটি ‘চৈত্রমেলা’ নামেও পরিচিত ছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল।
- উদ্দেশ্য: এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির গৌরব প্রচার, দেশীয় ভাষা ও শিল্পের উন্নতি, জাতীয় প্রতীকগুলির মর্যাদা দান, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব রোধ, এবং দেশবাসীর মধ্যে দেশাত্মবোধ, আত্মনির্ভরতা ও জাতীয় ঐক্যবোধ জাগিয়ে তোলা।
- কার্যকলাপ: মেলায় দেশীয় শিল্পকর্ম ও কৃষিজাত পণ্যের প্রদর্শনী, জাতীয়তাবাদী সঙ্গীত (‘গাও ভারতের জয়’ ), কবিতা পাঠ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হিন্দুমেলার উপহার’ ), ব্যায়াম ও দেশীয় খেলার প্রতিযোগিতা এবং জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা আয়োজিত হতো।
- গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা: হিন্দুমেলা বাঙালির মনে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এবং আত্মনির্ভরতার বার্তা দেয়। তবে এর ‘হিন্দু’ পরিচিতি এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির অভাব এর আবেদনকে কিছুটা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল ।
৫. প্রশ্ন: হিন্দুমেলার উদ্দেশ্য কী ছিল? অথবা, হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু ও নবগোপাল মিত্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুমেলার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল:
- জাতীয়তাবোধের জাগরণ: ভারতবাসীর মধ্যে, বিশেষত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে, জাতীয় চেতনা ও দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা।
- আত্মনির্ভরতা: দেশীয় ভাষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি ঘটিয়ে এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে জাতির আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতার ভাব বৃদ্ধি করা।
- ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার: হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির অতীত গৌরবগাথা প্রচার করে জাতির মনে হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা জাগানো ।
- পাশ্চাত্য প্রভাব রোধ: পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধের চেষ্টা করা ।
- ঐক্য স্থাপন: দেশবাসীর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা (যদিও এর আবেদন মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল)।
৬. প্রশ্ন: জাতীয়তাবাদ প্রসারে হিন্দুমেলার ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: ঔপনিবেশিক বাংলায় জাতীয়তাবাদের প্রসারে হিন্দুমেলার (১৮৬৭) ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ:
- স্বাদেশিকতার প্রচার: হিন্দুমেলা বক্তৃতামালা, দেশাত্মবোধক গান (যেমন জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গাও ভারতের জয়’ ), কবিতা পাঠ প্রভৃতির মাধ্যমে দেশবাসীর মনে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে ।
- আত্মনির্ভরতার আদর্শ: দেশীয় শিল্প, সাহিত্য, ভাষা ও শরীরচর্চার (যেমন লাঠিখেলা, কুস্তি ) উপর গুরুত্ব আরোপ করে হিন্দুমেলা জাতির মধ্যে আত্মনির্ভরতার আদর্শ প্রচার করে। নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল জিমনেশিয়াম’ এর একটি উদাহরণ ।
- সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ: ভারতীয় (প্রধানত হিন্দু) ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কীর্তির গৌরবগাথা প্রচার করে মেলা এক ধরনের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়, যা মানুষকে বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
- ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস: যদিও এর আবেদন মূলত হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তবুও এটি ছিল জাতীয় উদ্দেশ্য সাধনে বাঙালির প্রথম দিকের একটি সংগঠিত প্রয়াস, যা পরবর্তী আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছিল । ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর জাতীয়তাবাদী উদ্দেশ্য স্বীকার করেছেন ।
৭. প্রশ্ন: ‘হিন্দুমেলা’-র সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল? অথবা, ‘হিন্দুমেলা’ কেন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি?
উত্তর: হিন্দুমেলা জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রসারে অবদান রাখলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যার ফলে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়নি:
- হিন্দুধর্ম কেন্দ্রিকতা: ‘হিন্দুমেলা’ নাম এবং এর কার্যকলাপ অনেকাংশে হিন্দুধর্ম ও ঐতিহ্যকেন্দ্রিক হওয়ায় তা অ-হিন্দু সম্প্রদায়কে আকর্ষণ করতে পারেনি । এমনকি নতুন প্রজন্মের যুক্তিবাদী শিক্ষিত বাঙালি হিন্দুদের একাংশও এর excessive হিন্দু ঝোঁক সমর্থন করেনি ।
- রাজনৈতিক কর্মসূচির অভাব: এই মেলা মূলত সাংস্কৃতিক ও ভাবাবেগ নির্ভর জাতীয়তাবাদের উপর জোর দিয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি বা আন্দোলন পরিচালনা করেনি ।
- ভারতসভার উত্থান: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে অধিকতর সক্রিয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচি-ভিত্তিক ‘ভারতসভা’ প্রতিষ্ঠিত হলে হিন্দুমেলা ক্রমশ তার গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা হারাতে থাকে ।
- সক্রিয়তার অভাব: পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যে ধরনের সক্রিয় ব্রিটিশ-বিরোধী কার্যকলাপ প্রয়োজন ছিল, হিন্দুমেলা তা দেখাতে ব্যর্থ হয়, ফলে সাধারণ মানুষ এর থেকে দূরে সরে যায় ।
৮. প্রশ্ন: ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান কার্যাবলি/পদক্ষেপগুলি উল্লেখ করো। অথবা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভার প্রতিবাদ আন্দোলনগুলি উল্লেখ করো।
উত্তর: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতসভা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয়দের স্বার্থরক্ষায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও প্রতিবাদ আন্দোলন পরিচালনা করে:
- সিভিল সার্ভিস সংক্রান্ত আন্দোলন: আই.সি.এস পরীক্ষায় ভারতীয়দের বসার বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ করায় ভারতসভা তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং বয়সসীমা বাড়িয়ে ২২ বছর করা ও ইংল্যান্ড ও ভারতে একইসঙ্গে পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন করে ।
- লিটনের দমনমূলক আইনের বিরোধিতা:
- ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট (১৮৭৮): দেশীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধকারী এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ সংগঠিত করে ।
- অস্ত্র আইন (১৮৭৮): ভারতীয়দের অস্ত্র রাখার অধিকারে বৈষম্যমূলক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে, যার ফলে পরে আইনটি প্রত্যাহৃত হয় ।
- ইলবার্ট বিল সমর্থন: ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয়দের বিচারের অধিকার দেওয়ার প্রশ্নে ইলবার্ট বিলের সমর্থনে ভারতসভা শ্বেতাঙ্গদের বিরোধিতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন করে ।
- কৃষক স্বার্থে আন্দোলন: জমিদার ও সরকারের শোষণ, শোষণমূলক শুল্ক আইন, চা-বাগানের কুলিদের ওপর অত্যাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে কৃষকদের সমর্থনে আন্দোলন করে ।
- অন্যান্য দাবি: প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন, স্বায়ত্তশাসন, প্রজাস্বত্ব আইন, মদ্যপান নিবারণ প্রভৃতি দাবিতেও আন্দোলন সংগঠিত করে ।
- বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন: ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনে ভারতসভা সক্রিয় ভূমিকা নেয় এবং ‘জাতীয় ভাণ্ডার’ গঠন করে ।
৯. প্রশ্ন: ভারতসভার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী ভূমিকা ছিল? অথবা, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কার্যকলাপগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, রাজনৈতিক সমিতি হিসেবে ভারতসভার গুরুত্ব লেখো। অথবা, ভারত সভার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: ভারতসভার প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তার পেছনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৪৮-১৯২৫) ভূমিকা ছিল অবিচ্ছেদ্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
- প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ: আনন্দমোহন বসু প্রমুখের সহযোগিতায় ভারতসভা (১৮৭৬) প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা এবং এর প্রাণপুরুষ ।
- সর্বভারতীয় রূপদান: তিনি ভারতকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে (লাহোর, মুলতান, সিন্ধু, মিরাট, কানপুর, এলাহাবাদ, বোম্বাই, মাদ্রাজ ইত্যাদি) ভ্রমণ করে ভারতসভার শাখা স্থাপন করেন এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রচার চালান ।
- আন্দোলনে নেতৃত্ব: তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে ভারতসভা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়স বৃদ্ধি, লিটনের দমনমূলক আইন (ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, অস্ত্র আইন) এর বিরোধিতা, ইলবার্ট বিলের পক্ষে আন্দোলন এবং কৃষক স্বার্থ সহ বিভিন্ন দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত করে ভারতসভাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
- জাতীয় সম্মেলনের আহ্বান: তাঁরই উদ্যোগে ১৮৮৩ ও ১৮৮৫ সালে কলকাতায় ‘সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়, যা জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে ।
- কংগ্রেসকে শক্তিশালীকরণ: ১৮৮৬ সালে তিনি তাঁর অনুগামীদের নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন, যা কংগ্রেসকে আরও শক্তিশালী করে তোলে ।
- ‘রাষ্ট্রগুরু’ সম্মান: তাঁর বাগ্মিতা, সংগঠন ক্ষমতা এবং জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের জন্য তিনি ‘রাষ্ট্রগুরু’ সম্মানে ভূষিত হন ।
১০. প্রশ্ন: টীকা লেখো: ইলবার্ট বিল।
উত্তর: ভূমিকা: লর্ড রিপনের শাসনকালে (১৮৮০-৮৪) বিচারব্যবস্থায় ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যেকার বৈষম্য দূর করার একটি প্রচেষ্টা ছিল ইলবার্ট বিল বিতর্ক ।
- প্রেক্ষাপট: তৎকালীন আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় কোনো ভারতীয় বিচারক (এমনকি উচ্চপদস্থ হলেও) শ্বেতাঙ্গ বা ইউরোপীয় আসামিদের বিচার করতে পারতেন না । এটি ছিল স্পষ্ট জাতিগত বৈষম্য।
- বিলের বিষয়বস্তু: বড়লাট লর্ড রিপনের আইন সচিব কোর্টনি ইলবার্ট ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে একটি বিলের খসড়া তৈরি করেন, যা ‘ইলবার্ট বিল’ নামে পরিচিত । এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা জজদের ইউরোপীয় আসামিদের বিচার করার অধিকার দেওয়া, অর্থাৎ বিচারব্যবস্থায় জাতিগত বৈষম্যের অবসান ঘটানো ।
- শ্বেতাঙ্গদের বিরোধিতা: এই বিলের বিরুদ্ধে ভারতে বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় । ব্যারিস্টার ব্র্যানসনের নেতৃত্বে তারা ‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করে বিলের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন শুরু করে এবং চাঁদা সংগ্রহ করে । এমনকি তারা রিপনকে ভারত থেকে বিতাড়নের হুমকিও দেয় ।
- ভারতীয়দের সমর্থন: অন্যদিকে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লালমোহন ঘোষ ও ভারতসভার নেতৃত্বে ভারতীয়রাও বিলের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং পাল্টা আন্দোলন ও সভার আয়োজন করে । ‘বেঙ্গলী’, ‘অমৃতবাজার’ প্রভৃতি পত্রিকা এর সমর্থনে প্রচার চালায় ।
- পরিণতি: শ্বেতাঙ্গদের প্রবল বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ সরকার নতিস্বীকার করে। বিলটি এমনভাবে সংশোধন করা হয় যে, ভারতীয় বিচারক ইউরোপীয় আসামির বিচার করলেও, আসামি জুরি বা অ্যাসেসরের সাহায্য চাইতে পারতেন, যেখানে অর্ধেক সদস্য ইউরোপীয় হতে হতো। ফলে বিলের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয় ।
- তাৎপর্য: বিলটি ব্যর্থ হলেও এই বিতর্ক ভারতীয়দের চোখ খুলে দেয়। এটি ব্রিটিশ শাসনের বর্ণবিদ্বেষী চরিত্রকে স্পষ্ট করে এবং ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঐক্যের প্রয়োজনীয়তাকে আরও বৃদ্ধি করে, যা জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষভাবে সাহায্য করে ।
📌 সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (২ নম্বর) 📌 (২-৩টি বাক্যে উত্তর দাও)
১. প্রশ্ন: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলা হয় কেন? অথবা, সভাসমিতির যুগ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতে, বিশেষ করে বাংলায়, পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফলে বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বা সভাসমিতি (যেমন জমিদার সভা, ভারতসভা, হিন্দুমেলা ইত্যাদি) গড়ে ওঠে। এই প্রবণতার জন্য ঐতিহাসিক ডঃ অনিল শীল এই সময়কালকে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলে অভিহিত করেছেন।
২. প্রশ্ন: উনিশ শতকে ভারতে গড়ে-ওঠা সভাসমিতি বা রাজনৈতিক সংগঠনগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
উত্তর: উনিশ শতকের সভাসমিতিগুলির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল:
- প্রতিষ্ঠা ও কার্যকলাপ মূলত বাংলা (পরে বোম্বাই, মাদ্রাজ) কেন্দ্রিক ছিল ।
- সদস্য ও নেতৃত্ব ছিলেন মূলত শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ ।
- প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আবেদন-নিবেদন করে ভারতীয়দের (বিশেষত নিজেদের শ্রেণির) স্বার্থরক্ষা করা ।
- এদের প্রভাব মূলত শহর ও শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ।
৩. প্রশ্ন: জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলার উল্লেখযোগ্য সভাসমিতি বা সংগঠনগুলির নাম লেখো।
উত্তর: জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার (১৮৮৫) আগে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংগঠন হল:
- বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা (১৮৩৬)
- জমিদার সভা বা ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি (১৮৩৮)
- বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪৩)
- ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৫১)
- হিন্দুমেলা (১৮৬৭)
- ইন্ডিয়ান লিগ (১৮৭৫)
- ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬)
৪. প্রশ্ন: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার দুটি উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি উল্লেখ করো।
উত্তর: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার দুটি উল্লেখযোগ্য কার্যাবলি হল:
- সরকারি নীতি (যেগুলির সঙ্গে ভারতীয়দের স্বার্থ জড়িত) নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা ।
- সরকার কর্তৃক নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপের চেষ্টার (১৮২৮ সালের আইন অনুযায়ী) সক্রিয় বিরোধিতা করা ।
৫. প্রশ্ন: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
উত্তর: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার প্রধান সীমাবদ্ধতাগুলি ছিল:
- এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো বা ধারাবাহিক প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি ।
- এর কার্যকলাপ মূলত কলকাতা-কেন্দ্রিক এবং স্বল্পায়ু ছিল; প্রতিষ্ঠার কিছুকালের মধ্যেই এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।
৬. প্রশ্ন: ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ কবে এবং কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর:
- প্রতিষ্ঠা: ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল জর্জ টমসনের উৎসাহ ও উদ্যোগে ‘বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ।
- উদ্দেশ্য:
- ভারতীয় জনগণের মধ্যে সুনাগরিকের গুণাবলি বিকশিত করা ।
- ভারতীয়দের তাদের ‘ন্যায্য অধিকার’ সম্পর্কে সচেতন করা ।
- ব্রিটিশ শাসকের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ ও আইনানুগ উপায়ে সেই অধিকারগুলি আদায় করা ।
৭. প্রশ্ন: জমিদার সভা ও ভারতসভার মধ্যে দুটি পার্থক্য লেখো।
উত্তর: জমিদার সভা ও ভারতসভার মধ্যে দুটি প্রধান পার্থক্য হল:
- সদস্য: জমিদার সভা ছিল মূলত জমিদার ও ধনী ব্যবসায়ীদের সংগঠন, যেখানে ভারতসভা ছিল তুলনামূলকভাবে উদার এবং মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষকেও যুক্ত করার চেষ্টা করেছিল ।
- লক্ষ্য: জমিদার সভার প্রধান লক্ষ্য ছিল মূলত জমিদারদের স্বার্থরক্ষা করা, অন্যদিকে ভারতসভার লক্ষ্য ছিল ব্যাপকতর – সর্বভারতীয় ঐক্য গঠন, শক্তিশালী জনমত তৈরি এবং ভারতীয়দের সার্বিক কল্যাণসাধন ।
৮. প্রশ্ন: হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করো। অথবা, হিন্দুমেলা কেন চৈত্রমেলা নামে পরিচিত হয়?
উত্তর:
- প্রেক্ষাপট: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির মধ্যে দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্মের প্রতি গৌরববোধ জাগিয়ে তোলা এবং জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজনারায়ণ বসুর ‘জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা’ এবং নবগোপাল মিত্রের প্রচেষ্টা এর পথ প্রশস্ত করে ।
- চৈত্রমেলা: এটি ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির দিন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর বার্ষিক অধিবেশনও সাধারণত চৈত্র মাসেই হতো, তাই এটি ‘চৈত্রমেলা’ নামেও পরিচিত ছিল।
৯. প্রশ্ন: হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম লেখো।
উত্তর: হিন্দুমেলার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন:
- নবগোপাল মিত্র (প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-সম্পাদক)
- রাজনারায়ণ বসু (প্রধান অনুপ্রেরণা)
- গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রথম সম্পাদক)
- দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
- গিরিশচন্দ্র ঘোষ
- রমানাথ ঠাকুর
- পিয়ারীচরণ সরকার
- কৃষ্ণদাস পাল
১০. প্রশ্ন: নবগোপাল মিত্র কে ছিলেন?
উত্তর: নবগোপাল মিত্র ছিলেন উনিশ শতকের বাংলার একজন বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী লেখক ও সংগঠক। তিনি ছিলেন:
- হিন্দুমেলা বা চৈত্রমেলার (১৮৬৭) প্রধান উদ্যোক্তা ও সহ-সম্পাদক ।
- ‘ন্যাশনাল পেপার’, ‘ন্যাশনাল স্কুল’, ‘ন্যাশনাল জিমনেশিয়াম’, ‘ন্যাশনাল সার্কাস’ ইত্যাদি ‘ন্যাশনাল’ বা জাতীয় ভাবধারাপুষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, যার জন্য তিনি ‘ন্যাশনাল মিত্র’ নামে পরিচিত ছিলেন।
১১. প্রশ্ন: হিন্দুমেলার ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক সভা সম্পর্কে কী জান?
উত্তর: হিন্দুমেলার ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক অধিবেশনটি বিশেষভাবে স্মরণীয় কারণ:
- এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন খ্যাতনামা চিন্তাবিদ ও লেখক রাজনারায়ণ বসু ।
- এই অধিবেশনেই মাত্র ১৪ বছর বয়স্ক কিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্বরচিত দেশাত্মবোধক কবিতা ‘হিন্দুমেলার উপহার’ আবৃত্তি করেন ।
১২. প্রশ্ন: হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?
উত্তর: হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল:
- হিন্দুধর্মের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা প্রচার করা ।
- দেশীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পের চর্চাকে উৎসাহিত করা ।
- জাতীয় প্রতীকগুলির প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন করা ।
- দেশবাসীর মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও দেশাত্মবোধ জাগানো।
১৩. প্রশ্ন: দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে হিন্দুমেলা কী ধরনের উদ্যোগ নেয়?
উত্তর: দেশাত্মবোধ ও জাতীয়তাবাদের বিকাশে হিন্দুমেলা নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলি নেয়:
- হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির গৌরবময় দিক তুলে ধরা ।
- দেশীয় ভাষা চর্চা ও দেশাত্মবোধক কবিতা ও গানের (‘গাও ভারতের জয়’) প্রচলন করা ।
- জাতীয় প্রতীকগুলির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগানো ।
- দেশীয় শিল্প ও কারুকার্যের প্রদর্শনীর আয়োজন করা ।
- শরীরচর্চা ও দেশীয় খেলার মাধ্যমে যুবকদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও শক্তি সঞ্চারের চেষ্টা করা ।
১৪. প্রশ্ন: হিন্দুমেলার সীমাবদ্ধতাগুলি কী ছিল? অথবা, হিন্দুমেলা কেন জনপ্রিয়তা হারায়?
উত্তর: হিন্দুমেলার সীমাবদ্ধতা ও জনপ্রিয়তা হারানোর কারণ:
- এর হিন্দুধর্ম কেন্দ্রিকতা বহু অ-হিন্দু এবং নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত হিন্দুদেরও আকৃষ্ট করতে পারেনি ।
- সরাসরি রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণে অনীহা একে নিছক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত করে ।
- সক্রিয় রাজনৈতিক সংগঠন ‘ভারতসভা’র উত্থান এর গুরুত্ব হ্রাস করে।
১৫. প্রশ্ন: ‘ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি’ কী উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি’ বা জমিদার সভার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল:
- বাংলা, বিহার ও ওড়িশার জমিদারদের শ্রেণিগত স্বার্থরক্ষা করা ।
- চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রসার ঘটানো ও জমিদারদের জমির উপর অধিকার সুরক্ষিত রাখা।
- নিষ্কর বা খাজনামুক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করার সরকারি উদ্যোগ প্রতিহত করা ।
- নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ব্রিটিশ সরকারের নীতিকে জমিদারদের অনুকূলে প্রভাবিত করা।
১৬. প্রশ্ন: কবে, কাদের উদ্যোগে ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর:
- কবে: ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই।
- কাদের উদ্যোগে: প্রধানত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সহযোগী আনন্দমোহন বসু, শিবনাথ শাস্ত্রী, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সক্রিয় উদ্যোগে কলকাতায় ভারতসভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৭. প্রশ্ন: ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি কী ছিল?
উত্তর: ভারতসভা প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলি ছিল:
- ভারতীয়দের সার্বিক কল্যাণসাধন ও স্বার্থরক্ষা করা ।
- সমগ্র ভারতে, বিশেষত শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে, রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানো ।
- ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতীয়দের দাবিদাওয়া পেশ করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ।
- সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ঐক্য ও শক্তিশালী জনমত গঠন করা।
১৮. প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে ভারতসভার কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন কর্তৃক বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলন শুরু হয়, তাতে ভারতসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
- বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় ও জনমত গঠন করে ।
- স্বদেশি দ্রব্যের ব্যবহার জনপ্রিয় করতে এবং বিদেশি দ্রব্য বয়কটে জনগণকে উৎসাহিত করে ।
- এই উদ্দেশ্যে তারা একটি ‘জাতীয় ভাণ্ডার’ (National Fund) গঠন করে দেশীয় শিল্পের প্রসারে সাহায্য করে ।
- বিভিন্ন প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে।
১৯. প্রশ্ন: দেশবাসীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটানোর উদ্দেশ্যে ভারতসভা কী কর্মসূচি গ্রহণ করে?
উত্তর: রাজনৈতিক চেতনার প্রসার ঘটাতে ভারতসভা নিম্নলিখিত কর্মসূচি নেয়:
- সারা দেশে সভা-সমিতি করে ব্রিটিশ শাসনের ত্রুটি ও ভারতীয়দের দুর্দশার কথা তুলে ধরা ।
- রাজনৈতিক স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করা ।
- হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া ।
- শিক্ষিত শ্রেণির পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করার প্রয়াস চালানো ।
২০. প্রশ্ন: ভারতসভা ভারতীয়দের স্বার্থে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে?
উত্তর: ভারতসভা ভারতীয়দের স্বার্থে বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায়ে ও প্রতিবাদে সক্রিয় ছিল:
- সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের বসার বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন ।
- লর্ড লিটনের প্রতিক্রিয়াশীল ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ ও ‘অস্ত্র আইন’-এর বিরোধিতা ।
- বিচারব্যবস্থায় বর্ণবৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ‘ইলবার্ট বিল’-কে সমর্থন ।
- কৃষকদের ওপর শোষণ ও চা-বাগানের কুলিদের দুরবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ।
- দেশে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি ।
২১. প্রশ্ন: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসার বয়স বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করেন? অথবা, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়স-সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।
উত্তর: ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষায় বসার ঊর্ধ্বতম বয়স ২১ থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করে দেয় । এর ফলে ভারতীয় পরীক্ষার্থীদের পক্ষে এত কম বয়সে বিদেশে (ইংল্যান্ডে) গিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এটি ছিল ভারতীয়দের প্রশাসনিক উচ্চপদ থেকে দূরে রাখার একটি কৌশল। তাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারতসভা এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে এবং বয়সসীমা পুনরায় বাড়িয়ে অন্তত ২২ বছর করার ও পরীক্ষা ইংল্যান্ড ও ভারতে একইসঙ্গে নেওয়ার দাবিতে দেশব্যাপী জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন ।
২২. প্রশ্ন: ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.)-এর বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।
উত্তর: বড়লাট লর্ড লিটন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন’ বা Vernacular Press Act জারি করে ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির স্বাধীনতা কেড়ে নেন এবং সরকারের সমালোচনার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেন । ইংরেজি ভাষার পত্রিকাগুলি এর আওতার বাইরে ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা এই দমনমূলক ও বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করে এবং এটিকে ‘সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধকারী আইন’ (Gagging Act) বলে অভিহিত করে।
২৩. প্রশ্ন: ‘অস্ত্র আইন’ (১৮৭৮ খ্রি.)-এর বিরুদ্ধে ভারতসভার আন্দোলনের পরিচয় দাও।
উত্তর: বড়লাট লর্ড লিটন ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অস্ত্র আইন’ বা Arms Act প্রণয়ন করে规定 করেন যে, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো ভারতীয় আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে না, এমনকি আত্মরক্ষার জন্যও নয় । অথচ, ভারতে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের এই আইনের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই নির্লজ্জ জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারতসভা তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে ।
২৪. প্রশ্ন: ‘ইলবার্ট বিল’ কী?
উত্তর: ‘ইলবার্ট বিল’ ছিল ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বড়লাট লর্ড রিপনের আইন-সচিব স্যার কোর্টনি ইলবার্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি আইনের খসড়া । এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বিচারব্যবস্থায় জাতিগত বৈষম্য দূর করা এবং ভারতীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজদের ইউরোপীয় বা শ্বেতাঙ্গ আসামিদের বিচার করার অধিকার প্রদান করা, যা আগে তাদের ছিল না ।
২৫. প্রশ্ন: ইলবার্ট বিলের সপক্ষে ভারতসভার আন্দোলন উল্লেখ করো।
উত্তর: লর্ড রিপন যখন ইলবার্ট বিল এনে ভারতীয় বিচারকদের ইউরোপীয়দের বিচার করার অধিকার দিতে চাইলেন, তখন ভারতে বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গরা ‘ডিফেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করে এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করে । এর প্রতিক্রিয়ায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতসভা বিলটির সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং সারা দেশে সভা-সমিতি করে বিলের পক্ষে জোরালো জনমত গঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করে ।
✨ কিছু অতিরিক্ত সম্ভাব্য প্রশ্ন ও উত্তর ✨
২৬. প্রশ্ন: উনিশ শতকের সভাসমিতিগুলির প্রধান সীমাবদ্ধতা কী ছিল?
উত্তর: উনিশ শতকের সভাসমিতিগুলির প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল:
- এগুলির কার্যকলাপ মূলত শহর-কেন্দ্রিক ও শিক্ষিত উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ ছিল।
- সাধারণ কৃষক, শ্রমিক ও গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে এদের যোগাযোগ বা প্রভাব ছিল অত্যন্ত সীমিত।
- প্রাথমিক পর্বের সমিতিগুলি মূলত আবেদন-নিবেদন ও নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, গণ-আন্দোলনে বিশেষ জোর দেয়নি।
- অনেক সমিতির মধ্যেই অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা নেতৃত্বের সংঘাত দেখা দিত।
২৭. প্রশ্ন: ‘ভারতসভা’ ও ‘জাতীয় কংগ্রেস’-এর মধ্যে সম্পর্ক কী ছিল?
উত্তর: ‘ভারতসভা’ কে во многом ‘জাতীয় কংগ্রেস’-এর অগ্রদূত বা পথপ্রদর্শক বলা হয়।
- ভারতসভা প্রথম একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে।
- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে ভারতসভা কর্তৃক আয়োজিত ‘সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন’ (১৮৮৩, ১৮৮৫) কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
- কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর (১৮৮৫), সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ভারতসভাকে কংগ্রেসে অন্তর্ভুক্ত করেন (১৮৮৬), যা কংগ্রেসকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
২৮. প্রশ্ন: ‘জাতীয় মেলা’ বা ‘হিন্দুমেলা’ ছাড়া উনিশ শতকে প্রতিষ্ঠিত অপর একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠনের নাম ও তার একজন প্রধান নেতার নাম লেখো।
উত্তর:
- সংগঠন: ভারতসভা বা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৬)।
- প্রধান নেতা: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২৯. প্রশ্ন: রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ‘জমিদার সভা’র দুটি গুরুত্ব উল্লেখ করো।
উত্তর: রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে ‘জমিদার সভা’র দুটি গুরুত্ব হল:
- এটি ছিল ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম, যা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করে।
- এটি নিজেদের দাবিদাওয়া ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য সংগঠিত প্রয়াস চালায় এবং ব্রিটেনেও প্রচারের ব্যবস্থা করে, যা পরবর্তী সংগঠনগুলিকে পথ দেখায়।